1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অপচয় বন্ধ হোক

শীর্ষ বন্দোপাধ্যায়, কলকাতা৫ অক্টোবর ২০১৪

প্রতি বছর দুর্গা পুজোকে ঘিরে অসংখ্য কারিগরের অন্ন-সংস্থান হয়৷ এটা যেমন সত্যি কথা, তেমনই এটাও ঠিক যে উৎসবের নামে যে বিপুল অপচয় আমরা করি, তার কণা মাত্র বাঁচাতে পারলেও বদলে যেতে পারে আরও বহু মানুষের জীবন৷

https://p.dw.com/p/1DPhL
Durga puja Festival (Bildergalerie)
ছবি: DW/M. Mamun

কারণ, এটাও তো সত্যি কথা যে পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতের অন্যত্র, এমনকি বিদেশেও দুর্গা পুজো যতটা না ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, তার থেকেও বেশি এক উদযাপনের উপলক্ষ্য৷ আর তারই সুবাদে পুজোর জাঁকজমকের সঙ্গে যুক্ত থাকা বহু শিল্পী এবং কারিগর সারা বছরের খোরাকি জুটিয়ে নিতে পারেন এই একটি পার্বন থেকে৷ তা ছাড়া, সেই কোন পশ্চিম মেদিনীপুরের কাঁথির দক্ষ মণ্ডপ-শিল্পী বা হুগলি জেলার চন্দননগরের আলোকসজ্জা-শিল্পীদের কথা কী করেই বা জানা যেত, যদি না এই উদযাপন থাকত!

Indien Bettlerfamilie während des Festes Durga Puja in Kalkutta
গোটা শহর যখন পুজোর উৎসব করছে তখন রাস্তার পাশে ঘুমাচ্ছে একটি পরিবারছবি: DW/S. Bandopadhyay

কিন্তু তার পরেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়৷ শহর মফস্বলে যত বড় পুজো, তার তত বেশি জাঁকজমক এবং তার খরচের বহরও বেশি৷ শহর কলকাতার অনেক পুজোরই বাজেট এখন কোটির ঘরে হিসেব করা হয়৷ এই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে এমন অনেক কিছুই করা হয়, যা বাহুল্য, না করলেও চলত৷ অবশ্য এটাও ঠিক যে আপাতদৃষ্টিতে যে জিনিসগুলো অপচয় বলে মনে হয়, তা আদতে হয়ত বাজে খরচ নয়৷ বরং সমান্তরাল এক অর্থনীতি সজীব থাকে এই উৎসবের উপলক্ষ্যে৷ যিনি প্রতিমা বানান, বা যিনি মণ্ডপ তৈরি করেন, বা আলোকসজ্জার কাজে যুক্ত থাকেন, তাঁদের জীবিকা সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী-কারিগররা কাজ পান, উপার্জনের সুযোগ পান৷ কিন্তু তার পরেও কি আমাদের উৎসবের বরাদ্দের একটা ছোট অংশ গরিব মানুষের উন্নতির জন্য খরচ করা যায় না!

না, গরিব মানুষদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ বা একদিন তাদের বিনাপয়সার ভোজ খাওয়ানোর মতো দান-ধ্যানের কথা হচ্ছে না৷ অনেক পুজো কমিটিই এই কাজটা করে থাকেন৷ কিন্তু তার বাইরেও সম্ভবত আরও কিছু করার থাকে, যাতে ওই দরিদ্র মানুষগুলোকে আমাদের উৎসব-কেন্দ্রিক এই সমান্তরাল অর্থনীতির শরিক করে নেওয়া যায়৷ তাঁদের উপার্জনের একটা সংস্থান করে দেওয়া যায়, যাতে তাঁরা অন্তত পুজোর দিনগুলোয় ভিক্ষা করে খেতে বাধ্য না হন৷ তবে এটাও ঠিক যে যাঁরা ভিক্ষা করেন, অভাবের থেকেও বেশি সক্রিয় থাকে তাঁদের স্বভাব৷ প্রায় বিনা পরিশ্রমে রোজগার করার বদভ্যাসই তাদের শ্রমবিমুখ করে রাখে৷ ফলে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ তো করা যায়ই না, বরং একদল ধান্দাবাজ লোকের জন্য এটা একটা লাভজনক ব্যবসা হয়ে ওঠে৷ শোনা যায়, যে অসুস্থ বৃদ্ধার চিকিৎসার কাতর আবেদনে আপনি সাড়া দিলেন, বা অপুষ্ট শিশু কোলে যে মায়ের করুণ চেহারা হৃদয় বিগলিত করল আপনার এবং আপনি প্রাপ্যের তুলনায় একটু বেশিই ভিক্ষা দিলেন, সেই অর্থ নাকি শেষপর্যন্ত ওদের হাতে যায় না! যায় এলাকার সেই মাতব্বরের কাছে, যে ওই ভিক্ষুকদের নিয়ে ফলাও ব্যবসা ফেঁদেছে!

কাজেই ভিক্ষা নয়, এক-দুদিনের সাহায্য বা বস্ত্রবিতরণ নয়, বরং আমাদের উৎসবের খরচ বাঁচিয়ে, অপচয় বাঁচিয়ে এমন কোনও সংস্থান করা উচিত, যাতে এই মানুষগুলো আর্থিক এবং সামাজিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে৷ সারা ভারতেই গ্রাম-শহরে এই রকম আর্থিক স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তুলে, তাদের বৃত্তিমুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে সুফল মিলেছে৷ বহু বেসরকারি সেবা সংস্থা বা এনজিও এবং সরকারি দপ্তরও এই ধরনের উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছে৷ একটা সময় ছিল যখন দলে দলে মেয়েরা গ্রাম থেকে শহরে আসত কাজের খোঁজে৷ এরা মূলত সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি পরিচারিকা, অথবা নির্মাণকর্মী হিসেবে ঠিকাদারদের কাছে দিনমজুরিতে কাজ করত৷ বলা বাহুল্য যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের অদক্ষ শ্রমের এইসব কাজে আর্থিক শোষণ থেকে শারীরিক নির্যাতন, সবই চলত অবাধে৷

Porträt - Sirsho Bandopadhyay
ব্লগটির লেখক: শীর্ষ বন্দোপাধ্যায়ছবি: privat

কিন্তু যবে থেকে গ্রামে-মফস্বলে বৃত্তিমুখী প্রশিক্ষণের চল হয়েছে, যবে থেকে ক্ষুদ্রশিল্পে প্রশিক্ষিত কর্মীর চাহিদাকে কাজে লাগানো গিয়েছে, তবে থেকে পরিচারিকাদের শহরমুখী এই ঢলকে ক্রমশ আটকে দেওয়া গিয়েছে৷ অন্যদিকে পরিচারিকা, আয়া বা সেবাদানকারী অন্যান্য পেশার মেয়েরাও এখন জোটবদ্ধ হয়েছে, সংগঠিতভাবে কাজ করছে এবং প্রাপ্য মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা বুঝে নিতে শিখেছে৷ কাজেই সম্ভব, যদি সঠিক পথে এগোনো যায়৷ সম্ভব, যদি পুজোকমিটিগুলো সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের উৎসবের খরচ বাঁচিয়ে, বা বলা ভাল, অপচয় কমিয়ে নিজেদের এলাকাভিত্তিক স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়৷ তা হলেই আর আমাদের উৎসবের দিনে ওদের ভিক্ষাপাত্র সামনে নিয়ে বসতে হয় না!