1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আইএস বন্দি থেকে আইএস শিকারি

১১ আগস্ট ২০১৭

কুর্দ সাংবাদিক মাসুদ আকিল সিরিয়ায় জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের হাতে ২৮০ দিন ধরে বন্দি ছিলেন৷ জার্মানিতে পালানোর পর তিনি ইউরোপে আইএস সন্ত্রাসীদের খুঁজে বার করতে শুরু করেন৷ ডয়চে ভেলের জন্য ফ্রাংক হফমানের বিশেষ বিবরণ৷

https://p.dw.com/p/2i42t
মাসুদ আকিলছবি: DW/F. Hofmann

কিবোর্ডে আঙুল চলেছে৷ মাসুদের কম্পিউটার ইসলামিক স্টেট বা আইএস সন্ত্রাসীদের সংক্রান্ত তথ্যে ভরা৷ মাসুদ আপাতত কয়েকটি ফেসবুক প্রোফাইলের স্ক্রিনশটের খোঁজ করছেন; এক সম্ভাব্য আইএস সমর্থক ইউরোপে পৌঁছানোর পর তার উগ্রপন্থি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মাসুদকে খোলাখুলিভাবে লেখে৷ লোকটিকে মাসুদের সিরিয়া থেকে মনে আছে – কিন্তু তার ফেসবুক প্রোফাইল উধাও হয়েছে৷ তাই তাঁর নিজের স্টোর করা সেই ফেসবুক প্রোফাইলটির স্ক্রিনশটের সন্ধান করছেন মাসুদ৷

 ‘‘ওদের অনেকে গোড়ায় কিরকম খোলাখুলি কথা বলেছে, তা বিশ্বাস করা শক্ত’’, ২৪ বছর বয়সি মাসুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন৷ ২০১৬ সালের গোড়ার দিকে, মাসুদ যখন নিজে বলকান রুট ধরে জার্মানির দিকে পালাচ্ছেন, তখন তিনি হঠাৎ উপলব্ধি করেন যে, তাঁর নিপীড়নকারীরা ইউরোপেও রয়েছে – ইসলামিক স্টেট!

২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মাসুদকে সিরিয়ায় আইএস-এর ছ'টি বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছিল৷ একটি সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়ার সময় আইএস সদস্যরা মাসুদ ও তাঁর সহযোগী ফরহাদকে একটি চৌরাস্তার মোড়ে গাড়ি থেকে অপহরণ করে৷

তারিখটা ছিল ২০১৪ সালের ১৫ই ডিসেম্বর৷ বস্তুত উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার রোজাভায় এই রাস্তার মোড়টি আইএস-এর নয়, বরং কুর্দ গণ সুরক্ষা গোষ্ঠী ওয়াইপিজি-র যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল৷ আইএস-এর অবস্থিতি তখন রোজাভা থেকে অনেক দূরে৷ 

আইএস-কে কি কেউ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল?

কুর্দ টেলিভিশন সাংবাদিকরা যে ঐ চৌরাস্তা দিয়ে যাবেন, আইএস-এর কাছে সে ব্যাপারে খুব সম্ভবত আগে থেকে খবর ছিল৷ মাসুদ ও তাঁর সহযোগী ফরহাদ হামো আইএস-এর কাছে পুরোপুরি অপরিচিত ছিলেন না৷ এর আগের ২০ মাস ধরে তাঁরা তাঁদের টেলিভিশন কেন্দ্রের জন্য প্রায় প্রতিদিন রিপোর্ট ফাইল করেছেন: বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয় ছাড়া যুদ্ধের প্রগতি সম্পর্কেও রিপোর্ট দিয়েছেন তাঁরা৷

Syrien Masoud Aqil in IS-Haft
মাসুদকে সিরিয়ায় আইএস-এর ছ'টি বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছিলছবি: Privat/M. Aqil

রোজাভার কুর্দ নেতৃত্ব তখন এলাকাটিতে স্থিতি আনার কাজে ব্যস্ত – ওয়াইপিজি তখন আইএস-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈরী হিসেবে নাম করছে ও তারাই ছিল তখন সিরীয় সংঘাতে সংশ্লিষ্ট একমাত্র গোষ্ঠী, যারা বাইরে থেকে সাহায্য পাচ্ছিল, কেননা প্রতিবেশি তুরস্ক থেকে পিকেকে গোষ্ঠী তাদের মদত দিচ্ছিল৷ আজ রোজাভার ওয়াইপিজি যোদ্ধারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাস বিরোধী জোটের অঙ্গ ও তারা ইসলামিক স্টেট সম্বন্ধে যা জানে, তা অতি মূল্যবান তথ্য৷

ইসলামিক স্টেট বিশেষ করে সিরিয়ার পিছনে-পড়ে-থাকা মানুষদের সমর্থন সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে, বলেন মাসুদ: ‘‘আইএস-এর এলাকার মানুষজন প্রধানত মরু অঞ্চলে বাস করতেন, যেখানে স্কুল-কলেজ বলে কিছু ছিল না৷ সিরীয় সরকার তাদের স্রেফ উপেক্ষা করছিল৷ কাজেই এই সব মানুষ বিনা জীবিকায় সেখানে আটকা পড়ে ছিল৷ এ ধরনের মানুষ উগ্রপন্থি আদর্শে চট করে আকৃষ্ট হন৷ আইএস সেটা জানত ও সে প্রবণতার সুযোগ নিতে পেরেছিল৷’’

এই পরিস্থিতিতে তরুণ ভিডিও সাংবাদিক মাসুদ ও তাঁর সহযোগীকে জিম্মি করে আইএস, ও জিম্মিদের উপর শারীরিক নিপীড়ন চালায়৷ মাসুদ সে অত্যাচারের কথা বললেন: ‘‘ওরা আমাকে নিপীড়ন করার সময় জেরা চালিয়েছে৷ আমার পায়ে ও পিঠে আঘাত করেছে৷ ওরা আমার মুখে ঘুঁষি মেরেছে, চুল টেনেছে, কুর্দ কাফের বলে আমাকে গাল দিয়েছে – বলেছে যে, সব কুর্দকে মেরে ফেলা উচিত, আমাদের সবাইকে, কেননা আমরা এলাকাটিকে ইসলামপন্থিদের ধারণা অনুযায়ী ইসলামি হতে দিচ্ছি না৷’’

মাসুদ যখন সিরিয়ায় আইএস-এর দ্বিতীয় কারাগার আল-শাদ্দাদিতে পৌঁছান, তখন তাঁর জন্য রীতিমতো একটি অ্যাডমিশন ফর্ম ভর্তি করেন টিউনিশিয়া থেকে আসা এক আইএস সদস্য, যেন আইএস সত্যিই একটি ‘স্টেট’ বা রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে: ‘‘আইএস-এর কারাগারে আইএস-এর আইডি-র মতো,’’ বলেন মাসুদ৷

হামবড়াই

আইএস-এর সদস্যরা ভুলও করেছে: ‘‘ওরা আমার কাছে ওদের চর পাঠিয়ে ওদের সংগঠনের ক্ষমতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে'', বলেন মাসুদ৷ ‘‘ওরা আমাকে আইএস-এর ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি সম্পর্কে খবরের কাগজের প্রবন্ধ আর পশ্চিমি মিডিয়ার ভিডিও দেখিয়েছে৷ বিষয়টি নিয়ে ওরা খুব গর্বিত ছিল৷’’

হয়ত একটু বেশি গর্বিত ছিল, বলে মাসুদের ধারণা৷ শেষমেষ মৃত্যু অবধারিত, বলে ধরে নিয়ে যে সব আইএস চর মাসুদের কারাকক্ষে এসেছে, তারা খোলাখুলিভাবে তাদের করা হত্যাকাণ্ডের কথা বলেছে৷ মাসুদকে তারা এমন অনেক খুঁটিনাটি জানিয়েছে যা মাসুদ আজ অবধি ভোলেননি৷ ‘‘আমার তথ্যের একটা উৎস হলো আমি আইএস-এর কারাগারে যা শুনেছি৷ এছাড়া বিভিন্ন আইএস সদস্য ও বেসামরিক ব্যক্তি, যারা অন্যান্য আইএস যোদ্ধাদের কথা জানত৷ ২০১৫ আর ২০১৬ সালে যে সব সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও সম্ভাব্য সন্ত্রাসী জার্মানিতে পালিয়ে এসেছে, তাদের খুঁজে বার করতে এই তথ্য আমাকে সাহায্য করেছে,’’ বলে মাসুদ আজ মনে করেন৷

আইএস-এর বিভিন্ন নিপীড়ন কক্ষে মোট ২৮০ দিন কাটানোর পর মাসুদ একটি বন্দিবিনিময় কর্মসূচিতে মুক্তি পান ও সঙ্গে সঙ্গে জার্মানিতে পলায়ন করেন৷

জার্মান সরকারকে তথ্য প্রদান

কাজেই মাসুদ যখন জার্মানিতে আসেন, তখন তিনি বিশদ তথ্য সঙ্গে করে নিয়ে আসেন – সে তথ্য এমনই বিশদ যে, বিশেষজ্ঞরা মাসুদের বিবরণকে বিশেষভাবে বিশ্বাসযোগ্য বলে গণ্য করেন৷

মাসুদের অভিজ্ঞতা যেন তাঁর স্মৃতিশক্তিকে আরো প্রখর করেছে৷ বার্লিনের সাংবাদিক পেটার ক্যোফ-এর সঙ্গে যৌথভাবে একটি বই লিখেছেন মাসুদ, যা এ-মাসেই প্রকাশিত হচ্ছে৷ বইটিতে মাসুদ আকিল ব্যাখ্যা করেছেন, কেন তিনি তাঁর পরিচয় গোপন করছেন না এবং কেন তিনি আইএস-এর বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধের পন্থা বেছে নিয়েছেন: ‘‘আমি চাই না যে, এই দানবগুলো এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করুক যেখানে জার্মানিতেও জঙ্গলের আইন চালু হবে৷ কাজেই আমি যা কিছু জানি, আমার সব তথ্য জার্মান কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷’’

সেই তথ্য আজ জার্মান পুলিশকে চলতি নানা তদন্তে সাহায্য করছে৷ দৃশ্যত জার্মান দায়রা পুলিশ দপ্তর (বিকেএ) অবশেষে উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে পাওয়া হুঁশিয়ারি ও খোঁজখবরকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, অতীতে যা ঘটেনি৷ মাসুদ আকিল স্বয়ং বলেছেন যে তিনি জার্মানিতে আসার পর কেন যে তাঁকে ঠিকমতো জেরা করা হয়নি, তা তিনি আজও বুঝে উঠতে পারেননি৷

ফ্রাংক হফমান/এসি