1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গৃহশিক্ষায় বেড়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ লাখ শিশুকিশোর

৮ মার্চ ২০১০

বাচ্চারা স্কুলে যাবে না৷ বাবা-মা, পরিবারের অন্য কোনো সদস্য বা গৃহশিক্ষকের হাতেই হবে লেখাপড়ার হাতেখড়ি৷ প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায়তনকে পাশ কাটিয়ে এমন শিক্ষা ব্যবস্থার নামই ‘হোমস্কুলিং’ বা গৃহশিক্ষা৷

https://p.dw.com/p/MMn2
ফাইল ফটোছবি: Christina Bergmann

ভাষা শিক্ষা থেকে শুরু করে গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য, দর্শন কিংবা অর্থনীতি, রাজনীতির মৌলিক পাঠ পাবে নিজের ঘরে থেকেই৷ সমাজ ও বিশ্ব সম্পর্কে শিশুকিশোরদের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে নিজগৃহের একাকী নিবিড় পাঠের ওপর ভিত্তি করেই৷ জার্মানিসহ ইউরোপের কিছু দেশে তা নিষিদ্ধ হলেও অনেক দেশেই তা বৈধ৷ তবে এই শিক্ষাধারার প্রসার যুক্তরাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি৷ দেশটির প্রায় ১৫ লাখ শিশুকিশোর স্কুলে না গিয়ে বেড়ে উঠছে এমন গৃহশিক্ষার পরিবেশেই৷

যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক স্কুল ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রায় গোড়া থেকেই হোমস্কুলিং নিয়ে বিতর্কের শুরু৷ ১৮৫২ সালে ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে সবার জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষা চালুর পর এ নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন আইনপ্রণেতা, শিক্ষাবিদ, অভিভাবক এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতারা৷ দেশটির সর্বোচ্চ আদালত যে কোনো পরিবারের নিজস্ব কিংবা ধর্মীয় কারণে শিশুদেরকে নিজেদের মতো করে শিক্ষিত করার বা হোমস্কুলিং এর অধিকার সংরক্ষণ করেছে৷ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্যের সবগুলোতেই হোমস্কুলিং আইনগতভাবে বৈধ৷

১৯৮০ এর দশক থেকে হোমস্কুলিং এর আইনি বৈধতা নিয়ে বিতর্ক আর ততোটা তীব্র নয় বরং এই বিতর্কের মোড় কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে৷ এখন বিতর্ক এই নিয়ে যে, এই ধারায় শিশুদের শিক্ষা দিচ্ছে এমন পরিবারগুলো শিক্ষার জন্য সরকারি সুযোগ সুবিধা কতোটা পাবে বা পাবে না তা নিয়ে৷ বিতর্ক চালু আছে হোমস্কুলিং এর জন্য কর্তৃপক্ষ কোনো মান পাঠ্যক্রম চাপিয়ে দিতে পারে কি না এবং হোমস্কুলিং-এ বড় হওয়া ছেলে মেয়েরা পরবর্তীতে পাবলিক স্কুল কলেজে পড়ার সুযোগ কতোটা এবং কিভাবে পাবে তা নিয়ে৷ সরকারি শিক্ষার ধারায় পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে একটা মান সনদপত্র পাওয়া নিয়ে৷

তবে, এই দীর্ঘ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের হোমস্কুলিং ব্যবস্থাও অনেকটাই পাল্টেছে৷ ভার্জিনিয়ার প্যাট্রিক হেনরি কলেজের ছাত্রী ২১ বছরের কেইট পিলগ্রিম বলছিলেন, ‘‘অ্যামেরিকায় হোমস্কুলিং অনেক বদলে গেছে৷ এটা শুরু হয়েছিলে ফরাসিদের, ধর্মীয় হিপ্পিদের হাত ধরে৷ বা এমন সব পরিবারে যাদের অবস্থা খুবই অসুবিধাজনক ছিল বা যাদের বাচ্চা কাচ্চারা খুবই দুষ্টু ছিল৷ কিন্তু এখন স্বাভাবিক অনেক পরিবারের লোকজনও বলছেন, আমি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সন্তুষ্ট নই, ইত্যাদি ইত্যাদি৷''

কিন্তু, অনেক শিক্ষাবিদই এমন গৃহশিক্ষার পক্ষে নন৷ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রব রাইশ বলেন, ‘‘আমি এটাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করিনা৷ যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে হোমস্কুলিং চলছে৷ কোনো প্রকারের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো তদারকি ছাড়াই যে কার্যক্রম তারা চালাতে দিচ্ছে এটা একেবারেই ঠিক নয়৷''

রাইশ আরও বলেন, ‘‘আমি আত্মবিশ্বাসী যে দুই বা তিন বছর পরে এতে এক ধরণের হুঁশিয়ারি সৃষ্টি হবেই৷ যেসব শিশু দিনকে দিন পিছিয়ে পড়ছে তারা যখন পর্যাপ্ত শিক্ষার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠবে এবং আবিস্কার করবে যে এই সুযোগ চাওয়া তাদের জন্য পাগলের প্রলাপ মাত্র৷''

অন্যদিকে, গৃহশিক্ষা পদ্ধতির আইনগত অধিকার রক্ষা এবং একে একটি সমন্বয়ের মধ্যে আনার জন্য দেশটিতে অনেক সংগঠন জন্ম নিয়েছে৷ এমনই একটি প্রতিষ্ঠান ‘হোমস্কুল লিগ্যাল ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন'৷ এই সংগঠনের এক মুখপাত্র মাইক ডোনেলি বলেন, ‘‘আমাদের দেশে একটা ধারণা আছে যে শিশুদের জন্য তার বাবা-মাই সবচেয়ে ভাল'টা ভাবেন, করেন৷ আর তাই আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সাধারণ ভাবনাটা এমনই যে সরকারের এতে হস্তক্ষেপের কোনো প্রয়োজন নেই৷''

ডোনেলি আরও জানান, ‘‘অ্যামেরিকায় সকল প্রকার শিশু নিপীড়ন ও হয়রানি ঘটনার প্রায় ২০ শতাংশই ঘটে থাকে স্কুলশিক্ষকদের হাতে৷ এটা হল নম্বর৷ তাছাড়া আমাদের বাসিন্দারা কারা? তাদের মধ্যে আছে মেডিকেল পেশাজীবী, প্রতিবেশী, পরিবারের সদস্য৷ তাই আমাদের দেশে আসলে জ্ঞানী লোকের অভাব নেই শেখানোর জন্য৷ তাই আমি একেবারেই মনে করি না যে, প্রতি বছরই এখানে কোনো বাইরের পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন৷ দুই তিন বা চার বছর পর পর পাবিলক স্কুলগুলোর মতো করে একটা যাচাই প্রক্রিয়া থাকতে পারে৷ সেটাকে আমি অযৌক্তিক মনে করি না৷''

অনেক অভিভাবকই মনে করেন সন্তানদের শিক্ষিত করার বিষয়টি একান্তই তাদের বিষয়৷ রসায়ন শাস্ত্রবিদ ক্যাথিস মান বলেন, ‘‘আমি এটা মনে করি না কারও এসে আমাকে বলে দিতে হবে যে, তুমি তোমার বাচ্চাকে কি শেখাচ্ছো৷ কি ক্লাস নিচ্ছো, কি পড়াচ্ছো৷ সামনে এগোতে হলে তোমার বাচ্চাকে এটা এটা শেখাতে হবে৷ আমি এর পক্ষে নই যে, কাউকে এসে এসব বলে দিতে হবে৷ হ্যাঁ আমি এটা মানি যে একটা গাইডলাইন থাকতে পারে৷ একটা দিক নির্দেশনা থাকতে পারে৷''

কিন্তু অধ্যাপক রব রাইশ বলেন, ‘‘বিষয়টা যদি এমন হয় যে, কোনো ছেলে মেয়ে হাইস্কুল থেকে ঝরে পড়লো এবং তারপর বাড়িতে বসে হোমস্কুলিং শুরু করলো৷ তাহলে কি এমন ছাত্রছাত্রীদের জীববিদ্যা বা রসায়নের মতো বিষয়গুলোও পরিবারের বা এমন লোকজনরাই পড়াবেন যাদের এই বিদ্যা সম্পর্কে পড়ানোর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা নেই৷''

রাইশ আরও বলেন, ‘‘হোমস্কুলিংয়ে থাকা শিশুরা হয়তো জানতেই পারলো না যে, দুনিয়াতে আরও অনেক ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসের দৃষ্টিভঙ্গির মানুষজন রয়েছে৷ তারা যে জীবন যাপন করছে এর বাইরেও আরও অন্য জীবন রয়েছে৷ তারা যে শুধু জানবেই না তা নয়, তারা অন্য শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের সংস্পর্শে আসতে পারলো না৷ আমি এটাকে একধরণের পঙ্গুত্ব বলবো৷ এভাবে রাষ্ট্রে সুনাগরিক তৈরি হতে পারে না৷ আর স্কুল-কলেজের লেখাপড়ার অন্যতম লক্ষ্যই হচ্ছে সুনাগরিক তৈরি করা৷ আমার মনে হয় না যে কোনো নিয়ন্ত্রণহীনভাবে হোমস্কুলিংয়ে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব৷''

কিন্তু, এটা পুরোপুরি মানতে নারাজ হোমস্কুলিং অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলো৷ যেমনটা মাইক ডোনেলি বলছিলেন, ‘‘আপনারা যদি সামাজিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতার কথা বলেন তাহলে বলবো, হোমস্কুলে সুশীলভাবে শিক্ষিত অসাধারণ সব শিশু বেড়ে উঠছে৷ যারা আর সবার মতোই সমাজে অংশ নেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, অংশ নিচ্ছে৷ তারা সামরিক বাহিনীতেও যাচ্ছে, সাধারণ চাকরি বাকরি করছে, ভোট দিচ্ছে, সচেতন নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে৷ এমন নাগরিক যা আমরা প্রত্যাশা করি৷''

অ্যামেরিকায় এ নিয়ে এমন বিতর্ক চলছেই৷ ওদিকে, ইউরোপের অনেক দেশেই এটা নিষিদ্ধ না হলেও পাবলিক স্কুলিংয়ের প্রতিই মানুষের আগ্রহ বেশি৷ জার্মানি এবং গ্রিসে তা পুরোপুরি নিষিদ্ধ এবং সুইডেন, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনে তা আইনকরে নিষিদ্ধ না হলেও সাধারণভাবে তা অবৈধ৷ এছাড়া, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে, পোল্যান্ড, ইটালি ও রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশে এ বিষয়ে কোনো আইনি বাধা নেই৷

প্রতিবেদন : মুনীর উদ্দিন আহমেদ

সম্পাদনা : আব্দুল্লাহ আল-ফারূক