1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অভয়-প্রীতিকে অনুসরণ করুন!

অমৃতা পারভেজ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বর্তমানে বাংলাদেশে শহুরে বিয়ের অনুষ্ঠান যেন মানুষের মর্যাদার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বিয়েতে কে কত বেশি জমকালো আয়োজন করতে পারে, অর্থ ব্যয় করতে পারে, তার যেন প্রতিযোগিতা চলে আজকাল৷ কিন্তু এর প্রয়োজন আসলে কতটা?

https://p.dw.com/p/1K4CK
ভারতের অমৃতসরের একটি বিয়ে
ফাইল ফটোছবি: Narinder Nanu/AFP/Getty Images

মূল কথায় যাওয়ার আগে আসুন আজ থেকে এক বা দুই দশক পিছিয়ে যাই৷ ৮০ বা ৯০-এর দশকে বাংলাদেশে মুসলিম বা হিন্দু বিবাহ ছিল আজকের অনুষ্ঠান থেকে অনেকটাই ভিন্ন৷ সেসময় বিয়েতে প্রধান অতিথি হতেন আত্মীয়স্বজন, এরপর পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধব৷ নিজেদের বাড়িতেই হতো অনুষ্ঠান৷ ঢক যাঁরা ভাড়া বাসায় থাকতেন, তাঁদের বিয়ে হতো আত্মীয় বা প্রতিবেশীর বাসায়, যাঁদের ছাদ আছে বা আছে বড় উঠোন৷ মুসলিম বিয়েতে হলুদ থেকেই শুরু হতো বিয়ের অনুষ্ঠান৷ আজকের মতো উপটান দিয়ে হলুদ তখন দেয়া হতো না৷ রীতি মতো কাঁচা হলুদ বাঁটা হতো, সঙ্গে হত গীত – ‘‘হলুদ বাটো, মেহেদি বাটো...''৷ একদিকে গান চলছে, অন্যদিকে কাঁচা হলুদ ও মেহেদি পাতা বাটা হচ্ছে৷ চারপাশে হাসির ফোয়ারা, সেইসাথে আনন্দের লহর৷ আর হলুদে হতো রং খেলা৷ একে অপরকে রাঙিয়ে আনন্দ হতো দ্বিগুণ৷

এরপর ছাদে বা পাশের বড় কোনো মাঠে সামিয়ানা টাঙিয়ে বিয়ের দিন হতো প্রীতিভোজ৷ উপহার দেয়া হতো নব দম্পতির সাংসারিক জীবনে যা প্রয়োজন, তেমন আসবাব৷ কনের প্রসাধনও ছিল সাধারণ৷ হলুদে গাছ থেকে ফুল ছিড়ে তা দিয়ে সাজ৷ সাধারণ সুতি বা জামদানি শাড়ি৷ বিয়ের দিন বেনারশি শাড়ি, একটু স্নো পাউডার, চোখে কাজল৷ আত্মীয় বা প্রতিবেশীদের মধ্যে যে ভালো সাজাতে জানেন, তাঁর ওপরই পড়ত কনেকে সাজানোর ভার৷ বিয়েতে এই যে আত্মীয়-প্রতিবেশীদের সমাগম, তাঁরা কিন্তু নিজেরাই কাজ ভাগ করে নিতেন৷ এমনকি কোমরে গামছা বেঁধে তাঁরা নেমে পড়তেন খাওয়ার পরিবেশনের কাজও৷ ফলে যে পরিবারে মেয়ের বিয়ে তাঁদের ওপর চাপ অনেক কমে যেত৷ বিয়েতে অর্থ খরচের বাহুল্যো তেমন চোখে পড়ত না৷ অথচ আনন্দের কোনো কমতি ছিল না৷ প্রতিটির মেয়েরই জীবনে সাধ থাকে বিয়ের দিনটিতে তাঁকে যেন রাজরানীর মতো লাগে৷ তখনকার সেই সাজে মেয়েটি কিন্তু তৃপ্ত ছিল৷ তাঁর স্বপ্ন ভঙ্গ হতো না৷

কিন্তু গত দই দশকে বদলে গেল চিত্র৷ বাংলাদেশের শহরগুলোতে গড়ে উঠল অনেক ভবন৷ গড়ে উঠল অ্যাপার্টমেন্ট৷ আগের মতো জায়গা পাওয়া না যাওয়ায় অনেকেই বাধ্য হলো কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিতে৷ সেটা অবশ্য হতেই পারে৷ কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়৷ হিন্দি সিরিয়াল ও বলিউডের প্রভাবে অনেক উচ্চবিত্তরা শুরু করলেন নতুন এক সংস্কৃতি৷ হলদি নাইট, মেহেন্দি নাইট শুরু হয়ে গেল৷ ডিজে আনা হতে লাগলো৷ প্রচুর খরচ হতে শুরু হলো বিয়েতে৷ কে কার চেয়ে বেশি পারে৷ হিন্দু বিয়েতেও একই অবস্থা৷ আগে হিন্দু বিয়েতে হলুদ দিয়ে মেয়েকে গোসল করানো হতো৷ এখন হলুদে আলাদা অনুষ্ঠান হয়, মেহেদি পড়ানো হয়৷ আর পার্লারে যাওয়া যেন বাধ্যতামূলক৷ কেবল কনে নয়, বর এবং দুই পরিবারের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই৷ তার ওপর হলুদে হিন্দি গানের সাথে রাতভর নাচ তো আছেই৷ ডিজিটাল অগ্রগতির কারণে এই সংস্কৃতি কেবল শহরে নয়, এখন ছড়িয়ে যাচ্ছে গ্রামেও৷

প্রশ্ন হলো, এতে করে কি আনন্দের মাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে? আমার তো মনে হয় না৷ কেননা বর্তমানে আমন্ত্রিত অনেককেই হয়ত বর-কনে চেনেন না৷ তাছাড়া এত অর্থ ব্যয়ের প্রতিযোগিতায় অনেক বাবা-মা নিঃস্ব হয়ে যান৷ নিজের কন্যা বা পুত্রের মুখের দিকে চেয়ে তারা, মানে তাঁদের বুকের ধন যা দাবি করে – তাই উজার করে দিতে চান তাঁরা৷ কিন্তু এর কোনো প্রয়োজন আছে কি? নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ছোট করে চমৎকার একটি বিয়ের আয়োজন কি কারো মর্যাদা বা আভিজাত্যে আঘাত হানে? কত গরু-খাসি কাটা হলো, কত মানুষ আমন্ত্রিত হলো, বিয়ের পর সে হিসাব কে রাখে? বরং কাছের ও পছন্দের মানুষের আশীর্বাদটাই যে সবচেয়ে প্রয়োজন৷ আর বাবা-মা যদি সত্যিই ধনী হন, তবে তো জীবনের এই বিশেষ মুহূর্তটাকে আরও স্মরণীয় করে রাখা যায় আরও বড়, আরও ভালো কাজের মধ্য দিয়ে!

হ্যাঁ, ঠিক তেমনটাই করেছিলেন ভারতের অভয় দেওয়ারে এবং প্রীতি কুম্ভার দম্পতি৷ ভারতীয় বিয়ে মানেই ব্যান্ড-বাজা-বারাত, অর্থাৎ নাচ, গান, খাওয়া-দাওয়া ও সাজগোজে প্রচুর অর্থ ব্যয়৷ কিন্তু অভয় আর প্রীতি সে পথে মোটেও হাঁটেননি৷

টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এমন এক আশ্চর্যের দেশ ভারত, যেখানে প্রতি বছর মোট ১৬ লাখ কোটি টাকা ব্যয় হয় শুধু বিবাহানুষ্ঠান আয়োজনে, অন্যদিকে কৃষিপণ্যের উপযুক্ত দাম না পেয়ে অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন কৃষকরা৷ বিষয়টি আহত করেছিল অভয় ও প্রীতিকে৷ মহারাষ্ট্রের অমরাবতীর এই দুই বাসিন্দা যখন পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন বলে স্থির করেন, তখনই তাঁরা ঠিক করেন নিজেদের বিয়ের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন৷ এম‌ন এক দৃষ্টান্ত, যা দেখে এরপর বিয়ের অনুষ্ঠানে লাখ লাখ টাকা অপব্যয় করার আগে ভারতীয় বাবা-মা বা বিয়ের পাত্র-পাত্রীরা দ্বিতীয়বার ভাববেন৷

তাই তাঁরা নামমাত্র আয়োজনে বিয়ের কর্তব্য সারেন৷ নিজেদের বিয়ের খরচ বাঁচিয়ে খরচ করেন অন্যত্র৷ যেসব কৃষক পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীরা অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা করেছেন, সেরকম ১০টি পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেন অভয়-প্রীতি৷ পাশাপাশি অমরাবতীর পাঁচটি লাইব্রেরিতে মোট ৫২ হাজার টাকার বই দান করেন৷ একই সঙ্গে বিয়েতে আমন্ত্রিতদের সমজাতীয় সমাজসেবায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁরা আহ্বান করেছিন সমাজের কিছু নামকরা ব্যক্তিত্বকে৷ এঁরা এসে কিছু অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য রাখেন অতিথিদের সামনে৷

ভারতের পুনে শহরের আদিত্য তেওয়ারির বিয়েও ব্যতিক্রম৷ সফটওয়্যার প্রকৌশলী আদিত্য ভারতের প্রথম সিঙ্গেল ফাদার, অর্থাৎ অবিবাহিত বাবা৷

বিয়ের আগেই ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত দু'বছর বয়সের একটি শিশুকে দত্তক নেন আদিত্য৷ বিয়ের সময় শিশুটিকে কোলে নিয়েই বসেন বিয়ের পীড়িতে৷ কিন্তু এর চেয়েও বড় কথা হলো, তার বিয়েতে আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায় ছিলেন দশ হাজার গৃহহীন মানুষ, অনাথ আশ্রমের আশ্রিত এবং এক হাজার রাস্তায় থাকা কুকুর-বিড়াল৷ এই বিয়ের ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে খানিকটা হলেও পরিবর্তন এসেছে৷ এই শিশুদের সহায়তায় তৈরি হয়েছে একশ'টিরও বেশি ‘সাপোর্ট গ্রুপ'৷

অমৃতা পারভেজ,
অমৃতা পারভেজ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Henriksen

তৃতীয় দৃষ্টান্তটিও অন্যন্য৷ ভারতের অনেক জায়গায় এখনো আনন্দ অনুষ্ঠানে বিধবাদের যোগদান শুভ বলে মনে করা হয় না৷ কিন্তু গুজরাটের এক ব্যবসায়ী জিতেন্দ্র পাটেল অন্যরকম এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন সম্প্রতি৷ নিজের ছেলের বিয়েতে প্রায় ১৮ হাজার দরিদ্র বিধবাকে নিমন্ত্রণ জানান তিনি৷ এবং তাঁদের সবাইকে পোশাক ও কম্বল উপহার দেন৷ এমনকি যাঁরা নিতান্তই গরিব, তাঁদের অনেককে একটি করে গাভিও দান করেন জিতেন্দ্র৷

আমাদের দেশের গণমাধ্যমে এমন দৃষ্টান্ত বিরল৷ সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে তাঁরাই উঠে আসেন, যাঁদের বিয়ের আয়োজন হয় জমকালো৷ এঁদের কেউ কেউ হয়ত বিয়েতে বিশেষ বিশেষ অতিথিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন৷ কেউ আবার পাত্র বা পাত্রিকে গাড়ি বা বাড়ি উপহার দিয়েছেন বিয়েতে৷ অথবা তাঁদের বিয়ে সংবাদমাধ্যমে আসে, যাঁদের বিয়েতে লাখো মানুষের সমাগম হয়েছিল৷ তবে অভয়-প্রীতি বা আদিত্যর বিয়ের মতো এমন দৃষ্টান্ত হয়ত আমাদের দেশেও আছে৷ আর আমাদেরই দায়িত্ব তাঁদের দৃষ্টান্ত সবার সামনে তুলে ধরা৷ যাতে অন্তত শিক্ষিত উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো জমকালো বিয়ের আয়োজনের আগে একবার ভেবে দেখেন এবং নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলান৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য