1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জামায়াত নিষিদ্ধ হলে যা যা হতে পারে

৫ অক্টোবর ২০১৬

আজকের এই জামায়াতে ইসলামীর নাম জন্মলগ্নে ছিল ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’৷ তখন তারা পাকিস্তান চায়নি৷ সেই দল পাকিস্তানে একবার নিষিদ্ধ হয়৷ একাত্তরের পর বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ ছিল জামায়াত৷ জামায়াত কি আবার নিষিদ্ধ হবে?

https://p.dw.com/p/2Qsi6
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিক্ষোভ
ছবি: picture-alliance/dpa

এ বিষয়ে নানা জনের নানা অভিমত৷ বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণেও রয়েছে বিভিন্নতা৷ অবশ্য কারো কারো মুখে বা লেখায় প্রায় নিয়মিতই যে প্রশ্নটি উঠে আসে তা হলো – আওয়ামী লীগ কি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবে? এর উত্তর শুধু আওয়ামী লীগ, আরো ভালো করে বললে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনারই হয়ত জানা আছে৷

‘আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে না' – এ কথা তো বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পরেও অনেকে অনেকবার বলেছেন৷ বলার কারণও ছিল৷ ‘টালবাহানা' আর কালক্ষেপন তো কম হয়নি৷ তবে বিষয়টিকে একটু অন্যভাবেও দেখা যায়৷ এমনিতেই ট্রাইব্যুনালের দুর্বলতা যতটা চোখে পড়েছে, খুব তাড়াহুড়ো করে বিচার শুরু এবং শেষ করতে গেলে সেই দুর্বলতা হয়ত দ্বিগুণ-ত্রিগুণ হারে প্রকাশিত হতো৷

যা হোক, দেশি-বিদেশি অনেক বাধা সত্ত্বেও এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রায় শেষ পর্যায়ে৷ গণদাবি ছিল৷ কারো কারো মতে, সেই দাবির চাপেই দেরিতে হলেও বিচার শুরু করে প্রক্রিয়াটাকে এত দূর নিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগ৷ আবার কেউ কেউ মনে করেন, গণদাবি আর শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কারণেই তা সম্ভব হয়েছে৷ তবে সব কথার শেষ কথা হলো, ‘আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে না' –এই ধারণাটি পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হয়েছে৷ ‘‘আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধী ইস্যু নিয়ে শুধু রাজনীতিই করবে, কোনোদিন বিচার করবে না'' – এ কথা যাঁরা বলতেন, তাঁরা ওই প্রসঙ্গে একদম চুপ৷

এখন বলা হচ্ছে, ‘আওয়ামী লীগ জামায়াতকে কখনোই নিষিদ্ধ করবে না৷' বলার পক্ষে যুক্তি আছে৷ আবার কথাটা একশ ভাগ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলায় সামান্য ঝুঁকিও আছে৷ বলা তো যায় না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো দেরিতে হলেও আওয়ামী লীগ যদি এই কাজটাও করেই ফেলে! আওয়ামী লীগ যতদিন চায়নি, ততদিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়নি, যখন চেয়েছে তখন অনেক বাধা সত্ত্বেও বিচার প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে৷

এর ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত যথেষ্ট বেকায়দায় পড়েছে৷ এখন আরেক কদম এগিয়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিষিদ্ধও করবে কিনা, যুদ্ধাপরাধী শীর্ষ নেতাদের বিদায়ের পর জামায়াত কীভাবে ঘর সামলাবে, দলটি নিষিদ্ধ হলে কী কী হতে পারে – জামায়াত প্রসঙ্গের আলোচনায় এ সব প্রশ্নই উঠে আসছে বারবার৷

যুদ্ধাপরাধী নেতাদের বিদায়ের ক্ষতি জামায়াত নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করেই সামলাবে৷ দলটির সামনে আসলে আর কোনো বিকল্পও নেই৷ তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে মুক্তভাবে রাজনীতি করার সুযোগ পেলে হয়ত খুশিই হবে জামায়াত৷  

প্রশ্ন হলো, মুক্তভাবে রাজনীতি করার সুযোগ হারালে, অর্থাৎ জামায়াত নিষিদ্ধ হলে কী হবে? জামায়াত কি তখন আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স শুরু করে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করবে? সেই ক্ষমতা কি তাদের আছে? নাকি জামায়াতের নেতা-কর্মীরা তখন বিএনপি, সমমনা অন্যান্য দল এবং আওয়ামী লীগে ঢুকে উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করবে?

ইতিহাস বলছে, জামায়াত এই উপ-মহাদেশে ইতিমধ্যে দু'বার নিষিদ্ধ হয়েছে৷ একবার পাকিস্তানে, আরেকবার বাংলাদেশে৷ জামায়াতের রাজনীতির সূচনা হয়েছিল ১৯৪১ সালে৷ অবিভক্ত ভারতে সে বছরই ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ' নামে একটি দল প্রতিষ্ঠা করেন সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী৷ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যখন ভারত থেকে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটির উদ্ভব প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন সেই পক্রিয়ার বিরোধিতাই করেছে ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ'৷ অর্থাৎ জামায়াত তখন মুসলমানদের জন্য আলাদা কোনো দেশ চায়নি৷

কিন্তু দেশভাগের পর পাকিস্তানেই চলে যান জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী৷ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে তিনি ‘ইসলামী সংবিধান' ও ‘ইসলামী সরকার' প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারণা শুরু করেন৷ অল্প দিনের মধ্যেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ কিন্তু ১৯৪৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যু বরণ করায় হঠাৎ করেই উল্টো পথ ধরে পাকিস্তানের রাজনীতি৷ যে দেশ মওদুদীকে গ্রেপ্তার করল, ১৯৪৯ সালে সেই দেশই জামায়াতের ‘ইসলামী সংবিধানের রূপরেখা' গ্রহণ করে মওদুদীকে মুক্তিও দিয়ে দেয়৷ পাঁচ বছরের মধ্যে মওদুদীর নেতৃত্বে আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন' শুরু করে জামায়াত৷ দলটি তখন আহমদিয়াদের ‘অমুসলিম' ঘোষণা করার দাবিতে মাঠ গরম করে তোলে৷ লাহোরে বেধে যায় দাঙ্গা৷ দাঙ্গায় কমপক্ষে দু'শ জন আহমদিয়া-র প্রাণ যায়৷ সেই দাঙ্গার পর মওদুদীসহ জামায়াতের অনেক নেতা-কর্মীকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷

লাহোর কাণ্ডের জন্য তখন সামরিক আদালতে মওদুদীর ফাঁসির আদেশও হয়েছিল৷ কিন্তু সে আদেশ আর কার্যকর হয়নি৷  এক পর্যায়ে মৃত্যুদণ্ড লঘু করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, তারপর যাবজ্জীবনের দণ্ডও মওকুফ করে মুক্তি দেয়া হয় মওদুদীকে৷

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসক হিসেবে ক্ষমতায় আসেন আয়ুব খান৷ এসেই তিনি সব ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন৷ ফলে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়৷ ১৯৬৪ সালে আয়ুব সরকার মওদুদীকে আবার জেলে পাঠায়৷ সেবছরই আবার মুক্তিও দেয়া হয় তাঁকে৷

১৯৭১-এ জামায়াত শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাই করেনি, হত্যা, লুট, ধর্ষণ, ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ সব ধরনের যুদ্ধাপরাধে অংশ নিয়ে স্বাধীনতাকে ঠেকানোর সর্বাত্মক চেষ্টাই চালিয়েছে৷ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে দলটি নিষিদ্ধ হয়৷ কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফেরানোর নামে জামায়াতকেও ফিরিয়ে আনেন রাজনীতিতে৷

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত একেবারে নিরবচ্ছিন্নভাবেই ইতিহাসের আস্তাকুঁড় থেকে টেনে তুলে ‘যুদ্ধাপরাধীদের দল' জামায়াতকে আবার মূল স্রোতের রাজনৈতিক দল বানানো হয়৷ আওয়ামী লীগ সরাসরি এবং প্রবলভাবে সেই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করেনি৷ বরং অনেক ক্ষেত্রে স্ববিরোধী ভূমিকাই নিয়েছে৷

২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে প্রথম দফায় আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি৷ এবং সে কারণে ২০০১-এ ক্ষমতায় ফিরে বিএনপি যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের মন্ত্রীত্ব দিয়ে তাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ‘ইসলামি রাজনীতিবিদ' হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছে৷

তবে এত কিছুর পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে৷ এই পর্যায়ে জামায়াত যদি বাংলাদেশে আবার নিষিদ্ধ হয়? আওয়ামী লীগ যদি তাদের নিষিদ্ধ করে, তাহলে কী কী হতে পারে?

প্রথমত, কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ করার পর জামায়াত ও ‘জামায়াতবান্ধব আদর্শ'-কে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে মোকাবেলা করলে জামায়াত ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে৷ আর তা না করলে বিএনপি, সমমনা অন্যান্য দল এবং আওয়ামী লীগে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষমতাসীন এবং অন্য ক্ষমতাবানদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আবার ফিরেও আসতে পারে জামায়াত৷

উপ-মহাদেশে জামায়াতের রাজনীতি এর আগেও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে৷ অনেকবারই দেখা দিয়েছে অস্তিত্বের সংকট৷ কিন্তু মহাসংকটের সময়ে সরকার বা সামরিক বাহিনী কিংবা উভয়ের সঙ্গে সমঝোতা করে আবার ফিরেও এসেছে তারা৷

পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হওয়ার পর সেনাবাহিনী আর ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আপোষ করেই অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল জামায়াত৷ নইলে যে দেশের সামরিক আদালত জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলায়,  সেই দেশে মৃত্যুদণ্ড পেয়েও জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন লাভ করতে পারতেন না, পাকিস্তানে জামায়াতও মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো না৷

একাত্তরের পর বাংলাদেশেও তো জামায়াতের রাজনীতির ‘কবর' হওয়ারই উপক্রম হয়েছিল৷ পদে পদে আপোস করেই জামায়াত সেই পরিণতি ঠেকিয়ে রেখে এতদূর এসেছে৷ '৭৫-এর পর থেকে তারা বিএনপির কাছ থেকে যত রকমের সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, পৃথিবীর আর কোনো দেশে যুদ্ধাপরাধে জড়িত কোনো ব্যক্তি বা দল কারো কাছ থেকেই এর এক শতাংশও পায়নি৷

আশীষ চক্রবর্ত্তী
আশীষ চক্রবর্ত্তী, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Henriksen

আবার যে আওয়ামী লীগ এখন তাদের সব যুদ্ধাপরাধী নেতাকে ধরে ধরে বিচার করছে, এক সময় তাদের সঙ্গেও যুগপৎ আন্দোলনে নেমে বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুতও করেছে জামায়াত৷

সুতরাং নিষিদ্ধ হলে ইতিহাসের ধারা বজায় রেখে যে জামায়াত টিকে থাকার জন্য, ফিরে আসার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টাই করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ তবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ তাদের ‘বিশেষ ছাড়' না দিলে, নিষিদ্ধ হওয়ার পর বাংলাদেশে জামায়াত আর পূর্ণ শক্তিতে ফিরতে পারবে বলে মনে হয় না৷ যদি ফেরে তাহলে, প্রথমত আওয়ামী লীগ এবং চূড়ান্ত বিচারে বিএনপির সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা৷

এক সময় মুসলিম লীগের ঘাড়ে ভর করেছিল জামায়াত৷ বাংলাদেশে মুসলিম লীগ দৃশ্যত প্রায় নিশ্চিহ্ন৷ জামায়াত যদি নিষিদ্ধ হয় এবং নিষিদ্ধ জামায়াতকেও যদি বিএনপি আঁকড়ে ধরে রাখে, তাহলে বিএনপিরও মুসলিম লিগের দশা হতে পারে৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য