1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নীরবে মেনে নিয়েছেন বেশিরভাগ নারী

আসমা মিতা
১৪ নভেম্বর ২০১৭

‘মনে না নিলেও, মেনে নেয়া' – ঠিক কত ক্ষেত্রে যে নারীরা এভাবে ‘মেনে নেন' তা বলা সত্যি দুরূহ৷ ‘আজীবন হেঁসেল ঠেলেও কোনো মূল্য পাওয়া গেলো না' – এই ভাবনা প্রতিনিয়ত তাড়িত করে তাঁদের৷ ডয়চে ভেলেকে এমনটাই জানিয়েছেন অনেকে৷

https://p.dw.com/p/2nU6W
ছবি: picture alliance/dpa/A. Abdullah

তরুণ, পঞ্চাশোর্ধ এবং সত্তরোর্ধ – এই তিন পর্যায়ের গৃহিনীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঘর সামলাতে সামলাতে জীবনের নানা পর্যায়ে এমনও অবস্থার মুখে পড়েছেন যে, ‘সব ছেড়ে পালাতে' মন চেয়েছে তাঁদের৷ অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘সহযাত্রীর‘ সহযোগিতা পাননি তাঁরা৷ 

একইসাথে গৃহশ্রমেও যে ঘরের বাইরের সব কায়িক শ্রমের মতো কষ্ট হয় অথচ তার বিপরীতে কোনো পারিশ্রমিক মেলে না – এই ভাবনাও প্রায় সব নারীর মনে এসেছে৷ তবে তাঁদের কারও স্বামী কখনোই এই বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি বা কথা বলেননি বলেও জানিয়েছেন তাঁরা৷

প্রায় ৭৫ বছর বয়সি ফৌজিয়া বেগমের পাঁচ সন্তান৷ নাতি-নাতনিসহ বিশাল পরিবার তাঁর৷ সবাই তাঁর রান্না পছন্দ করে – এই যুক্তিতে এই বয়সেও হেঁসেলের মূল দায়িত্বে রাখা হয় তাঁকে৷ এমনকি বাজারও করতে হয়৷ ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘সবাই ভালোবাসে আমার রান্না – এটা ভাবতে ভালো লাগে৷ কিন্তু তাই বলে সারাজীবন যে কেবল আমাকেই করে যেতে হবে এটা কেমন কথা !''

কেউ বোঝার চেষ্টা করে না? জানতে চাইলে ফৌজিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘‘স্বামী বেঁচে থাকতে তিনিই তো বোঝেননি কখনও, এখন অন্যরা আর কেন বুঝবে?''

‘‘আমাদের সময়ে এমন করে খুব কম মানুষই ভাবতো৷ এমন প্রশ্নও কেউ কখনও করেনি৷ কিন্তু তারপরও মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগতো৷ মনে হতো, এগুলো কি কেবল আমারই কাজ? কিন্তু পরক্ষণেই আবার নিজের মায়ের কথা ভেবে মনে হতো, এমনটাই বোধহয় হওয়ার কথা'', যোগ করেন তিনি৷ জানান, মা-খালাদের জীবনের অভিজ্ঞাতার কথা মনে করেই তিনি সব সময় ভেবেছেন, গৃহিনীদের জীবন আসলে এমনই হয়

এরপর কথা হয় পঞ্চাশোর্ধ্ব রেনু আরার সাথে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আগে বেশি মনে হতো এ সব কথা৷ এখন অনেকটা কম মনে হয়৷ এখন আর বাইরে কাজ করার বয়স নেই বলেই হয়ত এসব কথা কম মনে হয়৷''

ফৌজিয়া বেগমের মতো একই প্রশ্ন ছিল তাঁর কাছেও৷ তিনি বলেন, ‘‘পারিশ্রমিক তো আমারও হতেই পারতো৷ আমার স্বামী তো বাইরে কাজ করে মাস গেলে ঠিকই বেতন পেতেন৷ একইভাবে আমিও তো ঘরে সারা মাস কাজ করতাম৷ কই আমি তো কখনও সেজন্য কোনো বেতন পাইনি! আমার কাজের কেন দাম থাকবে না?''

‘খাবারে লবণ কম হলে অনেক তিরস্কার শুনতে হয়েছে আমাকে’

ভীষণ হতাশা আর আক্ষেপ নিয়েই রেনু আরা বলেন, ‘‘জীবনটা ব্যর্থ মনে হয় মাঝে মাঝে৷ মনে হয়, এ কেমন জীবন!''

স্বামীর সহযোগিতা কেমন পেয়েছেন? জবাবে ডয়চে ভেলেকে রেনু আরা বলেন, ‘‘বাচ্চারা ছোট থাকতে অফিস থেকে এসে তাদের দেখাশোনা করতো৷ মাঝেমাঝে শখের রান্নাও করতো৷ কিন্তু এগুলো কখনোই রুটিনের মধ্যে ছিল না৷ চারটা বাচ্চার পরও সাথে বাসায় সব সময়ই শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বা অন্য আত্মীয়স্বজনের কেউ না কেউ প্রায় সারাবছরই থাকতো৷ আমি যেভাবে দিনের পর দিন সেগুলো সামলেছি তার বিনিময়ে, খাবারে লবণ কম হলে অনেক তিরস্কার শুনতে হয়েছে আমাকে৷ সেখানে পারিশ্রমিকের ভাবনা তো বহু দূরের কথা৷''

‘‘তবে হ্যাঁ, আমি আজও বিশ্বাস করি, আমার কাজের মূল্য থাকা উচিত ছিল৷ উপার্জন করলে মান থাকে, সেটি আমি বুঝি৷ মাস গেলে পারিশ্রমিক পাই না বলেই ঘরের কাজের কোনো দাম নেই'', বলেন রেনু আরা৷

দুই প্রজন্মের কথা শুনে ভিন্ন কিছুর আশায় ডয়চে ভেলে কথা বলে লিটা বিলকিস নামের এক তরুণীর সাথে৷ কলেজে পড়ার সময়ই বিয়ে হয় তাঁর৷ তাই তার সংসারজীবনেরও ১৫ বছর পূর্ণ হতে চলেছে৷ পরে ধীরে ধীরে পড়াশোনা শেষ করেছেন বটে, তবে ঐটুকুই৷ বাইরে আর কাজ করতে যাওয়া হয়নি৷ দুই সন্তান নিয়ে ঘরেই থেকেছেন৷ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মাঝে মাঝে নিজেকে ‘বুয়া' মনে হয়৷ মনে হয়, বুয়াও তো কাজ করে মাস গেলে বেতন পায়৷ আমি তো সেটাও পাই না৷ সেটা পেলেও তো মাঝেমধ্যে নিজের মতো করে খরচ করতে পারতাম৷ বাবা-মাকেও একটু সাহায্য করা হতো৷''

‘আমার ঘরের কাজে, বিশেষত রান্নায় সে কখনও সাহায্য করেনি’

‘‘ব্যবসায়ী স্বামীর কাছ থেকে এই ১৫ বছরে কতটুকু সহযোগিতা পেয়েছেন'' – জানতে চায় ডয়চে ভেলে৷ লিটা বলেন, ‘‘আমার পড়ালেখা শেষ করার পেছনে সে অনেক ভূমিকা রেখেছে৷ কখনও বাধা দেয়নি৷ চাকরিও করতে বলে৷এটাকেই আমি সাহায্য ধরে নিই, কী করবো তাছাড়া? কিন্তু এটাও ঠিক যে, আমার ঘরের কাজে, বিশেষত রান্নায় সে কখনও সাহায্য করেনি৷''

‘‘পড়ার সময় এমন হয়েছে যে, আমি কলেজ থেকে এসেছি, সে-ও অফিস থেকে ফিরেছে৷ তখন হয়ত ফলটা কেটে নিয়েই খেলো বা  পানিটা ঢেলে নিলো৷ মাঝে মাঝে তাঁর শখ হতো ভর্তা বানানোর৷ আমি সব এগিয়ে দিতাম আর সে বানাতো৷ এই ছিল ঘরের কাজে সাহায্য৷ আর এখন তো প্রশ্নই আসে না, কারণ, এখন সে আগের চেয়ে আরও বেশি ব্যস্ত’’, বলেন তিনি৷

লিটা আরো বলেন, ‘‘দুই ছেলে-মেয়ের কারণে দিনে চার বার করে আমার তাদের স্কুলে আনা নেয়া করতে বাইরে যেতে হয়৷ এইটুকু করলেও তো আমার কত সাহায্য হয়! মাঝে মধ্যে হাঁপিয়ে যাই৷''

তিন প্রজন্মের তিন গৃহিণীর কথায় খুব তফাৎ পাওয়া যায়নি৷ অথচ পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা৷ সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ – সিপিডি ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ২০১৬ সালে যৌথ উদ্যোগে এক গবেষণা পরিচালনা করে৷ সেখানে বলা হয়, নারীর যে কাজ মোট দেশজ আয় বা জিডিপিতে যোগ হয় না, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে সে ধরনের কাজের আনুমানিক বার্ষিক মূল্য জিডিপির প্রায় ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশের সমান ছিল৷ অর্থাৎ গৃহিণীদের কাজের মূল্য আসলে আছে, কিন্তু প্রচলিত সমাজব্যবস্থার কারণে আমাদের মা-খালা-বোন-মেয়েরা তার সুফল পাচ্ছে না৷

এই প্রতিবেদনের জন্য কথা বলা গৃহিণীদের প্রত্যেকের কথা থেকেই যে বিষয়টি বেরিয়ে আসে তা হলো, পরিবারের কর্তা বা স্বামীর কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়া৷ সে কারণেই ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পুরুষদের মন্তব্যও জানতে চাওয়া হয়৷ জানতে চাওয়া হয়, তাঁরা ঘরের কাজে কতটা অংশ নেন৷

সাংবাদিক, শিক্ষক, ব্যাংকারসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যে ২৯ জন এ প্রশ্নের জবাব দেন৷ তাঁদের মধ্যে কেবল একজন স্বীকার করেছেন যে, বাসায় কিছু সময়ের জন্য বাচ্চাকে রাখা ছাড়া আর কিছুই করেন না৷

বাকিরা মশারি টাঙানো, বাচ্চার দুধ বানানো, রাতে দরজা লাগানো, বাচ্চাকে পড়ানো, বাজার করা, রান্নায় সহযোগিতাসহ আরও কিছু কাজের কথা উল্লেখ করেছেন৷ তবে লক্ষ্যণীয় হলো, যারা এসব কথা বলেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই স্ত্রী কর্মজীবী৷ কাজেই গৃহকর্মে আপাতদৃষ্টিতে পুরুষদের অংশগ্রহণ বাড়ছে বা মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে মনে হলেও আসলে তা নয়৷ যাদের স্ত্রী ‘গৃহিণী', তাঁদের ক্ষেত্রে এখনও আগের মতোই ধরেই নেয়া হচ্ছে যে, ঘরের কাজটি করা স্ত্রীরই দায়িত্ব, স্বামী বা পরিবারের অন্য কোনো পুরুষ সদস্যের নয়৷

এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য