1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘পরিবারের সম্মান রক্ষার’ জন্য নিহত হলেন নিরুপমা পাঠক

১১ মে ২০১০

সমাজের নামে, পরিবারের নামে আরো একটি মেয়েকে বলি হতে হলো ভারতে৷ আরো একবার ভারতে নারী স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের মন্ত্রকে উপহাস বলে মনে করালো কিছু মানুষ৷

https://p.dw.com/p/NKTQ
প্রেমিক প্রিয়ভাংসু রঞ্জন-এর সঙ্গে নিরুপমা পাঠকছবি: DW

মেয়েটির নাম - নিরুপমা পাঠক৷ পেশায় সাংবাদিক৷ বয়েস মাত্র ২২৷ দেখতে-শুনতে আর পাঁচটা সাধারণ ভারতীয় মেয়ের মতোই৷ নতুন দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড' নামের একটি দৈনিক পত্রিকায় কাজ করতেন নিরুপমা৷ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, নিজের পছন্দের পুরুষটিকে বিয়ে করাই ছিল নিরুপমার স্বপ্ন৷ কিন্তু, সেটুকুও আর পূরণ হলো না৷ দেশ নয়, রাজনীতি নয়, এমনকি দারিদ্র্যও নয়, শুধুমাত্র সমাজের দোহাই দিয়ে নিরুপমার পরিবার, তাঁর নিজের বাবা-মা সন্তানের সব স্বপ্নের গলা টিপে দিলেন অনায়াসে৷

নিরুপমার বাড়ি ছিল ঝাড়খন্ডের কোডারমা জেলায়৷ সাধারণত নতুন দিল্লিতে বসবাস করলেও, ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন নিরুপমা৷ আর সেখানেই ঘটে যায় ঘটনাটা৷ ২৯শে এপ্রিল, বৃহস্পতিবার, নিরুপমার পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশকে জানানো হয়েছিল যে, তিনি আত্মহত্যা করেছেন৷ কিন্তু পরে, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আসল তথ্য৷ ঝাড়খন্ডের পুলিশ কর্মকর্তা এম এস ভাটিয়া জানান যে, আত্মহত্যা নয়, বরং শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়েছে নিরুপমাকে৷

মুখে বালিশ চেপে হত্যা৷ এ যেন এক ‘কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার'৷ কিন্তু কেন ? পুলিশের আরেকটি সূত্র জানায়, অবিবাহিত নিরুপমা প্রায় তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন৷ তাদের সন্দেহ, তাই ‘পরিবারের সম্মান রক্ষার' জন্যই নিজ পরিবারের সদস্যরাই হত্যা করেছে নিরুপমাকে৷

এরপর আর কি ? হত্যার অভিযোগে নিরুপমার মাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, তাঁর বাবা এবং ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ৷ চলছে তদন্ত৷ আর নিরুপমার হত্যাকারীর হদিশ না পাওয়া পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিতে রাজি নয় তাঁর বন্ধুরাও৷ কিন্তু, তাতে কি সত্যিই আর কিছু এসে যায় ?

দিল্লির ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব মাস কমিউনিকেশন'এ পড়ার সময় নিরুপমার সহপাঠী কলকাতার দেবারতি মুখার্জি জানান, ‘‘এ রকম আরো অনেক নিরুপমা আছে এবং সেই কারণেই আমরা এই জিনিসটাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইছি না৷ ভারতবর্ষে দেখতে গেলে উঁচু জাত, নীচু জাত এবং ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করার জন্য মহিলাদের হয় মৃত্যু, না হলে নানান রকম শাস্তি সমাজ তাদের দিয়ে এসেছে৷ এবং আমরা নিরুপমার বন্ধু হিসেবে চাই যে তার বাড়ির লোকের শাস্তি এই কারণেই হোক, যাতে এটা একটা কেস হিসেবে দাঁড় করাতে পারি আমরা সমাজের সামনে যে, এরকম জিনিস সুস্থ সমাজ সহ্য করবেন না৷''

এই ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব মাস কমিউনিকেশন'এর আরেক সহপাঠী প্রিয়ভাংসু রঞ্জন-কে ভালোবেসে ছিলেন নিরুপমা৷ বিয়ে করতে চেয়েছিলেন তাঁকে৷ কিন্তু, রঞ্জন তথাকথিত নীচু জাতের৷ আর সেখানেই ছিল সমস্যা৷ উঁচু জাতের মেয়েরা যে মরে গেলেও বিয়ে করতে পারবে না নীচু জাতের একটি ছেলেকে৷ এখনও সমাজ এমন অনুশাসনই মানে৷ স্বাভাবিকভাবেই, নিরুপমার বাবা-মাও এ কথাই বলেছিল তাঁকে৷ অথচ দেবারতি মুখার্জি'র কথায়, ‘‘নিরুপমা এবং রঞ্জনের সম্পর্কটা দেখে আমরা প্রথম থেকেই জানতাম, যে না, আর কেউ বিয়ে করুক আর না করুক ক্যাম্পাসে এই কাপলটি বিয়ে করবেই৷ আমার এখনও মনে আছে, হস্টেল থেকে বিভিন্ন সময় যখনই প্রিয়ভাংসু খাবার খেতে পারলো না, খাবার রান্না করতে পারে নি - ও যেহেতু হস্টেলে থাকতো না, অন্য জায়গায় থাকতো - হস্টেলের বাইরে খাবার নিয়ে যাওয়া অ্যালাউড ছিল না, তবু নিরুপমা বহুবার নিজের প্লেটের খাবার ওকে দিয়ে আসতো৷ তাতে দুজনের প্রতি দুজনের যে টান, সেটা আমরা কখনও ভুলতে পারবো না৷''

এরপর প্রাণের বন্ধুকে একবার মাত্র ফোন করার সময় পেয়েছিলেন নিরুপমা৷ ২৮শে এপ্রিলের সেই টেলিফোন কলটা কোনদিন ভুলতে পারবেন না রঞ্জন৷ নিরুপমা বলেছিলেন, ‘‘আমি আর তোমাকে ফোন করতে পারবো না৷ আমাকে তুমি ভুলে যাও৷'' বলেই কাঁদতে শুরু করেছিলেন নিরুপমা, জানালেন রঞ্জন৷ বললেন, ‘‘তার কান্না শুনে আমিও একটা সময় কাঁদতে থাকি৷ নিরুপমা বলে, আমার মা এবং ভাই-এর বন্ধুরা আমাকে শাসাচ্ছে৷ আর সে কথা বলতেই বলতেই, মা ঘরে এসে পড়েছে বলে ফোন ছেড়ে দেয় নিরুপমা৷''

সেখানেই শেষ৷ আর কোনদিন, কোনদিন চাইলেও প্রেমিকাকে খুঁজে পাবেন না রঞ্জন৷ কিন্তু, ২০০৮ সালের ২৯শে জুন - নিরুপমাকে প্রথম দেখার সেই দিনটির কথা স্মরণ করে রঞ্জন বললেন, ‘‘নিরুপমাকে না পেলেও, আমি সুবিচারের জন্য লড়বো৷ শেষ পর্যন্ত লড়বো৷''

প্রতিবেদন : দেবারতি গুহ

সম্পাদনা : আব্দুল্লাহ আল-ফারূক