1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

চলে গেলেন ঋতু

শীর্ষ বন্দোপাধ্যায়, কলকাতা৩০ মে ২০১৩

মাত্র ৪৯ বছর বয়সে হঠাৎই চলে গেলেন চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ৷ এই দুঃসংবাদ শোকের ছায়া নামিয়েছে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে৷

https://p.dw.com/p/18hG5
ছবি: Bollywoodhungama.com

কেউ বলছেন ইন্দ্রপতন৷ কারও কাছে এটা মহাগুরুনিপাতের সমান৷ অনেকেই বলছেন, বিনামেঘে বজ্রপাতের মতন এই দুঃসংবাদ৷ এবং প্রত্যেকেই বলছেন, অবিশ্বাস্য৷ বিশ্বাস করতে চাইছেন না কেউই যে, এত কম বয়সে, এখনও এত কিছু দিয়ে যাওয়ার ছিল যে পরিচালকের, তিনি এভাবে চলে যাবেন৷

১৯৬৩ সালে জন্ম৷ প্রথম ছবি ছোটদের জন্যে হীরের আংটি ১৯৯৪ সালে৷ পরের বছরই জাতীয় পুরস্কার পেয়ে যায় ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি উনিশে এপ্রিল৷ চমকে যান চলচ্চিত্রের দর্শকরা৷ একেবারেই হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে চিত্ত ঝলমলিয়ে ওঠার মতো একটা ঘটনা ঘটেছিল সেই সময়ে, বাংলা ছবিতে৷ তার পর একে একে মোট এক ডজন জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি৷ বাংলা থেকে সর্বভারতীয়, তার থেকে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের আসরে সমাদৃত হয়েছেন তিনি, তাঁর কাজ৷ কিন্তু তাঁর থেকেও বড় কথা, আধুনিক, সংস্কারবর্জিত, শিল্পসম্মত ও রুচিশীল এক চলচ্চিত্র-ভাষার সূচনা করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ৷ নিজগুণে এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন সমসময়ের চিত্রভাবনার৷

Rituparno Ghosh Kalkutta Filmemacher Herzinfarkt
অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, প্রত্যেক প্রজন্মের একজন মহিরূহ লাগে, ঋতুপর্ণ ছিলেন সেই মহিরূহছবি: picture-alliance/Landov

অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় যেমন বললেন, প্রত্যেক প্রজন্মের একজন মহিরূহ লাগে, যাঁর দিকে প্রচুর প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে থাকা যায়৷ যাঁর থেকে অনেক কিছু শেখা যায়, যাঁর ছায়ায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়া যায় সংকটের সময়৷ ঋতুপর্ণ ছিলেন সেই মহিরূহ৷ একই কথা বললেন অভিনেত্রী অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, যিনি সদ্য কাজ করেছেন ঋতুপর্ণ নির্দেশিত শেষ ছবি সত্যান্বেষী-তে৷ অর্পিতা জানালেন, তাঁর স্বামী, অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় একবার তাঁকে বলেছিলেন, যদি আমার কিছু হয়, বা ভবিষ্যতে কোনো বড় ধরনের সংকটে পড়তে হয়, তা হলে এই একটি লোকের কাছে নির্দ্বিধায় চলে যেও৷ ঋতুপর্ণ ঘোষ৷ তাঁর অত্যন্ত স্নেহের অভিনেত্রী রাইমা সেন মুম্বই থেকে বললেন, একটা কথাই তাঁর বারবার মনে পড়ছে৷ ঋতুপর্ণ তাঁকে মজা করে বলতেন, ‘‘আমি যদি মারা যাই, তা হলে কে তোকে অভিনয় শেখাবে?''

ভূতের ভবিষ্যৎ ছবির পরিচালক অনীক দত্ত অকপটে স্বীকার করলেন, বর্তমান বাংলা ছবির অনেক পরিচালক ছবি করার প্রাথমিক সাহস পেয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি দেখে৷ তাঁর নান্দনিক বোধ, তাঁর রুচিশীল, মার্জিত উপস্থাপনা, সবকিছু চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থীদের অনুসরণ করার যোগ্য৷ প্রায় একই কথা বললেন মুম্বইয়ের পরিচালক অনুরাগ বসু যে, অনেক কিছু শেখার ছিল পরিচালক, এমনকি অভিনেতা ঋতুপর্ণের থেকেও৷ অনুরাগের আফশোস, দু'জনে দুই শহরে থাকতেন বলে আরও বেশি মত বিনিময়ের সুযোগ তিনি পাননি৷ আর একটি প্রেমের গল্প-এর পরিচালক, এ বছরের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৌশিক গাঙ্গুলি জানালেন, অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘোষকে নিয়ে কাজ করার সময় প্রতিটি দৃশ্যে তিনি কীভাবে শিক্ষিত হয়েছেন, সমৃদ্ধ হয়েছেন৷

[No title]

বিজ্ঞাপন জগতে ঋতুপর্ণ ঘোষের সমসাময়িক এখনকার তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন৷ যদিও দু'জনে দুটি আলাদা সংস্থায় কাজ করতেন৷ কিন্তু একসময়ের সাড়া জাগানো বিজ্ঞাপনী প্রচার শারদ সম্মান-এর বয়ান তৈরিতে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল৷ ডেরেক জানালেন, তাঁদের ক্রিয়েটিভ টিম সেই বিজ্ঞাপনের প্রথম কপিটা ইংরেজিতেই লিখেছিলেন৷ তারপর সেটা বাংলায় অনুবাদের ভার দেওয়া হয়েছিল ঋতুপর্ণের হাতে৷ কিন্তু ঋতুপর্ণ ডেরেক-কে বলেছিলেন, ‘‘ট্রান্সলেশন নয়, এটা আমি ট্রান্সক্রিয়েট করবো৷''

বস্তুত ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর গোটা সৃজন-জীবন ধরেই এই রূপান্তরের কাজটাই খুব দক্ষ হাতে করে গিয়েছেন৷ পরিচিত কোনো গল্প থেকেও যদি ছবি বানিয়েছেন, তা হয়ে উঠেছে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল এক ট্রান্সক্রিয়েশন৷ ঋতুপর্ণ পরিচালিত প্রথম ছবি, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে হীরের আংটি-ই তার প্রথম উদাহরণ৷ চলচ্চিত্র হিসেবে হীরের আংটি জনপ্রিয় হতে পেরেছে, মূল গল্পের মেজাজ এবং দক্ষ কাহিনিকার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের নিজস্বতা, অর্থাৎ গল্প বলার সহজিয়া কায়দা, তাকে সম্পূর্ণ অটুট রেখেই৷ আবার সেই ঋতুপর্ণ ঘোষেরই মুক্তিপ্রাপ্ত শেষ ছবি চিত্রাঙ্গদা-তে এক অসম্ভব জটিল থিম, আমাদের অপরিচিত এক মনোজগত থেকে উৎসারিত লিঙ্গান্তরকামিতার কথা বললেন পরিচালক, দারুণ সাহস এবং সংবেদনশীলতার সঙ্গে, যা একইরকম সহজে ছুঁয়ে গিয়েছে বৃহত্তর নাগরিক সমাজকে৷

নাট্যকার এবং বর্তমানে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু ঋতুপর্ণ ঘোষের একেবারে অনন্য সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথাই তুলে ধরলেন তাঁর প্রতিক্রিয়ায়৷ ব্রাত্য বললেন, নিজের জীবনচর্যায় এবং নিজের চলচ্চিত্রেও নিজের লিঙ্গ-বিশ্বাসের কথা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে বলে গিয়েছেন ঋতুপর্ণ৷ নিজের বিশ্বাসের পাশে এভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে খুব কম মানুষ পারেন৷

ঋতুপর্ণের একসময়ের সহকর্মী, সাংবাদিক-সঙ্গীতকার চন্দ্রিল ভট্টাচার্য সবথেকে দামি কথাটা বললেন – আজকাল তো চলচ্চিত্র বিনোদন-সর্বস্ব হয়ে উঠেছে, সেখানে ঋতুপর্ণ ঘোষ এমন একজন পরিচালক ছিলেন, যিনি বলতেন, হ্যাঁ, বিনোদনটা জরুরি, কিন্তু তার সঙ্গে শিক্ষা, রুচিবোধ এগুলোও জরুরি৷ রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হবে, মহাভারতটাও পড়া থাকলে ভাল হয়৷ এই শিক্ষা, এই রুচির অভাব আজ সর্বত্র৷ সেখানে ঋতুপর্ণ ছিলেন স্বকীয়তায় উজ্জ্বল৷

ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্ভবত বুধবার গভীর রাতে, ঘুমের মধ্যেই মারা যান৷ বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর বাড়ির পরিচারক তাঁকে ডাকতে গিয়ে বুঝতে পারেন দেহে প্রাণের স্পন্দন নেই৷ তার পর থেকেই ঋতুপর্ণের বাড়ির সামনে অনুরাগীদের ঢল নামে৷ চলে যান রাজনৈতিক নেতারাও৷ কিছুক্ষণ পর পৌছে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বাড়ির লোক এবং চলচ্চিত্র জগতের বিশিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, দুপুর থেকে সন্ধে প্রয়াত পরিচালকের মরদেহ রাখা হবে নন্দন চত্বরে, সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য৷ সেখান থেকে টালিগঞ্জ টেকনিশিয়ান্স স্টুডিও ঘুরে তাঁর শেষকৃত্য হবে সিরিটি শ্মশানে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য