1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভোটে ভয় কেন শাসকের?

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা১ জুলাই ২০১৩

পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে শুরু থেকেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কাজিয়ায় ব্যস্ত সরকার৷ সঙ্গত কারণেই সুপ্রিম কোর্ট জানতে চাইল, সরকার ভোট করতে চায় তো?

https://p.dw.com/p/18yUO
ছবি: Fotolia/opicobello

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় নাগাদ ঘোষণা করেছিল, বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষা এবং তারপর পঞ্চায়েত ভোট থাকার কারণে রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন ছ'মাস বন্ধ থাকবে৷ এমন নির্দেশ রাজ্যে এই প্রথম৷ বোর্ডের পরীক্ষা বছর বছরই হয়৷ তার জন্য কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন বন্ধ রাখার দরকার কখনও পড়েনি৷ তবুও এবার তা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তার কারণ এবার বিভিন্ন কলেজের নির্বাচনে নাকি ব্যাপক হাঙ্গামা, গন্ডগোলের আশঙ্কা করছিল রাজ্য প্রশাসন৷ গত কয়েক বছরে কলেজে কলেজে যে বামবিরোধী প্রবণতা ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নজরে পড়েছিল, তৃণমূল সরকারের সুশাসনের নমুনা গত দু'বছরে কিঞ্চিত পাওয়ার পর সেই প্রবণতা নাকি ফের উল্টো খাতে বইতে শুরু করেছে৷ যে কারণে পঞ্চায়েত ভোট অবধি কলেজ নির্বাচন মুলতবি রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল৷

কিন্তু তার পর পঞ্চায়েত ভোটই চেষ্টাকৃত এক অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে গেল৷ চেষ্টাকৃত, কারণ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রাজ্য সরকারের লাগাতার মতবিরোধ, পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মন্তব্য, ক্রমাগত যুক্তি-তর্কের চাপান-উতোর এবং শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই দেখে মূল বিষয়টা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছিল যে, রাজ্য সরকার কি আদৌ পঞ্চায়েত ভোট নির্দিষ্ট সময়ে করতে চায়! ভারতের সর্বোচ্চ আদালত নির্ভুলভাবে ঠিক সেই প্রশ্নটাই রাজ্য সরকারের আইনজীবীর কাছে রেখেছে৷ কারণ সুপ্রিম কোর্টের নিশ্চিতভাবেই নজর এড়ায়নি যে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক অধিকার ও এক্তিয়ারের প্রশ্ন তুলে, সেই নিয়ে আইনি বিবাদে সময় খরচ করে কীভাবে পঞ্চায়েত ভোটের গোটা প্রক্রিয়াকেই পিছনে ঠেলে দেওয়া হল৷

নয়ত স্বাধীন ভারতে সমস্ত নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে৷ এ ব্যাপারে কমিশনের আইনি অধিকার নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে সংবিধানে, যা নিয়ে কেন্দ্র বা রাজ্য, কোনও সরকারেরই বিরোধিতা বা বিতর্ক তোলার কোনও কারণ ঘটেনি৷ প্রথম একজন নির্বাচন কমিশনারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল ভারতের বামপন্থীরা এবং সব রাজনৈতিক ব্যাপারেই বামেদের থেকে শিক্ষা নেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তার পর থেকে নির্বাচনে তাঁর দলের হার হলেই রিগিংয়ের পাশাপাশি দোষ দিতেন বিপক্ষ দলের হাতে ‘‘পারচেজড'' হয়ে যাওয়া নির্বাচন কমিশনকে৷ এবার পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কাজিয়া শুরু হতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্ভুলভাবে নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের বিরুদ্ধে সিপিএম তথা বামপন্থীদের পক্ষ নিয়ে কাজ করার অভিযোগ তুলেছেন৷ যদিও এই “পক্ষপাতদুষ্ট” নির্বাচন কমিশনারকেই কলকাতা পুরসভার শেষ নির্বাচনে তৃণমূল জেতার পর, সাহসিকতা ও নিরপেক্ষতার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷

আর এসবের পাশাপাশি রয়েছে মনোনয়ন দাখিলের সময় হাজারো বেনিয়ম থেকে শুরু করে বিরোধী প্রার্থীদের ভয় দেখানো, বহু পঞ্চায়েত আসনে প্রার্থী দাঁড়াতে না দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূল প্রার্থীর জিতে যাওয়ার মতো পরিচিত দুর্নীতি, যা গত বাম আমলে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল৷ সেই নৈরাজ্য থেকে পরিত্রাণের আশাতেই লোকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর তাঁর দলকে ভোটে জিতিয়ে সরকারে বসিয়েছিল৷ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, যে ৩৪ বছরের অপশাসনের অবসান ঘটার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে, বাস্তবে তার কোনও প্রতিফলন নেই৷ বরং সেই একই স্বেচ্ছাচারিতার জুতোয় পা গলিয়েছেন মমতা, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর মার্কামারা অধৈর্য স্বভাব এবং সমালোচনা নিতে না পারার মনোভাব৷

ফলে সমালোচনার স্বর শুনলেই মুখ্যমন্ত্রী বদনাম দিচ্ছেন মাওবাদী বলে, তাঁর সরকারের সমস্ত ব্যর্থতার পিছনে তিনি ষড়যন্ত্র দেখছেন, দু'বছরেই প্রায় সমস্ত সংবাদমাধ্যম তাঁর শত্রু হয়ে গিয়েছে কারণ তারা তাঁর কাজের সমালোচনা করছে৷ এদিকে রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে তাঁদের কোণঠাসা করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ অন্যদিকে সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়া থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত যে কটা বিষয়ে আদালতে গিয়েছে রাজ্য সরকার, সবকটা মামলায় হার হয়েছে৷ ১০০ দিনের কাজ থেকে শুরু করে নতুন কর্মসংস্থান, শিল্পায়ন থেকে শুরু করে আইন শৃঙ্খলা, প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারি সাফল্যের তথ্য-পরিসংখ্যান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে৷

এর সঙ্গে, গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো আছে সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি, যার কোপ সবথেকে বেশি পড়েছে গ্রামের মানুষের সঞ্চয়ে৷ সরকার যতই দাবি করুক যে চিটফান্ড কোম্পানিগুলোর সাম্প্রতিক রমরমার পিছনে তাদের কোনও হাত ছিল না, কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর ডাকঘর, গ্রামীণ সমবায় ব্যাঙ্ক এবং স্বল্প সঞ্চয়ের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে টাকা জমার পরিমাণ ক্রমশ কমেছে৷ অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমের ছবিতে চিটফান্ডগুলোর মালিক আর শাসকদলের নেতা-সাংসদদের ঘনিষ্ঠতা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত সত্য৷

এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার পঞ্চায়েত ভোট যত পিছিয়ে দিতে পারে, ততই তাদের মঙ্গল৷ কিন্তু সময় যত যাচ্ছে, কেলেঙ্কারির সংখ্যাও বাড়ছে৷ কামদুনি এবং তার আগে পরে বারাসতের একাধিক নিগ্রহ ও ধর্ষণের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, শহরের রাস্তায় নীল-সাদা রঙ বা ত্রিফলা আলোর সজ্জাবাহুল্য নয়, দরকার ছিল অন্ধকার রাস্তাঘাটে আলো দেওয়া, যাতে মহিলারা নিরাপদে যাতায়াত করতে পারেন৷ উচ্চবিত্তদের জন্য তৈরি প্রাইভেট কলেজকে ছাড়পত্র দেওয়া নয়, দরকার ছিল আরও বেশি সরকারি স্কুল-কলেজের, যাতে ছেলে-মেয়েদের দূর দূর পড়তে না যেতে হয়৷ সরকারি অর্থে অকারণে মা-মাটি-মানুষের নামে নানাবিধ উৎসব নয়, দরকার ছিল সামগ্রিক উন্নয়ন এবং তার জন্য সুসংহত পরিকল্পনার৷

Mamata Banerjee, Ministerpräsidentin des indischen Bundesstaates West Bengal
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (মাঝে)ছবি: DW

কেন্দ্র বাড়তি অর্থ সাহায্য বা আর্থিক সুবিধা পশ্চিমবঙ্গকে দিচ্ছে না, এটা যেমন সত্যি কথা, তেমন এটাও সত্যি যে দু'বছরে এমন কোনও কর্মসূচি বা প্রকল্প তৃণমূল সরকার সামনে রাখতে পারেনি, যার জন্য দলমত নির্বিশেষে জনমত গড়ে তোলা যায়৷ ফলে নির্বাচনকে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্রমশই আরো ভয় পেতে শুরু করবেন, সেটাই স্বাভাবিক৷ তবু এখনও বহু মানুষ মনে করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও কিছুদিন সুযোগ পাওয়া উচিত৷ এখনই তাঁর ব্যাপারে রায় ঘোষণা করার সময় আসেনি৷ কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে সেই জনমতের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না, এটা আরও দূর্ভাগ্যজনক৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য