1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মানবদরদি রুশ লেখক টলস্টয়ের মৃত্যুশতবর্ষ

১৬ নভেম্বর ২০১০

বিখ্যাত রুশ লেখক লেভ নিকোলাইয়েভিচ টলস্টয়'এর মৃত্যু শতবার্ষিকী ২০ নভেম্বর৷ তাই জার্মানিতে আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠানের৷

https://p.dw.com/p/QA95
লেভ নিকোলাইয়েভিচ টলস্টয়ছবি: Staatliches L.N. Tolstoj Museum, Moskau

মিউনিখের সাহিত্যভবন লেখকের জীবন ও জার্মানির সঙ্গে তাঁর বিশেষ বন্ধনের কথা তুলে ধরছে এক প্রদর্শনীতে৷

টলস্টয়ের জীবন

অসাধারণ প্রতিভাশালী লেখক লেভ টলস্টয় ছিলেন সাহিত্য জগতের এক অপার বিস্ময়৷ দেশ, কাল, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের মানুষকে জয় করেছেন তিনি শুধু লেখালেখি দিয়ে নয়, ভালবাসা দিয়েও৷ জন্ম তাঁর ১৮২৮ সালের ২৮ আগস্ট রাশিয়ার তুলা প্রদেশের ইয়াস্নায়া পলিয়ানা নামের এক অঞ্চলে, এক অভিজাত পরিবারে৷ ছোটবেলাতেই হারান মা বাবা৷ এক আত্মীয়ের কাছে বড় হয়ে ওঠেন তিনি৷ স্কুল কলেজের ধরাবাধা গণ্ডি তেমন ভাল লাগতো না মেধাবী টলস্টয়ের৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়শোনা শুরু করেন প্রাচ্য ভাষা নিয়ে৷ পরে ভর্তি হন আইন বিভাগে৷ শেষ পর্যন্ত ক্ষান্ত দেন পড়াশোনায়৷ নিজের পরিশ্রম ও চেষ্টায় শিখেছেন বহু ভাষা: ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান, গ্রিক, হিব্রু ইত্যাদি৷ সংগীত ও চিত্রাঙ্কনেও আগ্রহ ছিল তাঁর৷ তবে বারবারই ফিরে এসেছেন লেখালেখির জগতে৷ বিষয় সম্পত্তির মোহ ছিল না তাঁর৷ ধর্মে বিশ্বাস থাকলেও গির্জা ও যাজকদের সমালোচনা করতে ছাড়েননি৷ ফলে খ্রিষ্ট ধর্ম থেকে বহিষ্কৃত হতে হয় তাঁকে৷ জারতন্ত্রের সমালোচনায় মুখর ছিলেন৷ সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছেন তিনি৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, খুলেছেন স্কুল৷ সুবিচারের আকাঙ্খা ছিল তীব্র৷ বিচারের নামে প্রহসন ছিল তাঁর কাছে অসহ্য৷ সমাজের উঁচুতলা থেকে নীচুতলার মানুষদের মধ্যে ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ৷ আর এইসব মানুষের চিত্রই ফুটে উঠেছে টলস্টয়ের উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ও গল্পে৷ তাঁর উপন্যাস ওয়ার অ্যান্ড পিস, আনা কারেনিনা'র খ্যাতি বিশ্বজোড়া৷ বড়গল্প ইভান ইলিচের মৃত্যু, ফাদার সিয়ের্গি; একাধিক নাটক এবং আরো অসংখ্য অমর সাহিত্যকর্মের স্রষ্টা লেভ টলস্টয়৷

NEU NEU Tolstoj und Deutschland Ein Licht mir aufgegangen Ausstellung in Literaturhaus München Die Ausstellung Flash-Galerie
জার্মানির সঙ্গে টলস্টয়'এর বন্ধন নিয়ে প্রদর্শনী

জার্মানির সঙ্গে বন্ধন

জার্মানি ও জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে যেন ছিল তাঁর আত্মিক যোগ৷ তাই তো ১৮৬১ সালে জার্মান ইহুদি লেখক বের্টল্ড আওয়ারবাখের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বলে উঠেছিলেন টলস্টয় জার্মান ভাষায় ‘‘আমার মধ্যে যেন আলো জ্বলে উঠলো৷'' জার্মান ভাষাটা ভালই জানা ছিল টলস্টয়ের৷ জার্মান ভাষায় লেখা বহু পান্ডুলিপিও রয়েছে তাঁর৷ জার্মানি ভ্রমণের দিনলিপি, জার্মান পাঠকদের সঙ্গে পত্রের আদান প্রদান এবং মূল্যবান অন্যান্য দলিলপত্র দেখা যাবে মিউনিখের সাহিত্যভবনে আয়োজিত এক প্রদর্শনীতে৷ এতে বোঝা যায়, টলস্টয় কতটা ভালভাবে জার্মানিকে চিনতেন জানতেন৷ মস্কোর টলস্টয় মিউজিয়ামের টলস্টয়ের পাণ্ডুলিপি বিশেষজ্ঞ স্তেভলানা নভিকোভা বলেন, ‘‘তিনি জার্মানিকে ভালবাসতেন, ভালবাসতেন জার্মান সংগীত, বেটোফেন, বাখ ও দার্শনিকদের৷ পছন্দ করতেন জার্মান লেখকদের লেখাও, যা জার্মান ভাষাতেই পড়তে পারতেন তিনি৷''

ফ্রিডরিশ রোয়সেল নামে এক জার্মান গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে শেখেন তিনি জার্মান ভাষা৷ মিউনিখ শহরের সাহিত্যভবনের পরিচালক ডোরিং স্মিরনোভ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘সাধারণ দলত্যাগ করা এক জার্মানসেনা ছিলেন রোয়সেল৷ পেশায় চর্মকার৷ কিন্তু তাঁর এমন এক গুণ ছিল, যা থেকে টলস্টয় শিক্ষা নিতে পেরেছিলেন৷ আর তা হল, সমবেদনা এবং সহানুভূতি৷''

সুবিচারের আকাঙ্খাটা জেগে উঠেছিল আরেক জার্মান অধ্যাপক মায়ারের কাছ থেকে৷ আইনবিদ মায়ার ১৭ বছরের টলস্টয়কে রাশিয়ার তৎকালীন জার ক্যাথারিন দ্য গ্রেটের সঙ্গে ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক জাগরণের পুরোধা দার্শনিক মতেসকিউ'এর তুলনা করে লিখতে বলেন৷

ডোরিং স্মিরনোভ বলেন, ‘‘টলস্টয়ের মনে তা এতই দাগ কাটে যে, তিনি জারতন্ত্রকে সমালোচনার চোখে দেখতে শুরু করেন৷ বিশেষ করে খেটে খাওয়া কৃষকদের প্রতি সামাজিক দায়িত্ববোধ জেগে ওঠে তাঁর মনে৷''

জার্মানির সঙ্গে তাঁর বন্ধনটা আরো দৃঢ় হয় ১৮৬২ সালে জার্মান বংশোদ্ভূত রুশ সোফিয়া আন্ড্রেইভনাকে বিয়ে করার পর৷ ১৩ সন্তানের জনক জননী তাঁরা৷ দাম্পত্য জীবনের প্রথম দিকটা সুখের হলেও পরে অশান্তি দেখা দেয়৷ স্বামীর সবকিছু ছেড়েছুড়ে সাধারণ সাধু সন্ন্যাসীর মত জীবনযাপন করাটা মোটেও মনঃপূত ছিলনা সোফিয়ার৷

মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে পত্রবন্ধুত্ব

ভারতের সঙ্গেও এক গভীর বন্ধন ছিল তাঁর৷ ভারতীয় ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর নিজের জীবনদর্শনের মিল খুঁজে পেতেন তিনি৷ ঔপনিবেশিক শাসনামলে স্বাধীনতাকামী অনেক ভারতীয় নেতার সঙ্গে গড়ে ওঠে তাঁর যোগাযোগ, পত্রবন্ধুত্ব৷ এর মধ্যে অন্যতম মহাত্মা গান্ধী৷ এই দুই মহাপুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনযাপনের পদ্ধতির মধ্যে ছিল অদ্ভুত এক সাযুজ্য৷ দুজনেই বলেছেন সবার ওপরে মানবধর্মের কথা৷ বেছে নিয়েছিলেন সাধু সন্ন্যাসীর জীবন৷ নিজের কাজ নিজেই করতেন তাঁরা৷ খাওয়াদাওয়াও ছিল অতি সামান্য৷ ১৯০৯ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত অসংখ্য চিঠি চালাচালি হয়েছে এই দুই মহান ব্যক্তির মধ্যে, যেগুলো পরে এক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়৷ দক্ষিণ আফ্রিকায় গড়ে তোলেন গান্ধী ‘টলস্টয় ফার্ম'৷

সুনামের শীর্ষে পৌঁছেও পারিবারিক অশান্তিটা কুরে কুরে খাচ্ছিল টলস্টয়কে৷ একদিন কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে চলে যান তিনি৷ এই ধাক্কা আর সামলানো সম্ভব হয়নি৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক রেলস্টেশনে ১৯১০ সালের ২০ নভেম্বর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান মহিরুহ এই লেখক৷

প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক