1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সয়াবিন উৎপাদনে জিন প্রযুক্তির প্রয়োগ ও তার ভয়াবহ ফলাফল

১৭ আগস্ট ২০১০

বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম সয়াবিন রপ্তানিকারক দেশ প্যারাগুয়ে৷ পশুখাদ্য ও জৈব জ্বালানিশক্তির উপাদান হিসাবে বেশ লাভজনক এক কৃষিপণ্য সয়াবিন৷ কিন্তু যে ভাবে এই ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে, তা পরিবেশ ও জনসাধারণের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক৷

https://p.dw.com/p/OpAo
ছবি: Steffen Leidel

প্যারাগুয়ের এক গ্রামের দৃশ্য : কৃষানি লুসিয়া পাভোন কাঠের উনুনে দুপুরের খাবার তৈরি করছেন৷ অন্যান্য ক্ষুদ্র চাষি পরিবারের মত লুসিয়ার পরিবারও পাশের জমিতে কিছু ফসল উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করেন৷ কয়েকটি গরু, শুয়োর ও মুরগি চড়ে বেড়াচ্ছে লুসিয়ার কৃষিখামারে৷ বাহ্যিক দিক দিয়ে দৃশ্যটি মনোরম মনে হলেও, আদতে কিন্ত খুব একটা শান্তিতে নেই এই সব চাষি পরিবার৷ মাত্র কয়েকশ মিটার দূরে বিশাল সয়াবিন খেতে বিষাক্ত কীটনাশক পেস্টিসাইড দিয়ে স্প্রে করা হচ্ছে৷ ব্রাজিলের বড় বড় সয়াবিন চাষিরা এই সব জমির মালিক৷ লুসিয়া উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘তারা পেস্টিসাইড স্প্রে করার সময় কোনো কিছুই বিবেচনা করেনা৷ এই সব বিষাক্ত পদার্থ যে বাতাসের সাথে চলে গিয়ে অন্যদেরও ক্ষতি করতে পারে সেদিকে তাদের লক্ষ্য নেই৷ খুব শিগগিরই হয়তো মারা যাব, এই ভয় হয় আমাদের৷ এই বিষাক্ত পদার্থ আমাদের ফসল ও খাবারের সাথে মিশে যায়৷ যা খেয়ে আমাদের পেটব্যথা, মাথাব্যথা ও ডায়রিয়া হয়৷ কিছুদিন আগে এক সাথে আমাদের ৩০টি মুরগিই মারা গেল৷ প্রতিবেশীদেরও একই অবস্থা৷ সত্যি ভয়ানক এক পরিস্থিতি৷''

১৯৯০ সালের শেষ দিকে জিন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে সয়াবিন উৎপাদন শুরু হওয়ার সাথে সাথে পেস্টিসাইডের ব্যবহারও বাড়তে থাকে৷ বড় বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলি নিজেদের প্রস্তুত করা কীটনাশক প্রয়োগ করে সয়াবিন উৎপাদন বাড়িয়ে তোলে৷ এই সব কীটনাশকের সংস্পর্শে সাধারণ উদ্ভিদ গোড়াতেই মরে যায়৷ অন্যদিকে, জিনপ্রযুক্তিজাত সয়াবিনের চাড়া দিব্যি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে৷ এই কীটনাশক যে গ্রামবাসীদের জন্যও খুব বিপজ্জনক, তা জানা গেছে বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার এক সমীক্ষায়৷ প্যারাগুয়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রণায়ের গ্রাসিয়েলা গামারা এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘বিশেষ করে দীর্ঘদিন পর এর ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়৷ বহু দিন ধরে এই কীটনাশকের সংস্পর্শে থাকলে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বেড়ে যায়৷ বিকলাঙ্গ বাচ্চার জন্ম হয় ও অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়৷''

প্রতিবছরই হাজার হাজার মানুষ এই ধরনের অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে অনেকে৷ কিন্তু প্যারাগুয়েতে এই সব কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে তেমন মাথা ঘামানো হচ্ছেনা৷ গ্রামের মানুষদের এ ব্যাপারে সজাগ করতে কিংবা এই অবস্থার কোনো সুরাহা করতে রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছাও লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা৷ পশুখাদ্য ও জৈবজ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে সয়াবিনের দামও হু হু করে বাড়ছে৷ বৃদ্ধি পাচ্ছে সয়াবিনের চাষও৷ প্রতি হেক্টর জমিতে সাড়ে তিন টন সয়াবিন উৎপাদন করা যায়, যা থেকে ৯০০ ডলার লাভ আসতে পারে৷ প্যারাগুয়ে এখন বছরে ৬ মিলিয়ন টন পর্যন্ত সয়াবিন উৎপাদন করা হয়৷ প্যারাগুয়ের সয়া উৎপাদক সমিতির পরিচালক হেক্টর ক্রিস্টাল্ডো বলেন, ‘‘আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে গুরুত্বপূর্ণ এক যোগসূত্র সয়াবিন৷ আমাদের কৃষিখেতে যদি শুধু নিজেদের খাবারের জন্যই ফসল উৎপাদন করি, ক্ষুধার্থ মানুষদের মুখে যদি কোনো খাবার তুলে দিতে না পারি, তাহলে তো উৎপাদনের কোনো অর্থই হয়না৷'' কিন্তু সয়াবিনের এই প্রাবল্য যে ক্ষুদ্র চাষিদের বিতাড়িত করছে, ঠেলে দিচ্ছে নানা অসুখ বিসুখের মুখে, তা ভেবে দেখেননি সয়াবিন বাজারের এই লবিস্ট হেক্টর ক্রিস্টাল্ডো৷ তাঁর মতে শুধুই নিজেদের প্রয়োজনে চাষাবাদ করাটা, বড়ই পশ্চাৎমুখী, যা থেকে দারিদ্র দূর হতে পারেনা৷ সয়াবিনের এই প্রাবল্য থেকে শুধু কিছু ব্যক্তিই লাভবান হচ্ছেন৷ আর লাভ হচ্ছে পশ্চিমি দেশগুলির, যারা প্যারাগুয়ে থেকে সস্তায় সয়াবিন আমদানি করে থাকে৷

ইতোমধ্যে প্যারাগুয়ের ক্ষুদ্র চাষিরা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন৷ শুরু করেছেন অসহযোগ আন্দোলন৷ কৃষানি লুসিয়া পাভোন তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলে পেস্টিসাইড স্প্রে করার ট্র্যাক্টরগুলি আটকে রাখছেন৷ গ্রামবাসীদের অধিকাংশই অংশ নিয়েছেন এই আন্দোলনে৷ লুসিয়া পাভোন বলেন, ‘‘বিষাক্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা সর্ব শক্তি দিয়ে লড়াই করে যাব৷ আমাদের দাবি এই বিষাক্ত পদার্থের স্প্রের অবসান হোক৷ আমাদের জীবজন্তু, বাচ্চা বৃদ্ধরা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন৷ আমরা যেন জীবন মৃত্যুর মাঝে ভাসমান৷''

অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র চাষিরাও এগিয়ে আসছেন এই আন্দোলনে যোগ দিতে৷ সয়াবিনের আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীচক্র ও তাদের চাষাবাদ পদ্ধতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তারা বদ্ধপরিকর৷ নিজেদের জীবন বাঁচাতে, পরিবেশকে বাঁচাতে জাগিয়ে তুলতে চান তারা সবাইকে৷ গেয়ে ওঠেন জাগরণের গান৷

প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম

সম্পাদনা: দেবারতি গুহ