1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নারীরা যখন খাপ পঞ্চায়েতের হাতে

অনিল চট্টোপাধ্যায় নতুন দিল্লি
১২ মে ২০১৮

কথাটা সত্য৷ এক বা একাধিক গ্রামের মুরুব্বি বা মোড়লদের নিয়ে গঠিত এই খাপ পঞ্চায়েত৷ গ্রামের ঝগড়া-বিবাদ, বিশেষ করে নারী সংক্রান্ত অভিযোগের বিচার করে এরা৷ যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামন্ত্রতান্ত্রিক প্রথাকেই শেষ কথা মনে করে তারা৷

https://p.dw.com/p/2xXvA
ছবি: DW/P. Mani Tewari

ভারতে, বিশেষ করে উত্তর ভারতে পুরুষপ্রধান গ্রামাঞ্চলে খাপ পঞ্চায়েত যেন আইনি আদালতের পাশাপাশি আরেক আদালত হয়ে উঠছে৷ গ্রামের ঝগড়া-বিবাদ থেকে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, মেয়েদের সাজপোষাক, উঁচু-নীচু জাতির মধ্যে বিয়ে, জমিজমা, গবাদি পশু চুরি, এক কথায় যাবতীয় বিষয়ে নিষ্পত্তির শেষ কথা হয়ে উঠেছে এই খাপ পঞ্চায়েত৷ আধুনিক যুগে মেয়েরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে না বা পশ্চিমা দেশগুলির মতো জিনস পরতে পারবে না, ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারবে না – এ সব বিধান অমান্য করলে শাস্তি দেয় খাপ পঞ্চায়েত৷ শাস্তিটা পায় প্রায়শই নারী৷ সর্বোপরি উঁচুজাত ও নীচুজাতের ছেলে-মেয়েরা যদি ইচ্ছামত বিয়ে করে, তাহলে পরিবারের তথকথিত ইজ্জদ বা সম্মান বাঁচাতে অনার কিলিং-এর বিধানও দিয়ে থাকে এই খাপ পঞ্চায়েত৷ অথচ নাবালক-নাবালিকা বিবাহে আপত্তি নেই তাদের৷ পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অপারগ৷ চোখ বুজে থাকে তারা রাজনীতিকদের চাপে৷

‘বেদ, উপনিষদ যে যার জায়গায় আছে, কিন্তু সেটা আইন নয়’

রাজনৈতিক দলগুলি তাদের পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে থাকে গদি হারাবার ভয়ে৷ ফলে খাপ পঞ্চায়েত এক আইন বহির্ভূত এক আদালত হয়ে উঠেছে৷ তাদের বিধান অমান্য করার শাস্তি কথিত দোষী বা দোষীর পরিবারকে একঘরে করে ধোপা নাপিত বন্ধ কোরে দেওয়া৷ দেশের প্রচলিত আইন কানুনের ধার ধারে না৷ দেশের যুগ প্রাচীন ঘুণ ধরা প্রথা, ধ্যান ধারণা এবং বিশ্বাসই সব কিছু৷ বিচার তারই ভিত্তিতে৷ পুলিশ প্রশাসনকে নাক গলাতে দেয় না৷ কাজেই  খাপ পঞ্চায়েতের বিধানের বলি হয় সবথেকে বেশি নারী৷ খাপ পঞ্চায়েত তাদের অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে বিচারকের আসনে বসে অদ্ভুত সব রায় দেয়৷ যার পরিণামে প্রকৃত বিচার ধুলোয় গড়াগড়ি দেয়৷ জীবনহানি হয়৷ যৌন হিংসা এবং জাতপাত যেন অঙ্গাঙ্গি৷

খাপ পঞ্চায়েতের এই ধরনের বাড়বাড়ি কি করে দেশের আইন ব্যবস্থা বরদাস্ত করছে সে সম্পর্কে ডয়চে ভেলে প্রশ্ন রেখেছিল দক্ষিণ এশিয়া হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর পরিচালক মীনাক্ষি গাঙ্গুলির কাছে৷ উত্তরে উনি বললেন, সুপ্রিম কোর্ট তো ইতিমধ্যেই আদেশ দিয়েছে যে, এই ধরনের ক্যাঙ্গারু কোর্টের কোনো এক্তিয়ার নেই৷ আইনি বৈধতা নেই৷ এরা যদি কোনো রায় দেয়, তাহলে এদের অভিযুক্ত করা হবে৷ এই বার্তাটা কড়াভাবে জানাতে হবে৷ না জানালে তারা এই ধরনের কাজ চালিয়ে যাবে৷ এ জন্য রাজনৈতিক সংস্থাগুলিকেও কড়া অবস্থান নিতে হবে৷ ঝাড়খন্ডে নাবালিকা ধর্ষণকাণ্ডের প্রেক্ষিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গ্রুপের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক মীনাক্ষি গাঙ্গুলি মনে করেন, প্রথমেই উচিত ছিল পুলিশকে জানানো৷ এটা বাধ্যতামূলক৷ খাপ পঞ্চায়েত নিজেরা বসে সব কিছু ঠিক করলো, তা তো হতে পারে না৷ এটা বেআইনি৷ খাপ পঞ্চায়েতের যুক্তি এটা ভারতের প্রাচীন প্রথা বা সংস্কার৷ এর উত্তরে উনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রাচীন প্রথায় কী ছিল না ছিল, আজকের দিনে তা অবান্তর৷ এক সময় সতীদাহ প্রথা ছিল৷ এখন কি সেটা চলতে পারে? এখন দেশের সংবিধানই আমাদের নতুন বই৷ সেটা মেনে চলতেই হবে৷ বেদ, উপনিষদ যে যার জায়গায় আছে, কিন্তু সেটা আইন নয়৷

সম্প্রতি নাবালিকা ধর্ষণে ফাঁসির সাজাও সরকারি অধ্যাদেশে বলা হয়েছে৷ এই প্রসঙ্গে মীনাক্ষি গাঙ্গুলি জানান, ‘‘ফাঁসির সাজা ঠিক আছে৷ কিন্তু যেখানে অভযুক্তদের বিরুদ্ধে কেসই রেজিস্ট্রার হয় না, সেখানে ফাঁসির সাজার কথা ওঠে কি করে?'' তাঁর কথায়, ‘‘অভিযুক্তরা রাজনৈতিক দলের সদস্য হলে বড় বড় কথা বলে লাভ নেই৷ আমরা তো বলছি ফাঁসি পরের কথা৷ আগে কেসটা তো রেজিস্ট্রার হোক৷ তারপর আইনই তার নিজের পথে চলবে৷ আইনের শাসনে যদি রাজনীতিকরা থাবা বসায় তাহলে তো কিছু হবার নয়৷ পুলিশ প্রশাসন তখনই সক্রিয় হবে যখন তাদের ওপর চাপ দেওয়া হবে৷ এখন ভারতের পরিস্থিতি এমন যে সব কিছুর ওপরই চাপ৷ মিডিয়াও বাদ নেই৷ পুলিশের উপর রাজনৈতিক চাপ বন্ধ করতে পারলে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা যাবার নয়৷''

এই তো গত সপ্তাহে ঝাড়খন্ড রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে পর পর দু'টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷ একটি গ্রামের ১৬ বছরের এক কিশোরিকে গণধর্ষণ করে গ্রামের দুই যুবক৷ মেয়েটির পরিবার খাপ পঞ্চায়েতের কাছে নালিশ করলে খাপ পঞ্চায়েত ঐ দুই যুবককে ধরে এনে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ১০০ বার কান ধরে ওঠবস করার নির্দেশ দেয়৷ এতে ক্রুদ্ধ দু'জন যুবক রাতে কিশোরীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে মেয়েটিকে পুড়িয়ে মারে৷ গত শুক্রবার আরো একটি ঘটনায় অন্য একটি গ্রামের ১৭ বছরের এক কিশোরিকে ধর্ষণ করে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে তাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে পালিয়ে যায় প্রতিবেশী এক যুবক৷ মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ মেয়েটি আশংকাজনক অবস্থায় এখন হাসপাতালে৷

আরও নক্কারজনক বিধানের উদাহরণ আছে খাপ পঞ্চায়েতের৷ দলিত সম্প্রদায়ের একটি মেয়ে উঁচুজাতের একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেলে মেয়েটির অন্য দুই বোনকে নগ্ন করে সারা গ্রাম ঘোরানো হয় খাপ পঞ্চায়েতের নির্দেশে৷ উত্তর প্রদেশের মীরাট জেলার বাগপতে একটি ছেলে অন্য জাতির একটি মেয়ের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলে তার শাস্তি পেতে হয় মেয়েটির অন্য দুই বোনকে৷ শাস্তি হিসেবে দুই বোনকে ধর্ষণ করার নির্দেশ দেয় খাপ পঞ্চায়েত৷ হালে সরকার নাবালিকা ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দিয়ে এক অধ্যাদেশ জারি করার পরেও জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়ায় আট বছরের এক মুসলিম নাবালিকাকে গণধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা করে৷

পুলিশ কেন এই ধরনের ঘটনা রোধ করতে ব্যর্থ, সেটাই প্রশ্ন৷ শক্তি বাহিনী নামে এক এনজিও-র প্রতিষ্ঠাতা রবিকান্ত খাপ পঞ্চায়েতের এই ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে এক জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন৷ সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন,খাপ পঞ্চায়েতের ইচ্ছামত বিধান ন্যায়বিচারকে পদদলিত করছে৷ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে৷ এটা চলতে পারে না৷ দেশের আইনকে কেন তারা গ্রাহ্য করবে না? এক ভাই পালিয়ে গিয়ে অন্য জাতির মেয়েকে বিয়ে করার জন্য মেয়েটির দুই বোনকে কেন ধর্ষণ করা হবে? এই ধরনের সামন্ততান্ত্রিক পাশবিকতা চলতে পারে না কোনো সভ্য সমাজে৷ এটা কী ধরনের ঐতিহ্য? শুধু বিচার বিভাগ নয়, গোটা ভারতের সুস্থ সমাজের অপমান এটা৷

ওদিকে আদালতে হাজির খাপ পঞ্চায়েতের প্রতিনিধি বলেন, তারা দেশের প্রাচীন প্রথা ও ঐতিহ্য মেনেই চলবে৷ সেখানে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে না৷ করলে কন্যাসন্তানের জন্মই বন্ধ করে দেবে তারা৷ শীর্ষ আদালত এই ধরনের উক্তিকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছে৷ বলেছে, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে বা মেয়ে নিজের পছন্দমত বিয়ে করলে খাপ পঞ্চায়েতের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই৷ জাতপাত বা নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য নিয়ে খাপ পঞ্চায়েতের রায় নিষিদ্ধ করেছে আদালত৷

কিন্তু তাতে কি পালটে যাবে সমাজ? জানান আমাদের, লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷