1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জোট না জট?

Pantho Rahaman / Journalist
পান্থ রহমান
১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

বৈশ্বিক কিংবা আঞ্চলিক; ছোট কিংবা বড় জোট নিয়ে কী জট পাকিয়ে ফেলছে বাংলাদেশ? নাকি, জোটের অংশ হতে গিয়ে জট-জর্জরিত হয়ে পড়ছে?

https://p.dw.com/p/4VpKE
সার্ক পুরানো জোটের একটি। যেখানে ভারত-পাকিস্তানের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। আর সে কারণেই প্রায় অকার্যকর জোটটি (ফাইল ছবি)
সার্ক পুরানো জোটের একটি। যেখানে ভারত-পাকিস্তানের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। আর সে কারণেই প্রায় অকার্যকর জোটটি (ফাইল ছবি)ছবি: AP

১. একজন উচ্চশিক্ষিত ও রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছ থেকে পাওয়া এই প্রশ্নটায় কিছুক্ষণ ‘স্পিকটি নট' ছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম, উত্তর কী হওয়া উচিত! খানিক সময় প্রশ্নকর্তার জ্ঞান এবং কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে শঙ্কা জাগলেও পরে মনে হলো, তার প্রশ্নটা যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক। আরেকটু সরাসরি বললে, এই মুহূর্তে একজন রাজনীতি সচেতন মানুষের আবশ্যিক প্রশ্ন হওয়ার কথা। পরে এ নিয়ে কিছুটা চর্চা হলো ভদ্রলোকের সঙ্গে। ভবিষ্যতের রেফারেন্স হিসেবে সেই চর্চাটুকুর কিছু অংশ লিখে ফেলার ইচ্ছে হলো।

২.

দু'জনই একমত সাদা চোখে আঞ্চলিক জোটগুলো মূলত ওই গণ্ডির মধ্যে থাকা দেশগুলোর জন্য সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে ওঠে। উদ্দেশ্য থাকে সদস্যভুক্ত দেশগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক খাতে একে-অন্যকে সহযোগিতা করবে।  এটা আদর্শ ধারণা।

কিন্তু কেন যেন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই জোটভুক্ত হওয়া কিংবা জোটভুক্তির চেষ্টা হিতে-বিপরীত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন আর সাউথ আফ্রিকার বানানো জোট ব্রিকস-এ অন্তর্ভুক্ত হওয়া নিয়ে হওয়া নাটক, পাল্টা নাটক নিয়ে!

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানোর পর থেকেই দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এ নিয়ে দু'ধারায় আলোচনা হয়েছে। আসলে বলা উচিত, আলোচনা আর সমালোচনা হয়েছে। সেই আলোচনা-সমালোচনার গণ্ডি দেশ ছাড়িয়ে হাজার মাইল দূরেও চর্চা হয়েছে। কেন?

কারণ অনেক। তবে আলোচনার বড় কারণ এই জোটের শক্তি। ব্রিকস'কে বিশ্বের অনেক বড় দেশ আর জোটই দেখছেবিশ্ব অর্থনীতির ‘ভবিষ্যত' হিসেবে। আর সেখানে যুক্ত হতে পারা কিংবা যুক্ত হওয়ার চেষ্টাই আলোচনার প্রধান কারণ হতে পারে। এ নিয়ে আমার দ্বিমত নেই। কিন্তু সমালোচনা কেন?

সমালোচনার মূল কারণ হলো, আমাদের দেশের রাজনীতিকদের হিরো হওয়ার অপ্রয়োজনীয় চেষ্টা; এদেশের রাজনীতিকদের আগ বাড়িয়ে কথা বলা কিংবা নিজেকে জাহির করার প্রবণতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ পাওয়া নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই সরকার দলের বেশ ক'জন রাজনীতিক ‘ব্রিকসে সদস্য হচ্ছে বাংলাদেশ' বলে বলে একটা আবহ তৈরি করে ফেলেছিলেন। সময়ে-অসময়ে দেওয়া তাদের সাক্ষাৎকারগুলোতে বাংলাদেশের ব্রিকস সদস্যপদ কেবল সময়ের ব্যপার মনে হচ্ছিল। তারা কখনও ইঙ্গিত দিয়েছেন; বাংলাদেশকে ব্রিকসই আমন্ত্রণ জানিয়ে সদস্যপদ দিচ্ছে আবার কখনও তারা এমন ধারণা দিয়েছেন যে সদস্য হতে চেয়ে বাংলাদেশ আগ্রহ প্রকাশ করে চিঠি দিয়েছে। পরে অবশ্য বাংলাদেশ সদস্যপদের জন্য আবেদন করেনি বলেও দাবি করেছেন সরকারের ভেতরের কেউ কেউ।

যদিও সদস্যপদ চেয়ে আবেদন করা আর আগ্রহ জানিয়ে চিঠি দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য ঠিক বুঝে আসে নাই। বিশেষ করে যখন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, এই জোটে সদস্যভুক্তির জন্য আলাদা কোন আবেদনপত্র নেই!

শুরুর দিকে বিরোধী শিবিরের সমালোচনা ঠিক না জমলেও ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের পর তারা মুচকি হাসার সুযোগ পেয়েছেন। বিশেষ করে যখন ছয় দেশের জন্য নতুন সদস্যপদ অফার করা হলেও ব্রিকসে বাংলাদেশের জায়গা হলো না। বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিষয়টি ক্যাশ করার চেষ্টা করলেন। আবার শুরু হলো জোট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা।

সরকার পক্ষ থেকে বলা হলো, বৈশ্বিক-ভারসাম্য রক্ষার জন্যই এ যাত্রায় নাম নেই বাংলাদেশের। ভবিষ্যতে সদস্য হবে। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষ বলছে, সরকার সদস্যপদ পেতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কূটনীতি ব্যর্থ হয়েছে।

কেন সদস্যপদ হলো না, এতে ভারত ও চীনের সম্পর্ক কতটা এসব প্রশ্নের আর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করিনি। বরং প্রশ্নকর্তার সঙ্গে আমিও কিঞ্চিৎ পাজলডৃ হয়ে আছি।

৩.

এমন নয় যে জোট আর জটের এই গ্যাঁড়াকলে পড়ার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের এটাই প্রথম। একেবারে শুরু থেকে হিসেব করলে দেখবেন বাংলাদেশ বরাবরই কোনো না কোনো জোটের জটে আটকেছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রস্তাবে সৃষ্ট ‘সার্ক'-এও বাংলাদেশের পরিস্থিতি গ্যাড়াকলে আটকে থাকার মতোই। দক্ষিণ এশিয়ার এই জোট এখন সদস্য দেশগুলোর গলার কাঁটা হয়ে আছে। বাংলাদেশের জন্য যেই কাঁটা ‘মাস্ট রিমুভ' টাইপ; অর্থের বিনাশ ছাড়া আর কিছু নয়।

সার্ক পুরানো জোটের একটি। যেখানে ভারত-পাকিস্তানের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। আর সে কারণেই প্রায় অকার্যকর জোটটি। এই জোটে ভারতের তেমন আগ্রহ নেই বলেই পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল আর ভারত মিলে তৈরি করা হয়েছিলো উপ-আঞ্চলিক জোট ‘বিবিআইএন'। মূলত যোগাযোগ নির্ভর জোটের চিন্তায় এই জোটের চার দেশ মোটরযান চলাচল চুক্তি করেছিল। কিন্তু সেখানেও খুব সুবিধা হয়নি। অবাধ যান চলাচল সম্ভব হয়নি ভারতের ‘নিয়ন্ত্রিত চলাচল' ভাবনার কারণে। ফলে ওটাও কেবল পরীক্ষামূলক পর্যায়েই রয়ে গেছে।

রাষ্ট্রগুলোর বাইরে দক্ষিণ এশিয়াতে একটি উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের চেষ্টা করেছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও। তারা ২০০১ সালে "সাউথ এশিয়ান সাব-রিজিয়নাল কো-অপারেশন‘' সাসেক নামের একটি উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের ঘোষণা দেয়। এখানে সদস্য হয় বাংলাদেশ, ভূটান, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ আর ভারত। অর্থাৎ পাকিস্তান বাদ। কিন্তু এটিও শেষ পর্যন্ত জোট হয়ে উঠতে পারেনি।

পান্থ রহমান, সাংবাদিক
পান্থ রহমান, সাংবাদিকছবি: Pantho Rahaman

খুব বেশি দূর এগোয়নি ভারত, চীন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তরাষ্ট্রীয় যোগাযোগের পরিকল্পনায় তৈরি ‘বিসিআইএম' নামের আঞ্চলিক জোটও। সব মিলিয়ে মোটাদাগে এটুকু বলা যায়, জোটভুক্তির সুবিধাভোগী হতে পারেনি বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রধান কার্যালয় হলেও বড় কোন সাফল্য নেই বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক জোট বিমসটেকেও।

৪.

সরাসরি সুবিধা প্রাপ্তি কিংবা অবকাঠামোগত সংযোগ ছাড়াও বেশ কিছু জোটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। তার কিছুটা ভৌগোলিক অবস্থানে কারণে, আর কিছুটা অর্থনৈতিক সাফল্য কিংবা কূটনৈতিক যোগাযোগের কারণে। যদিও এই সম্পর্কগুলো কেবলই স্ট্র্যাটেজিক বা ‘কৌশলগত'। এই যেমন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোট আসিয়ান, এশিয়া-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক জোট আপটা কিংবা এপেক, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট গ্রুপ অব ৭৭ ইত্যাদির সঙ্গে বাংলাদশের যোগাযোগ কেবল ‘সম্মানিত সদস্য' হিসেবে।

তবে এই জোটগুলোকে একেবারে ফেলে দেওয়ারও উপায় নেই। এই আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক জোটগুলোতে ইদানিং বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে দেনদরবার করে। এখনও ফল হাতে না পেলেও তাতে কিছুটা কাজ হয় বা হচ্ছে বলে মনে করেন অনেক কূটনীতিক।

কৌশলগত এই সম্পর্কগুলোর বাইরেও বাংলাদেশ বেশ শক্তিশালী সদস্য হয়ে আছে স্বল্পোন্নত দেশের জোটে (এলডিসি)। একটা লম্বা সময় এখানে নেতৃস্থানীয় ছিলো বাংলাদেশ। অর্জন যে একেবারে নেই তাও নয়। অন্যদিকে ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর জোট ওআইসি কিংবা ব্রিটিশ ঔপোনিবেশিক দেশগুলোর জোট কমনওয়েলথে বাংলাদেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে তর্কে যাবার ইচ্ছে নেই। এখানে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির মার্জিনটা খুব সিগনিফিকেন্ট কিছু নয়।

৫.

সব মিলিয়ে আমাদের দু'জনের জোট আলোচনাটা অসমাপ্ত গল্পের মতো এগুচ্ছিলো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম র‌্যাপ-আপ করার। তাতে আবার ফিরে এলো শুরুর প্রসঙ্গ- ব্রিকস। অনেক জায়গার মতো আবারও আমরা একমত হলাম, ব্রিকসে সদস্যপদ প্রাপ্তি বা চাওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভবত আমরা একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি। বিশেষ করে সদস্যপদ মিলছে কী মিলছে না সেটার নিশ্চয়তা না পেয়েই এমন অতি-উৎসাহী আচরণ আমাদের কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে।

আর ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার এত-এত ‘সময় নষ্ট আলোচনা'য় কোন বটমলাইন আসেনি।

বরং ওপরের দু'টি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দু'জনের মনেই আরেকটি বাড়তি প্রশ্ন যুক্ত হয়েছে৷যদি সত্যিকারের কার্যকারিতা নাই থাকে তবে ‘এমন জোট লইয়া আমরা

কী করিব?'