1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলা ছবির পর্বতারোহণ

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা৩০ ডিসেম্বর ২০১৩

বাজেটের হিসেবে বাংলা ছবি সবসময়ই মধ্যবিত্ত৷ তাই কখনই তার খুব বেশি উচ্চাকাঙ্খী হওয়ার সাহস নেই৷ সেই ছবিটাই বদলে দিল চাঁদের পাহাড়!

https://p.dw.com/p/1AiHQ
Filmstill Chander Pahar
ছবি: Shree Venkatesh Films

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিশোর-রোমাঞ্চ কাহিনি “চাঁদের পাহাড়” পড়েননি, এমন বাঙালির সংখ্যা প্রায় হাতে গোণা! এমনকি যাঁরা আজকের মধ্যবয়সি বা প্রবীণ, তাঁরাও হয়ত তাঁদের কিশোর বয়সে চাঁদের পাহাড় পড়ে নিজেরাও একদিন অভিযানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন৷ এতটাই ঘনিষ্ঠভাবে বাঙালির কৈশোরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে আফ্রিকার গহিন জঙ্গলে এক বাঙালি যুবকের এই অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি৷ তার সবথেকে বড় কারণ সম্ভবত এই যুবকটি নিজে, যে বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে থাকে এবং স্কুলে পড়াশোনার পালা শেষ হওয়ার পর বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, দুপুরে খাওয়ার পর লম্বা ঘুম দিয়ে এবং বিকেলে খালে-বিলে মাছ ধরে যার দিন কাটে৷

Filmstill Chander Pahar
আফ্রিকার অরণ্য প্রকৃতি তার সমস্ত রহস্যময়তা নিয়ে হাজির হয়েছে সিনেমার পর্দায়ছবি: Shree Venkatesh Films

চাঁদের পাহাড়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র শঙ্কর নামের এই যুবকটির বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল বিদেশি, মূলত নানাবিধ ভূগোলের বই এবং ইউরোপিয়ান পর্যটক-অভিযাত্রীদের লেখা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি৷ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের কথায়, “শঙ্করের বাতিক ছিল যত রাজ্যের ম্যাপ ঘাঁটা ও বড় বড় ভূগোলের বই পড়া৷ ভূগোলের অঙ্ক কষতে সে খুব মজবুত৷ আমাদের দেশের আকাশে যে সব নক্ষত্রমন্ডল ওঠে, তা সে প্রায় সবই চেনে... ৷” এছাড়া সময় পেলেই শঙ্কর অভিযাত্রীদের রোমাঞ্চকর ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়ে৷ মার্কো পোলো, ডেভিড লিভিংস্টোন, হ্যারি জনস্টন৷ এবং সেই সময়কার বিখ্যাত জার্মান ভূপর্যটক আন্টন হাউপ্টমান-এর লেখা‘‘মাউন্টেন অফ দ্য মুন'' নামে আফ্রিকার জঙ্গলে অ্যাডভেঞ্চারের এক কাহিনি শঙ্করের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে৷ বাংলার ওই অজ পাড়াগাঁয়ে বসেই শঙ্কর স্বপ্ন দেখে, সেও একদিন আফ্রিকার ওই চাঁদের পাহাড় জয় করতে যাবে, ঠিক আন্টন হাউপ্টমানের মতো! এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, শঙ্কর সত্যিই একদিন কর্মসূত্রে পৌঁছে যায় আফ্রিকায় এবং ঘটনাচক্রে পা বাড়ায় তার স্বপ্নের সেই চাঁদের পাহাড়ের দিকে৷

এহেন অভিযানকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরের পরিকল্পনা যখন ঘোষণা করলেন পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর প্রযোজক সংস্থা, কলকাতার শ্রী বেঙ্কটেশ ফিল্মস, তখন বিস্ময়ে অনেকের চোখই বিস্ফারিত হয়েছিল৷ কারণ গড়পড়তা বাংলা ছবির বাজেট চার-পাঁচ কোটির উপরে উঠেছে, এমন খুব একটা শোনা যায় না৷ আর যদি বাজেট থাকেও, যে ছবির দৃশ্যপট প্রায় পুরোটাই আফ্রিকা, যে গল্পে প্রায় প্রতি রাতেই হিংস্র সিংহ এসে হামলা করে, মানুষ টেনে নিয়ে যায় বলে লিখে গিয়েছেন বিভূতিভূষণ, যেখানে কালান্তক ব্ল্যাক মাম্বা সাপ এসে শঙ্করের রাতের ঘুম ভাঙায়, সেই রোমহর্ষক গল্প কীভাবে চিত্রায়িত হবে বাংলা সিনেমায়, সংশয় ছিল সেই নিয়েই৷ তা ছাড়া শঙ্করের চরিত্রে বাংলা মেনস্ট্রিম ছবির জনপ্রিয় নায়ক দেব-এর কাস্টিং নিয়েও প্রশ্ন ছিল, যেহেতু প্রথাগত গান, নাচ এবং মেলোড্রামা ও মারামারির বাইরে দেব খুব ভাল অভিনয়ও করেছেন, এমন কখনও শোনা যায়নি৷ যদিও পরিচালক হিসেবে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের যুক্তি ছিল, বিভূতিভূষণের বর্ণনায় যে শঙ্কর হাইজ্যাম্পে চ্যাম্পিয়ন, ফুটবলে দক্ষ সেন্টার ফরোয়ার্ড, তা ছাড়া গাছে উঠতে, ঘোড়ায় চড়তে এবং বক্সিংয়েও নিপুণ, তার চরিত্রে অভিনয় করার উপযুক্ত বলে সুদেহী দেব ছাড়া অন্য কোনও বাঙালি অভিনেতার নাম তাঁর মাথায় আসেনি৷

Filmstill Chander Pahar
“চাঁদের পাহাড়” ছবির একটি দৃশ্যছবি: Shree Venkatesh Films

তবে শেষপর্যন্ত দেবের অভিনয় নয়, বাংলা ছবি চাঁদের পাহাড় হয়ে উঠেছে আফ্রিকার প্রকৃতি এবং তার বন্যপ্রাণের এক তাক লাগানো স্পেকট্যাকল৷ প্রযোজক সংস্থা শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস তার জন্য অর্থব্যয়ে কোনও খামতি রাখেনি৷ পুরো শ্যুটিং ইউনিটকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আফ্রিকায়, স্থানীয় পেশাদার পশু প্রশিক্ষকদের কাজে লাগিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে অতিকায় সিংহ, হাতি এবং বিষধর সাপ৷ স্পেশাল ইফেক্টের চমক নয়, নায়ক শঙ্কর সত্যিই মুখোমুখি হয়েছে এই সব বন্যপ্রাণীর৷ আর আফ্রিকার অরণ্য প্রকৃতি তার সমস্ত রহস্যময়তা নিয়ে হাজির হয়েছে সিনেমার পর্দায়৷ এখনও পর্যন্ত চাঁদের পাহাড়ই বাংলা ভাষায় তৈরি হওয়া সবথেকে ব্যয়বহুল ছবি৷ বাজেট ছিল ১৫ কোটি টাকা৷ শোনা যাচ্ছে, বাঙালি দর্শকও হতাশ করেনি প্রযোজকদের৷ দ্রুত ফেরত আসছে লগ্নি হওয়া অর্থ৷

কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, এই প্রথম বাংলা ছবি চাঁদ না হোক, চাঁদের পাহাড়ের দিকে হাত বাড়াল এবং দেখিয়ে দিল, চিত্রমায়া তৈরিতে তার সাহস অথবা দক্ষতা, কোনোটাই হলিউড বা বলিউডের থেকে কম নয়৷ কলকাতার টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি গত বেশ কয়েক বছর ধরেই অন্য ধারার, অন্য স্বাদের ছবি তৈরির ঝুঁকি নিতে শুরু করেছে এবং কিছুটা সফলও হচ্ছে৷ তার পাশাপাশি চাঁদের পাহাড় নিঃসন্দেহে আরও একটা নজির হয়ে থাকবে যে, সাহস করলে আর্থিক অনটন, কারিগরি দক্ষতা নিয়ে সংশয় বা মানসিক সক্ষমতার অভাব, প্রতিবন্ধকতার যে কোনও পাহাড়ই ডিঙোনো যায়! ছোঁয়া যায় স্বপ্নের চাঁদের পাহাড়৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য