1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলা বর্ষের অর্থনৈতিক চেতনা

১৭ এপ্রিল ২০১৮

সার্বজনীন বাংলা নববর্ষের উন্মেষ ঘটেছে মূলত অর্থনৈতিক প্রয়োজনে৷ পরবর্তীতে এই সার্বজনীন উৎসব বাঙালির জাতীয়তাবাদী পরিচয় হিসেবে বিকশিত হয়েছে৷

https://p.dw.com/p/2w37F
ছবি: Payel Samanta

তখন মুঘল আমল৷ আধুনিক প্রযুক্তির আশীর্বাদ তখনো বর্ষিত হয়নি বঙ্গের কৃষককুলের ওপর৷ তাই তাঁরা ছিলেন ঋতুর ওপর নির্ভরশীল৷ কিন্তু খাজনা বা কর দিতে হত অসময়ে৷ কারণ তখন হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী আদায় হত এই খাজনা৷ আর হিজরি সন নির্ভরশীল ছিল চাঁদের ওপর, যার সঙ্গে কৃষকের ফলনের সময় মিলত না৷ ফলে খুব অসুবিধায় পড়তেন কৃষকরা৷

সেই অসুবিধা দূর করার উদ্যোগ নিলেন সম্রাট আকবর৷ বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজির ওপর পড়ল দায়িত্ব৷ তিনি হিন্দু সৌর পঞ্জিকা ও আরবি হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন৷ সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের সময় (১৫৫৬) থেকেই তার গণনা শুরু করে কার্যকর করা হয় ১৫৮৪ সালের মার্চ থেকে৷ নাম দেয়া হয়েছিল ‘ফসলি সন'৷ পরে পরিবর্তিত হয়ে হয় বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ

এই ইতিহাস সর্বজনবিদিত৷ কিন্তু যে বিষয়টি এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এই পঞ্জিকার জন্ম মূলত অর্থনীতিকে গতিশীল রাখার প্রয়োজন থেকে৷ আরো পরিষ্কার করে বললে কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো সচল রাখতে৷ আর এই অর্থনৈতিক লেনদেনে যে পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ পূণ্যা বা হালখাতা৷ চৈত্র মাসের শেষ দিনে সব কর পরিশোধ করতে হতো৷ আর পরের দিন অর্থাৎ নতুন বছরের প্রথম দিন ভূ-স্বামীরা নিজ নিজ এলাকার মানুষদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন৷

হালখাতা হলো, নতুন হিসাবের বই৷ নতুন বছরের প্রথম দিনে নতুন হিসাবের বই খোলা হতো৷ আগের বছরের সব দুঃখ, কষ্ট ভুলে নতুন বছরে কৃষকরা বুনতেন নতুন স্বপ্ন৷ আরো ভালো ফলনের আশায় বুক বাধতেন৷ সব মিলিয়ে এই হলো বাংলা বর্ষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, যার পুরোটাই অর্থনীতি নির্ভর৷

কালের আবর্তে এই সংস্কৃতি ডালপালা মেলেছে৷ কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে অকৃষি শিল্পগুলো৷ এগুলোও ঢুকে পড়েছে সংস্কৃতিতে৷

একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, গ্রামের জমিদারদের পূণ্যা উদযাপন কিভাবে এবং কেন শহরে মধ্যবিত্তের মনে জায়গা করে নিল? অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে ষাটের দশকে এই উদযাপন শহরে ব্যাপকতা ছড়িয়েছে৷ তার কারণ, এক ধরনের ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের' বিকাশ৷ এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে উজ্জীবিত করতে ভুমিকা রেখেছে৷

তাই কৃষি অর্থনীতিকে ধারণ করে শুরু হওয়া বঙ্গের একেবারে নিজস্ব একটা পরিচয় পরবর্তীতে গ্রামের সাধারণ কৃষকের জীবনের অংশ থেকে বিকশিত হয়ে সাধারণ বাঙালির জীবনে-মননে স্থান করে নিয়েছে৷ আপামর বাঙালিও আগের বছরের জরা-গ্লানি ভুলে নতুন বছরে নতুন জীবনের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন৷

তবে ভালো কি খারাপ জানি না, পরবর্তীতে আরো যেটি হয়েছে, তা হলো এই উদযাপনের কনজ্যুমারিজম৷ অর্থাৎ এই উৎসব বা উদযাপনটিই বা এর অনুসঙ্গগুলোই পণ্য হয়ে গেছে৷ ছোট ছোট উদযাপনগুলো নানা পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ে জর্জরিত৷

যদিও ছায়ানটের বর্ষবরণ বা চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা এই বর্ষবরণে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে, এবং এখনো পণ্যের চটকদার দাসত্ব স্বীকার করেনি৷ কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজে কনজ্যুমারিজম একটা অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার৷

যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলে
যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলেছবি: Zobaer Ahmed

তাই পান্তা-ইলিশ খাওয়া শুধু নয়, বাজারের সবচেয়ে বড় ইলিশটি কেনার ব্যাপারে আগ্রহ, কিংবা নতুন পোশাকের বাহার দেখে যেটা অনুমান হয়, তা হলো সংস্কৃতি ধারন করার চেয়ে পণ্যের প্রতি প্রেমাধিক্যই বেশি৷ সঙ্গে ‘স্ট্যাটাসকেন্দ্রিক' শ্রেণিযুদ্ধে জয়ী হবার বাসনা তো আছেই৷

তবে এর ভালো দিকটি হলো বাজারের গতিশীলতা৷ দেশে পোশাক শিল্পের সারা বছরের যা বিকিকিনি তার ৫০ ভাগ হয় রোজার ঈদ, আর ২৫ ভাগ হয়  পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে৷ প্রতি বছর বাজার বাড়ে ১৫ থেকে ২০ ভাগ৷

গত বছর প্রায় ১ হাজার ৭শ' কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়েছে৷ যেহেতু পয়লা বৈশাখ আর বাঙালিয়ানাই এখানে মুখ্য, আশা করাই যায়, বেশিরভাগই দেশীয় পোশাক কিনেছেন মানুষ, ভারতীয় বা পাকিস্তানি পোশাক নয়, যেগুলোতে সয়লাব পোশাকের দোকানগুলো৷

ইতিবাচক সংযোজন আরো আছে৷ গত বছর দেশের রাজস্ব বিভাগ একটি উদ্যোগ নিয়েছে৷ তারা এ দিনটিতে হালখাতা চালু করেছে করদাতাদের জন্য৷ ব্যক্তি থেকে শুরু করে অনেক প্রতিষ্ঠানই সোৎসাহে সেখানে গিয়ে কর দিয়ে এসেছেন৷ নাম লিখিয়েছেন হালখাতায়৷ কর বিভাগ তাদের নাড়ু মিষ্টি খাইয়েছে৷ এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ৷

সব মিলিয়ে পয়লা বৈশাখের বা বাংলা বর্ষপঞ্জির বুৎপত্তি মূলত অর্থনৈতিক হলেও এর চেতনা সার্বজনীন বাঙালিপনা৷ বেঁচে থাকুক বঙ্গ, বেঁচে থাকুক বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি, বেঁচে থাকুক বাংলা বর্ষপঞ্জি৷

পাঠক, কেমন লেগেছে ব্লগটি? লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷