1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিপণন কি কমছে কলকাতায়?

৩০ জানুয়ারি ২০১৮

প্রতি বছর কার্যত উৎসবের মেজাজে শুরু হয় কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা৷ এ বছরও শুরু হয়েছে৷ কিন্তু বইমেলা কি তার জৌলুস হারাচ্ছে? কমছে ব্যবসা? সিরিয়াস পাঠক যাচ্ছেন তো মেলায়? প্রশ্নগুলো উড়ছে হাওয়ায়৷

https://p.dw.com/p/2rcXS
ছবি: DW/S. Bandopadhyay

দেখতে দেখতে প্রায় ৪২ বছর৷ ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে মাত্র ৫৪টি স্টল নিয়ে শুরু হয়েছিল যে মেলা, আজ তা দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতায় মহীরূহ সমান৷ কলকাতা বইমেলা এখন আর শুধু কলকাতার সম্পদ নয়, সারা পৃথিবীতেই তা নিয়ে যথেষ্ট আলোড়ন৷ আলোড়নের কারণও আছে৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলার নিরিখে তৃতীয় স্থানে আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা৷ প্রথম স্থানে জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট, দ্বিতীয় লন্ডন৷ আর দৈনিক ভিড়ের হিসেব ধরলে, কলকাতা বইমেলা সকলের উপরে৷ সব মিলিয়ে প্রতিবছর প্রায় ২ মিলিয়ন, অর্থাৎ ২০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয় এই মেলায়৷ বইয়ের পাশাপাশি আড্ডা, সেমিনার, গানবাজনা, সবই চলতে থাকে এখানে৷

বস্তুত, এই বিপুল কার্নিভালের মেজাজের জন্যই ১৯৮৪ সালে কলকাতা বইমেলা আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি পায়৷ প্রতিবছর কয়েক হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয় এখানে৷ প্রকাশ পায় অগণিত লিটল ম্যাগাজিন৷ লিটল ম্যাগাজিনের জন্য তৈরি হয় আস্ত একটা প্যাভিলিয়ন৷ পাশাপাশি তৈরি হয় বিভিন্ন দেশের থিম প্যাভেলিয়ন৷ সেখানে গিয়ে সে দেশের নতুন নতুন বইপত্র দেখে নেওয়ার সুযোগ থাকে পাঠকদের৷ সুযোগ থাকে সে দেশের লেখকদের সঙ্গে পরিচয় করারও৷ কিন্তু এত কিছুর পরেও একটি প্রশ্ন ঘুরতে থাকে কলকাতার আকাশে বাতাসে৷ কলকাতা বইমেলা কি তার মান হারিয়েছে? আদৌ কি বইমেলা সফলভাবে ব্যবসা করতে পারে? যে মেলার ব্যবসাই নেই, সেই মেলাকে কি সফল বলা আদৌ যায়? বিতর্কিত প্রশ্ন৷ পক্ষে বিপক্ষে রয়েছে ভারী ভারী যুক্তি৷ রয়েছে বহু স্মৃতিকাতরতাও৷ অনেকেই বইমেলাকে কেবল একটি ব্যবসার জায়গা বলতে নারাজ৷ তাঁদের মতে, বইমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার সংস্কৃতি৷ সাহিত্যের ঐতিহ্য৷ তাই বার বার জায়গার বদল হলেও, পাঠকের সংখ্যা কমলেও, ব্যবসা না দিলেও, তাঁরা বইমেলা নিয়ে খারাপ কথা বলতে চান না৷ কারণ, তাঁদের কাছে বইমেলা একটা মস্ত বড় নস্টালজিয়া৷ শ্রীজাত-র মতো এই প্রজন্মের লেখকেরাও তেমনই মনে করেন৷ ডয়চে ভেলেকে শ্রীজাত জানিয়েছেন, তাঁর ইদানীং আরও বেশি করে মনে হয় যে, কলকাতা বইমেলা মানুষের স্পন্দনের সঙ্গে জড়িয়ে৷ মেলার মাঠ স্থানান্তর নিয়ে বহু সময়েই নানা সমস্যা হয়েছে৷ একসময় ময়দান থেকে বইমেলা সরে এসেছিল মিলনমেলায়৷ এবার মিলনমেলায় সংস্কারের কাজ চলছে বলে বইমেলা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সল্টলেকে৷ জায়গা বদলালে সমস্যা হয় ঠিকই৷ কিন্তু তাতে বইমেলার আকর্ষণ কমবে না বলেই তাঁর বিশ্বাস৷ আর বইমেলার গুণমান নিয়েও তাঁর কোনো প্রশ্ন নেই৷ বরং তিনি শুনেছেন, আগের চেয়ে বইমেলার বিক্রি বেড়েছে৷

‘বইয়ের বিক্রিবাটা হ্রাস পায়নি, বরং বেড়েছে বলেই শুনতে পাই’

শ্রীজাত, কবি (সাউন্ড বাইট): ‘বইয়ের বিক্রিবাটা হ্রাস পায়নি, বরং বেড়েছে বলেই শুনতে পাই৷'

শুধু শ্রীজাত নন, বইমেলা কর্তৃপক্ষেরও দাবি, আগের চেয়ে ব্যবসা বেড়েছে কলকাতা বইমেলার৷ কিন্তু তা লাভের জায়গায় পৌঁছেছে কি? বিষয়টি বিতর্কসাপেক্ষ৷ বস্তুত, ২০১৭ সালের ইন্টারনেট বিশ্বে, কলকাতা বইমেলার বিপণন ধারা এবং বইয়ের গুণাগুণ নিয়ে বহু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে৷ প্রশ্ন উঠছে, বিপুল অর্থ খরচ করে আদৌ এই মেলা চালানোর কোনো অর্থ আছে কিনা!

এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে পৌঁছে যেতে হবে কলেজ স্ট্রিট পাড়ায়৷ বুঝতে হবে, বছরভর বাংলা বই প্রকাশনার বাণিজ্যটি৷ পাবলিশার্স এবং গিল্ডের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর কলেজ স্ট্রিটে প্রায় আড়াই হাজার নতুন বই মুদ্রিত হয়৷ সংখ্যাটি নেহাত কম নয়৷ ছোটবড় মিলিয়ে কলেজ স্ট্রিটে মোট প্রকাশকের সংখ্যা পাঁচশ'রও বেশি৷ সুতরাং গড়ে প্রত্যেক প্রকাশনা বছরে পাঁচটি করে নতুন বই প্রকাশ করছে৷ বিশ্ববাজারে এ সংখ্যা নেহাত মামুলি নয়৷ কিন্তু যাচ্ছে কোথায় সেই বই? আদৌ বিক্রি হচ্ছে তো? প্রকাশকেরা সেই বই নিয়ে ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করতে পারছেন তো? মনে রাখা দরকার, নতুন প্রকাশিত অধিকাংশ বই-ই বইমেলাকে মাথায় রেখে করা হয়৷ পুজোয় যেমন বহু প্রকাশনা পুজো সংখ্যার ম্যাগাজিন প্রকাশ করে, তেমনই বইমেলায় প্রকাশিত হয় নতুন বই৷ অভিযোগ, বড় প্রকাশনাগুলি ছাড়া অধিকাংশ প্রকাশকই ইদানীং নিজেদের খরচে নতুন বই প্রকাশ করে না৷ লেখকই নিজের বই ছাপার অর্থ দেন৷ অর্থাৎ, বই বিক্রির প্রাথমিক তাগিদ না দেখালেও চলে ছোট প্রকাশকদের৷ লেখকের থেকেই তারা প্রোডাকশনের অর্থ তুলে নেন৷ তাছাড়া যে লেখক নিজের অর্থে বই ছাপান, সেই লেখকের গুণমান নিয়েও প্রশ্ন উঠে যায়৷

‘বইমেলা বই বিক্রির জায়গা নয়, প্রচারের জায়গা’

ফ্রাংকফুর্ট বা লন্ডন বইমেলার সঙ্গে তুলনা করা হলেও কলকাতা বইমেলা কিন্তু বাণিজ্যিক মেলা নয়৷ প্রথম থেকেই এটিকে ‘অবাণিজ্যিক' মেলা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে৷ বহু প্রকাশনা সংস্থারই বক্তব্য, মেলায় স্টল দিয়ে তাদের কোনো মুনাফা হয় না৷ তবু তারা স্টল দেয়, কারণ, ব্যবসায় টিকে থাকতে হবে৷ কথাটি একপ্রকার স্বীকারই করে নিয়েছেন কলকাতা বইমেলার অন্যতম কর্তাব্যক্তি তথা পাবলিশার্স এবং বুকসেলার্স গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়৷ মেনে নিয়েছেন যে, কলকাতা বইমেলায় প্রকাশকেরা বই বিক্রির আশায় স্টল দেন না, বিজ্ঞাপনের জন্যই মূলত স্টল দেওয়া হয়৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘বইমেলায় যে দামে বই পাওয়া যায়, কলেজ স্ট্রিটে তার চেয়ে অনেক বেশি ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়৷ কিন্তু বইমেলায় পাঠকের সামনে প্রকাশকেরা নতুন নতুন বইয়ের বিজ্ঞাপন করতে পারেন৷ সেটা জরুরি৷''

প্রশ্ন রয়েছে বইয়ের গুণমান নিয়েও৷ অভিযোগ, পৃথিবীব্যাপী বইয়ের প্রোডাকশন এবং সম্পাদনা যখন চোখে পড়ার মতো মানবৃদ্ধি করেছে, বাংলা বই তখনও ডুবে আছে অতলান্ত সাগরে৷ অধিকাংশ ছোট প্রকাশনা সংস্থার নিজস্ব সম্পাদকই নেই৷ ফলে, পুরনো বই রিপ্রিন্ট করার ক্ষেত্রেও অসংখ্য ভুলভ্রান্তি থেকে যায়৷ নতুন বইয়ের বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো মুন্সিয়ানা দেখা যায় না৷ ফলে শেষ পর্যন্ত নতুন বইয়ের চাহিদা তৈরি হয় না পাঠকের কাছে৷ তথ্য ঘাঁটলে দেখা যাবে, গত কয়েক বছরের বেস্টসেলারের তালিকায় পুরনো বইগুলিই ঘুরে ফিরে এসেছে৷ নতুন বইয়ের নাম  কদাচিৎ চোখে পড়ে৷ এখনো রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, শরৎ কিংবা সুনীল, শক্তি, শঙ্খ অথবা শীর্ষেন্দুরাই বেস্টসেলার৷ হালের লেখকদের মধ্যে শ্রীজাত-র মতো কয়েকজন ছাড়া বেস্টসেলারের তালিকায় তরুণদের নাম খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷

অথচ পাঠক বদলে গিয়েছে৷ বাঙালি পাঠক এখন আর বাংলা বইয়ে আটকে নেই৷ খোলাবাজারের দেশে অনলাইনে বিদেশি বই অর্ডার দিচ্ছেন তাঁরা নিয়মিত৷ এটা অনেকটা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলার মতো৷ একসময় এই দুই ক্লাবের ফুটবলের সঙ্গেই পরিচিত ছিল আম বাঙালি৷ আবেগও ছিল ভরপুর৷ কিন্তু টেলিভিশন যখন বিশ্ব ফুটবল চেনালো, রাজ্যের ক্লাব ফুটবলও তার রং হারালো৷ বাঙালি পাঠক তাই আর এখন বইমেলায় গিয়ে বই কেনেন না৷ বই দেখেন কম, খান বেশি, আড্ডা মারেন আরও বেশি৷

বই সম্পাদনার বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট সম্পাদক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় একদা বলেছিলেন, ‘‘ভারতীয় বাজারের সঙ্গে তুলনায় বাংলা বইয়ের অধিকাংশ সম্পাদকেরা এতই কম পারিশ্রমিক পান যে, তাঁদের কাছ থেকে ভালো কাজ আশা করা বৃথা৷ তাছাড়া বাংলা বইয়ের জগতে সম্পাদক বলতে ঠিক কী, সে ধারণাটাই তৈরি হয়নি৷''

অন্য এক প্রসঙ্গে আনন্দ পাবলিশার্সের সম্পাদক সুবীর মিত্র বলেছিলেন, ‘‘বই বিপণনের নানা পদ্ধতি আছে৷ বইপাড়ায় আনন্দই প্রথম টেলিফোনে অর্ডার নিয়ে বাড়িতে বই পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করে৷ তা ছাড়া শহরের দু'প্রান্তে আমাদের নিজস্ব শোরুমও আছে৷ এখন আমরা নানা জায়গায় আরও শোরুম খুলছি৷''

মুশকিল হলো, আনন্দ বা দে'জ পাবলিশিংয়ের মতো বড় মাপের প্রকাশনা সংস্থা বাংলায় নেহাতই কম, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বই বিক্রির প্রক্রিয়া যাদের জানা আছে৷ সুবীর মিত্ররা বুঝে গিয়েছেন, পাঠক এখন আর বছরের একটি সময় বই কেনার জন্য হা-হুতাশ করে বসে থাকেন না৷ বই কেনা কিংবা অনলাইনে বই পড়ার আধুনিক পদ্ধতি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি রপ্ত করে ফেলেছে৷ ফলে সেই মোতাবেক বিপণন প্রক্রিয়াও তাঁরা শুরু করেছেন৷ যাঁরা পারেননি, বইমেলায় প্রভূত পরিমাণ নতুন বই নিয়ে এসেও তাঁরা নতুন প্রজন্মের কাছে সেই বই বিক্রি করে উঠতে পারছেন না৷

তবু এত কিছু সত্ত্বেও বইমেলা আছে বইমেলাতেই৷ কথায় বলে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ৷ যতদিন যাচ্ছে, বাঙালির পার্বণের সংখ্যা ততই বাড়ছে৷ বইমেলা তার অন্যতম৷ ফলে বই বিক্রি হোক বা না হোক, বইমেলার ভিড় কমবে না৷ তা সে শহরের যে মুলুকেই হোক না কেন! কিন্তু যে মেলার নামের সঙ্গেই ‘বই' জড়িয়ে, সেখানে যদি বই বিক্রিই কমে যায়, তাহলে আর তার তাৎপর্য কী? প্রশ্নটি ছিল, আছে, থাকবে৷ পাঠক এবং বিক্রেতারাই এর সমাধানসূত্র খুঁজে বার করতে পারেন৷

বইমেলা নিয়ে এই প্রতিবেদনটি আপনার কেমন লাগলো? মতামত লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷