1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারত ২০২২: পশ্চিমা চাপ অগ্রাহ্য করে নিজে চলার বছর

গৌতম হোড়
গৌতম হোড়
৩০ ডিসেম্বর ২০২২

একটা বছরে অনেক প্রাপ্তি থাকে, অনেক অপ্রাপ্তিও৷ ভারতের ক্ষেত্রে এই এক বছরে প্রাপ্তির তালিকাটা বেশ বড়৷

https://p.dw.com/p/4LZDz
২০২১ সালের ডিসেম্বরে ভারত সফরে গিয়েছিলেন পুটিন৷
পশ্চিমা বিশ্বের চাপ সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে তেল কিনেছে ভারত৷ ছবিতে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পুটিনের ভারত সফরের সময় তোলা৷ছবি: Pib Pho/Press Information Bureau/ZUMAPRESS.com/picture alliance

২০২২ হলো নিরাশা থেকে আশায় ফেরার বছর৷ করোনা প্রায় উধাও হয়ে যাবে, জনজীবন আগের মতো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে, তা কি ২০২১-এ বসে ভাবা গিয়েছিল? বোঝা গিয়েছিল, আবার মাস্ক, স্যানিটাইজার, সামাজিক দূরত্বহীন একটা সময় এত দ্রুত আসবে? না, মনে হয়নি৷ ২০২২-এর মজাটা এখানেই৷ সেই অভাবিত, কড়াকড়িহীন, করোনাহীন একটা সময়ে যা আমাদের পৌঁছে দিয়েছে৷ এই একটামাত্র কারণেই বছরটা স্মরণীয় হয়ে থাকা উচিত৷ একারণেই সম্ভবত বছরশেষে চীনে করোনার ভয়ংকর বাড়বাড়ন্ত নিয়ে আমজনতা, বিশেষ করে বঙ্গসন্তানরা মাথা ঘামাচ্ছেন না৷

চাপ অগ্রাহ্য করার বছর

করোনামুক্তির পাশাপাশি ২০২২ চিহ্নিত হবে যুদ্ধের বছর হিসাবেও৷ রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ৷ ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এই যুদ্ধের সঙ্গে ভারত কোনোভাবে জড়িত না থেকেও বারবার সংবাদ-শিরোনামে উঠে এসেছে৷ উঠে এসেছে মূলত দুইটি কারণে৷ প্রথমত, পশ্চিমা দেশগুলির দাবি ছিল, জাতিসংঘে ভারতকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিতে হবে, প্রকাশ্যে রাশিয়া ও পুটিনের তীব্র নিন্দা করতে হবে৷ কারণ, যুদ্ধটা পুটিনই শুরু করেছেন৷ তাদের দ্বিতীয় দাবি ছিল, রাশিয়া থেকে বেশি তেল কিনতে পারবে না ভারত৷ কারণ, বেশি তেল কিনলে তাতে পুটিনের সুবিধা হবে৷ তেলের টাকা দিয়ে তিনি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন৷

ঘটনা হলো, ভারত কোনো দাবিই মানেনি৷ এবার অ্য়ামেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলির চাপ একেবারে প্রকাশ্যে এসেছিল৷ বাইডেনের দূত দিল্লিতে এসে বলে গিয়েছিলেন, তাদের কাছে সীমাটা হলো, গত বছর রাশিয়া থেকে ভারত যে পরিমাণ তেল কিনেছিল, তার থেকে সামান্য বেশি কিনতে পারে৷ কিন্তু অঢেল তেল কেনা চলবে না৷  ২০২১ সালে ভারত রাশিয়া থেকে দিনে ৩৫ হাজার ব্যারেল তেল কিনত৷ আর আন্তর্জাতিক হিসাব বলছে, এখন তারা দিনে নয় লাখ ব্যারেল তেল কেনে৷ চীন কেনে দিনে ১০ লাখ ব্যারেল৷ ফলে চীনের পরই আছে ভারত৷ ফলে বাইডেনের দূতের বেঁধে দেয়া সীমাকে আমল দেয়নি ভারত৷ যেমন দেয়নি ইইউ-র প্রধান, জাার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে পশ্চিমা দেশগুলির কথাতেও৷

অবশ্য ভারতকে এক্ষেত্রে সুবিধা করে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ-ই৷ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর তারা এখনো বিপুল পরিমাণ গ্যাস রাশিয়া থেকে কিনে যাচ্ছে৷ পারলে আরো বেশি করে কেনে৷ আমাদের ছোটবেলায় একটা কথা খুবই চালু ছিল৷ একটু স্ল্যাং হলেও সেই কথাটা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না৷ কথাটা হলো, 'কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা করলে বিলা'৷ পশ্চিমা দেশগুলির হাবভাব দেখলে সেই কথাটাই মনে পড়ছে৷ তারা নিষেধাজ্ঞা জারি করেও রাশিয়ার থেকে গ্যাস কিনতে পারে৷ অন্যরা তেল কিনলেই দোষ! এই চাপের মধ্যে পড়ে বাংলাদেশ তো রাশিয়া থেকে তেল কিনতেই পারলো না৷

কিন্তু এই চাপটাই ভারত উপেক্ষা করতে পেরেছে৷ ২০২২-এর ভারতের কাছে এটা বড় কূটনৈতিক সাফল্য৷ তারা এখনো পর্যন্ত একবারও রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ভোট দেয়নি৷ প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে পুটিনের অনেকবার কথা হয়েছে৷ একবারও তার মুখে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের নিন্দা শোনা যায়নি৷ এই অবস্থান ভালো না খারাপ, সে প্রশ্নের বিচার করার জায়গা এটা নয়৷ এখানে শুধু এটুকু বলা ভালো, বিশাল চাপ কাটিয়ে নিজের পথে চলার সাহস দেখাতে পেরেছে ভারত৷ 

এমনকী কিছুদিন আগে অরুণাচলে চীনের সেনার সঙ্গে ভারতের সেনার একটা সংঘর্ষ হয়েছিল৷ বছর দুয়েক আগে লাদাখে এরকম সংঘর্ষের পরিণতি বিশাল হয়ে উঠেছিল৷ এবারও কাঁটাতারের লাঠির মতো জিনিস নিয়ে লড়াই হয়েছে৷ কিন্তু সেই লড়াই একটা সময়ের পর থেমে গেছে৷ ভারতীয় সেনার দাবি, চীনা সেনা ফিরে গেছে৷ এটাও বদল৷ ২০২০-র সঙ্গে ২০২২-এর ভারতের পার্থক্য৷ এই প্রসঙ্গে একটা কথা জানিয়ে রাখি, ২০২০-র জানুয়ারি থেকে ২০২২-এর মার্চ পর্যন্ত ভারতে ১০২ জন বিদেশি নেতা এসেছেন৷ তার মধ্যে প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী  থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রীরা আছেন৷

খালি হাতে হাসিনা

গত সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে তার দীর্ঘ বৈঠক হয়েছে৷ দুই দেশের প্রতিনিধিদলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে৷ তারপর সাতটি সমঝোতায় সই করেছে দুই দেশ৷

ভারত সফর থেকে কী পেলেন শেখ হাসিনা?

কিন্তু তিস্তা চুক্তি হয়নি৷ সীমান্ত-হত্যা নিয়ে কোনো নতুন কথা শোনা যায়নি৷ রাশিয়ার তেল কেনা নিয়ে বাংলাদেশের আশাপূরণে ভারত কোনো সাহায্য করার কথা বলেনি৷

শেখ হাসিনা অবশ্য তারপরেও দরাজভাবে মোদীর গুণগান গেয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, মোদী থাকলে সব সমস্যার সমাধান হবে৷ 

প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা এই সফর থেকে কী পেলেন? আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, তার প্রাপ্তির তালিকায় সাতটি সমঝোতা ছাড়া  খুব বেশি কিছু নেই৷ অবশ্য হাসিনা ভারতে আসার মাসখানেক আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, শেখ হাসিনাকে সরকারে টিকিয়ে রাখার জন্য যা করার দরকার তিনি ভারতকে তা করার অনুরোধ জানিয়েছেন৷

প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, হাসিনার কোন সমস্যার সমাধান করবেন মোদী?

সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷
সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ছবি: Naveen Sharma/ZUMA/IMAGO

সেই তো দিচ্ছে, সেই তো নিচ্ছে

বছর শেষে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যবানী করা হয়েছে৷ করেছে বিশ্ব ব্যাংক এবং লন্ডনভিত্তিক সংগঠন সেন্টার ফর ইকনমি অ্য়ান্ড বিজনেস রেসাল্ট (সিইবিআর)৷ বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, ২০২২-২৩-এ ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার হবে ছয় দশমিক নয় শতাংশ৷ আগে তারা বলেছিল ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে বৃদ্ধি হবে৷ সিইবিআরের রিপোর্ট আরো চমকপ্রদ৷ ২০৩৫-এর মধ্যে ভারত ১০ ট্রিলিয়ান ডলারের অর্থনীতি হবে৷ আর ২০৩৭-এর মধ্য়ে তারা বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতি হবে৷ এখন ভারত আছে পঞ্চম স্থানে৷ ১৫ বছরের মধ্য়ে ভারত যদি তৃতীয় স্থানে উঠে পড়তে পারে, তাহলে সেটা বড় সাফল্য বো বটেই৷

তার কোনো চিহ্ন কি ২০২২-এ দেখা যাচ্ছে? উত্তরটা কঠিন৷ এখন এই সময়ে দাঁড়িয়ে একটা কথা বলা যায়, করোনাকালে অর্থনীতির যে ধাক্কাটা লেগেছিল, ২০২২-এ তা কিছুটা সামলাতে পেরেছে ভারত৷ জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি বেড়েছে ২১ শতাংশ৷ ২০২১-এর তুলনায় বেকারত্বের হার কমেছে৷

তার উপর মোদী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ২০২৩-এর শেষ পর্যন্ত দেশের ৮১ কোটিরও বেশি মানুষ বিনা পয়সায় মাসে পাঁচ কিলোগ্রাম করে খাদ্যশস্য পাবে৷ বড় কৃষক বাদ দিলে অন্যরা আগের মতোই বছরে ছয় হাজার টাকা করে পাচ্ছেন ও পাবেন৷ তারা স্বাস্থ্যবিমা পান, বয়স্ক পেনশন পান৷ যেহেতু এখন টাকাটা সরাসরি তাদের অ্য়াকাউন্টে চলে যায়, ফলে টাকা মার যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই৷ এ সবই ২০২২-এ ছিল, ২০২৩-ও থাকবে৷

শিলচর, সিলেটের বন্যার কারণ কি সীমান্তের বাঁধ?

কিন্তু যে জায়গায় চিন্তার কারণ থেকে গেছে তা হলো টাকার দাম৷ এখন এক ডলার মানে ৮২ টাকা ৮১ পয়সা৷ ২০২২-এ সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে টাকার দাম৷ এত অবমূল্যায়ন আগে কখনো হয়নি৷

সেই সঙ্গে আরেকটা উদ্বেগজনক সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে রাখা যাক৷ ২০২২-এর শেষে ভারতে গরিব মানুষের সংখ্যা ১৬ শতাংশের বেশি৷ তার মধ্যে চার দশমিক দুই শতাংশ অতি-গরিব৷ আর ১৮ শতাংশ মানুষ গরিব হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছেন৷

কোথাকার পরিবেশ কোথায় দাঁড়ালো

শুধু টাকার দাম পড়ে যাওয়ার রেকর্ড নয়, ২০২২-এ অন্য অনেক রেকর্ডই তো হয়েছে৷ এত ক্লাউড বার্স্ট বা মেঘফাটা বৃষ্টি আগে কখনো হয়নি৷ বৃষ্টির এমন রেকর্ডও আগে কখনো দেখেনি ভারতের অনেক শহর৷ আগে বর্ষায় মুম্বই, কলকাতা ডুবত৷ এবার চেন্নাই ডুবেছে, বেঙ্গালুরু ডুবেছে, হায়দরাবাদ ডুবেছে, গুড়গাঁও ডুবেছে, বারাণসীর ঘাট চলে গেছে জলের তলায়৷ হিমাচল ও উত্তরাখণ্ডে একের পর এক জায়গায় ধস নেমেছে৷ মানুষ মারা গেছেন৷

রেকর্ড ভেঙেছে শিলচরের বন্যা৷ দিনের পর দিন জলমগ্ন থেকেছে শিলচর৷ মহারাষ্ট্রের ২৪৯টি গ্রাম বন্যার জলে ভেসে গেছে৷ অনেকদিন সেখানে জল নামেনি৷ এমনকী মরুভূমির কাছের শহর যোধপুরে  বন্যার জল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে একের পর এক গাড়ি৷

আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এমন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে৷ আমরা এটাও জানি, বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো পরিবেশ রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে ভারতও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

২০২২-এর রাজনীতি

গত এক বছরে ভারতের সাতটি রাজ্যের নির্বাচন হয়েছে৷ দুইটি রাজ্যে সরকারের বদল হয়েছে৷ মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বে বিরোধী জোট ক্ষমতা হারিয়েছে শিবসেনার বিদ্রোহী বিধায়ক ও বিজেপি-র কাছে৷ বিহারে বিজেপি-কে ছেড়ে দিয়ে নীতীশ কুমার আবার আরজেডি ও কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করেছেন৷ গুজরাটে বিজেপি ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে৷ কিন্তু হিমাচল তাদের হাতছাড়া হয়েছে৷ আবার কংগ্রেস হিমাচলে জিতলেও পাঞ্জাবে হেরেছে৷ সেখানে কেজরিওয়ালের আপ সরকার গঠন করেছে৷ সেদিক থেকে দেখতে গেলে, কেজরিওয়ালের দল ২০২২-এ সবচেয়ে লাভবান হয়েছে৷ তাদের ঝুলিতে যেমন পাঞ্জাব এসেছে, তেমনই দিল্লি পুরসভাও তারা ১৫ বছর পর বিজেপি-র কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পেরেছে৷

সবমিলিয়ে বিজেপি-র প্রবল আধিপত্য আছে ঠিকই, কিন্তু তারা এখনো কংগ্রেসকে মুছে ফেলতে পারেনি৷ আপও শক্তি বাড়িয়ে নিয়েছে৷ আঞ্চলিক দলগুলির শক্তিও বেড়েছে বই কমেনি৷ আর ২০২২-এর শেষবেলায় রাহুল গান্ধী ভারতজুড়ে পদযাত্রা করছেন৷ তাতে তার দাড়ি বেড়ে প্রায় কার্ল মার্কসের মতো হয়ে গেছে৷ যাত্রায় প্রচুর মানুষকে সঙ্গী হিসাবে পেয়েছেন রাহুল৷ অধিকাশই দলের নেতা ও কর্মী, তার বাইরে বিভিন্ন ক্ষেত্রের কিছু কৃতী মানুষও আছেন৷ মাইলের পর মাইল এভাবে হেঁটে যাওয়ার সুফল রাজনীতিতে রাহুল কতটা তুলতে পারেন, তা আর ২০২২-এ দেখা সম্ভব হয়নি৷ তা দেখার জন্য ২০২৩ তো থাকলোই৷