1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যৌতুকের প্রতিযোগিতা ও নির্মমতা

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২০ নভেম্বর ২০১৭

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী যৌতুক দেয়া এবং যৌতুক নেয়া দু'টোই অপরাধ৷ এছাড়া যৌতুকের কারণে কেউ আত্মহত্যা করলে প্ররোচনাকারীর শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ কিন্তু বাস্তব অবস্থা কী? যৌতুক কি বিদায় নিয়েছে আমাদের সমাজ থেকে?

https://p.dw.com/p/2nrJj
ছবি: picture alliance/AP Photo

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে যৌতুকের কারণে ১২৬ জন নারীর ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাঁদের হত্যা করা হয়৷ ১০৮ জন নির্যাতনের শিকার হয়েও বেঁচে আছেন৷ এছাড়া নির্যাতন সইতে না পেরে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন একজন৷ যৌতুকের মামলা হয়েছে মোট ৯৫টি৷

এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালে যৌতুকের কারণে ১৮৭ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছিল৷ আত্মহত্যা করেন ১০ জন৷ আর ১০১ জন নির্যাতনের শিকার হয়েও বেঁচে আছেন৷ সে বছর যৌতুকের মামলা হয় ১৫৮টি৷

ঐ একই কারণে ২০১৪ সালে ১৬৩ জন নারীকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়৷ আত্মহত্যা করেন ১১ জন৷নির্যাতন সইতে না পেরে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান একজন৷ আর ১২১ জন নির্যাতনের শিকার হয়েও বেঁচে আছেন৷ ২০১৪ সালে যৌতুকের মামলা হয় মোট ১৩৯টি৷

এই তিন বছরের যে তথ্য আসক দিয়েছে তা নির্ধারিত কিছু পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতেই দিয়েছে৷ কিন্তু বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ৷ সেটা বোঝা যাবে যদি আরেকটি সংগঠনের তথ্য তুলে ধরা যায়৷

সংগঠনটির নাম বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ৷ তাদের হিসেব অনুযায়ী, যৌতুকের কারণে ২০১৬ সালে ১৭৩ জন নারীকে হত্যা করা হয়৷ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৩৬২টি৷ আর নির্যাতনের শিকার হয়ে ন'জন নারী আত্মহত্যা করেন৷ সংগঠনটি বলছে, পাঁচ বছরে হত্যার শিকার হয়েছেন এক হাজার ১৫১ জন নারী৷ তাদের এই তথ্যও সুনির্দিষ্ট কিছু পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করেই করা হয়েছিল৷

২০১৬ সালে যৌতুকের কারণে আসক ১২৬ জন নারীকে হত্যা করার কথা বললেও, জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি বলছে ১৭৩ জন নারীকে হত্যার কথা৷ এর মানে হলো, তথ্য সংগ্রহের জন্য পত্রিকা বাড়ালে, বিশেষ করে আঞ্চলিক পত্রিকা অন্তর্ভুক্ত করলে এই সংখ্যা আরো বাড়বে৷ বলা বাহুল্য, এ ধরনের বহু ঘটনা কিন্তু সংবাদমাধ্যমেও আসে না৷

তাছাড়া এখানে যৌতুকের কারণে যে হত্যা আর নির্যাতনের তথ্য আছে, তা সবই বিয়ের পরের ঘটনা৷ কিন্তু যৌতুক না পেয়ে বিয়ের আসর থেকে বিয়ে না করে বরের চলে যাওয়া বা যৌতুকের টাকা না পেয়ে বিয়ে ভেঙে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে অনেক৷ হত্যা বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে মামলা হলেও যৌতুক না পেয়ে যারা বিয়ে ভেঙে দেয়, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার খবর পাওয়া যায় না৷

কুমিল্লার মুরাদনগর থানার টনকি ইউনিয়নের আন্তপুর গ্রামে গত ৮ মার্চ, অর্থাৎ নারী দিবেসে, যৌতুকের ৬০ হাজার টাকা না পেয়ে বিয়ে ভেঙে দেন বর রাসেল মিয়া৷ এরপর আত্মীয়স্বজন নিয়ে বাড়ি চলে যান তিনি৷ কনের পরিবার দরিদ্র হলেও দাবির মুখে বিয়ের আগেই একটি ফ্রিজ কিনে বরের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল৷ কিন্তু বিয়ের দিন বরের বাবা রবি মিয়া নগদ তাৎক্ষণিক ৬০ হাজার টাকা যৌতুক দাবি করেন৷ এ নিয়ে দু'পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতির এক পর্যায়ে বর বিয়ে না করে বেরিয়ে যান৷

‘নিজেদের জাহির করার জন্য, লোক দেখানোর জন্যও আজকাল যৌতুক দিয়ে থাকে’

একইভাবে মুন্সিগঞ্জে ২০১৬ সালের মে মাসে স্বপন মোল্লার মেয়ের বিয়ে ভেঙে যায়৷ বর শামীম ও তাঁর পরিবারে চাহিদা ছিল এক লাখ টাকা যৌতুক৷ এর মধ্যে আগাম ২০ হাজার টাকা যৌতুক দেয়া হয়েছিল৷ তার ভিত্তিতে বিয়ের কাবিনও হয়৷ কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে বাকি ৮০ হাজার টাকা না দিতে পারায় বরপক্ষ বিয়ে ভেঙে দিয়ে চলে যায়৷ এই ঘটনায় কনে অপমানে আত্মহত্যারও চেষ্টা করে৷

এ রকম আরো অনেক ঘটনার উদাহরণ দেয়া যায়৷ তাছাড়া বিয়ের পর যৌতুকের জন্য শুধু নির্যাতন এবং হত্যা নয়, কোনো কোনো যৌতুকলোভী তো স্ত্রীর সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত ভিডিও-ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এবং অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার মত ঘটনা ঘটায়৷

এ ধরনের একটি ঘটনায় ২৫ অক্টোবর মুজাহিদ নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার স্ত্রী নওগাঁর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে মামলা করেন৷ পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে ওই মামলায় মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ মামলায় মুজাহিদের বন্ধু নবাব আলী ও মিজানুর রহমানকেও আসামি করা হয়৷ মুজাহিদের সঙ্গে ওই নারীর গত বছরের ২০ নভেম্বর বিয়ে হয়েছিল৷ বিয়ের পর থেকেই দাম্পত্য জীবনের ব্যক্তিগত দৃশ্য গোপনে মোবাইল ফোনে ধারণ করে রাখতো মুজাহিদ৷ তারপর একটা সময় যৌতুক দাবি করে নির্যাতন শুরু করে সে৷ এতেও যৌতুকের টাকা না পেয়ে মুজাহিদ তার দুই বন্ধুর সহায়তার ভিডিওগুলো অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়৷

বাংলাদেশে যৌতুক না দিতে পারায় বিয়ের পর তালাকের ঘটনাও ঘটছে আকছার৷ এমনকি ১০ বছর সংসার করার পরও নারীকে যৌতুকের করণে তালাকের শিকার হতে হয়৷

যৌতুকের জন্য নির্যাতন এবং নিমর্মতা যে কত ভয়াবহ রকমের হতে পারে, তা হয়ত একটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে৷ ২০১৫ সালের ১৯ অক্টোবর ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ফারাশপুর গ্রামে তাসলিমা খাতুন ও তাঁর শিশু কন্যা তাসমিয়া ওরফে তাসনিমকে (১৮ মাস) পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করে তাসলিমা খাতুনেরই স্বামী কামাল৷

‘আমাদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এটা দূর করা সম্ভব নয়’

জানা যায়, তিন বছর আগে তাসলিমার বিয়ে হয়েছিল যশোরের লেবুতলা গ্রামের বাবুল হোসেনের ছেলে কামালের সাথে৷ বিয়ের পর থেকেই কামাল যৌতুক দাবি করে আসছিল৷ যৌতুকের কারণে তাসলিমাকে মারধরও করা হতো৷ এ কারণে এক সময় তিনি বাবার বাড়িতে চলে যান৷ এরপর কামাল হোসেন ফোন করে যৌতুকের টাকা দাবি করে৷ টাকা না দিলে পরিবারের সব সদস্যদের পুড়িয়ে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি দেয় কামাল৷ আর তারপরই ঘটে ঐ মর্মান্তিক ঘটনা৷

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান অ্যাডভোকেট সালমা আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যৌতুক এখন সমাজের সব পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে৷ নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত – সব বিয়েতে কনেপক্ষ যৌতুক দেবে, এটা যেন এখন একটা সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে৷ নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তরা যৌতুক অনেকটা গোপনে নিলেও উচ্চবিত্তের মধ্যে এখন যৌতুকের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে৷ মেয়ের বিয়েতে কে কত দিল, তা প্রকাশ করা এখন যেন সামাজিক স্ট্যাটাসে পরিণত হয়েছে৷''

সালমা আলী বলেন, ‘‘উচ্চবিত্তরা লেনদেন আর উপহারের নামে এই যৌতুক অব্যাহত রেখেছে৷ গাড়ি, বাড়ি, ছেলেকে ব্যবসার জন্য টাকা বা বিদেশে পড়ানো – এমন নানান ফর্মে এখন উচ্চবিত্তের মধ্যে যৌতুকের চল দেখা যাচ্ছে৷ অন্যদিকে নিম্নবিত্তের মধ্যে নগদ টাকা, টিভি, ফ্রিজ প্রভৃতি যৌতুক হিসবে নেয়ার চল রয়েছে৷ ভাবাখানা এমন যে, ছেলেকে এ সব তো দিতেই হয়!''

তাঁর মতে, ‘‘অনেকের হাতে এখন অনেক টাকা এসে গেছে৷ তাই তারা নিজেদের জাহির করার জন্য, লোক দেখানোর জন্যও আজকাল যৌতুক দিয়ে থাকে৷''

সালমা আলীর কথায়, ‘‘দেশে যৌতুক বিরোধী একাধিক আইন আছে৷ কিন্তু তার তেমন কোনো প্রয়োগ নেই৷ মামলা হলেও অধিকাংশ মামলায় বিচারই পাওয়া যায় না৷ তাই প্রয়োজন বাল্যবিবাহ বিরোধী প্রচারণার মতো ব্যাপক একটি প্রচারণা৷ এছাড়া প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ৷ সমাজে যারা যৌতুক নেয় এবং দেয় তাদের লজ্জার মুখে ফেলতে হবে৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘ইসলামে কিন্তু স্ত্রীকে দেনমোহর পরিশোধের কথা কথা হয়েছে৷ অথচ সেটা না করে যৌতুক আদায় করা হচ্ছে বাংলাদেশে৷''

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সমাজবিজ্ঞানী ড. মাহবুবা নাসরিন এ বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যৌতুকবিরোধী মনেভাব আজকাল লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তবে সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে৷ তাই এটাকে যৌতুকবিরোধী সামাজিক অবস্থান বলা যাবে না৷ সামাজিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থা আগের মতোই আছে৷ যৌতুক এখানে একটা প্রচলিত প্রথা হিসবে চলছিল, আজও চলছে৷''

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘দেশ নানা দিক থেকে এগিয়ে গেলেও, নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তেমন পাল্টায়নি৷ এখনও নারীকে পুরুষের সঙ্গে একই মর্যাদায় দেখা হয় না আমাদের দেশে৷ তাঁদের ক্ষমতায়ন হয়নি আজও৷ ফলে বিয়ের সময় যৌতুক দিতে হয়, দিতে বাধ্য করা হয়৷ আর পুরুষরা মনে করে, এটা তাদের পাওনা৷ আমাদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এটা দূর করা সম্ভব নয়৷''

বন্ধু, প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য