1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রাইন নদীতে আগুনের ফুলকি

৫ মে ২০০৯

দেখে এলেম ‘রাইন ইন ফ্লামেন’৷ ‘রাইন ইন ফ্লামেন’ অর্থাৎ রাইন নদীতে আগুনের ফুলকি৷ শুনলে মনে হয়, নদীর মধ্যে থেকে উঠে আসা আগুন৷ এ আবার কেমন কথা! নিজের চোখে না দেখলে সত্যি বিশ্বাস হয় না এ দৃশ্য৷

https://p.dw.com/p/HkDr
রাইন নদীতে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যে প্রমোদতরীগুলো চলাচল করে তাদের মালিক সমিতির সবাই মিলে আয়োজন করে এই উৎসব৷ছবি: dpa - Bildfunk

প্রতিবছর মে মাসের প্রথম শনিবার লিনৎস থেকে বন শহরের মধ্যে বয়ে যাওয়া রাইন নদীর বাঁকে বাঁকে উদযাপন করা হয় ‘রাইন ইন ফ্লামেন'৷ অপূর্ব আতশবাজি দিয়ে রাঙানো হয় রাইনের আকাশ৷ আর এ সময় ৭৫টি যাত্রীবাহী প্রমোদতরী রাইন নদীর উপর দিয়ে ভেসে যায়৷ মূলত এই প্রমোদতরীর যাত্রীদের উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হলেও পুরো বন শহরের মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে৷ এমনকি জার্মানির দূর-দূরান্তের শহর থেকে মানুষ এসে হাজির হয় রাইন নদীর পারে, এই অপূর্ব আতশবাজি দেখতে৷

রাইন নদীতে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যে প্রমোদতরীগুলো চলাচল করে তাদের মালিক সমিতির সবাই মিলে আয়োজন করে এই উৎসব৷ উৎসবের দিন প্রমোদতরীগুলোতে যাত্রার ভাড়া অনেক বেড়ে যায়৷ জনপ্রতি যাত্রীর ভাড়া ৬০ থেকে ৮০ ইউরো৷ সারাটি দিন ধরে যাত্রীরা রাইন নদীর উপর জাহাজে চেপে ঘুরবে, আমোদ করবে এবং রাত নামলে আকাশে আতশবাজির রঙিন খেলা দেখবে৷ এই আয়োজনে যোগ দেয় বন শহরের পৌর কর্তৃপক্ষ৷ তারা রাইন নদীর পাড়ের গ্রামগুলোতে আয়োজন করে মেলা আর কনসার্টের৷ উল্লেখ্য, লিনৎস আর বন ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলেও ‘রাইন ইন ফ্লামেন' পালন করা হয়৷ যেমন এবছরের জুলাই মাসের প্রথম শনিবারে নিদারহাইম বাইখ থেকে বিনগেন/ রুইডিশহাইম পর্যন্ত পালন করা হবে এই আতশবাজি উৎসব৷ আগষ্ট মাসের প্রথম শনিবারে স্পে থেকে কোবলেন্স পর্যন্ত৷ মূলতঃ মাসের প্রথম শনিবারকে প্রাধান্য দিয়ে রাইন নদীবর্তী পালন করা হয় ‘রাইন ইন ফ্লামেন'৷

Rhein in Flammen
মূলতঃ মাসের প্রথম শনিবারকে প্রাধান্য দিয়ে পালন করা হয় ‘রাইন ইন ফ্লামেন'৷ছবি: dpa

‘রাইন ইন ফ্লামেন'কে ঘিরে রাইন নদীর আশেপাশের এলাকায় চলে নানা উৎসব৷ লিনৎস থেকে কোয়িনিগ্সভিন্টার, তারপর রাইনাউ পার্কের পুরোটা জুড়ে মেলা বসে৷ সারাদিন ধরে মানুষজন নদীর পাড়ে জায়গা দখল করতে শুরু করে৷ কেউ কেউ আবার খাবার দাবার নিয়ে উঠে যায় ড্রাখেনফেলসের পাহাড়ে৷ রাতের বেলা পাহাড়ের উপর বসে আতশবাজি দেখে৷

সকাল সাড়ে নটায় আমিও অন্যদের মতো কোয়িনিগ্সভিন্টারে রাইনের পাড়ে বসি এই আতশবাজি দেখতে৷ আতশবাজি শুরু হওয়ার কথা রাত ১০টা থেকে৷ অপেক্ষার প্রহর যেন কাটেনা৷ রাত ১০টার দিকে দেখতে পেলাম সাত পাহাড়ের অদূরে বিশাল আলোর ছটা৷ অর্থ্যাৎ লিনৎস-এ শুরু হয়ে গিয়েছে আতশবাজি৷ লিনৎস-এর বাঁক পার হয়ে জাহাজগুলো এগিয়ে আসছে কোয়িনিগ্সভিন্টারের দিকে৷ কোয়িনিগ্সভিন্টারে জাহাজ আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো আতশবাজির খেলা৷ উন্নয়নশীল বাংলাদেশের মেয়ে আমি৷ এত সুন্দর আর এত বড় আকারের আতশবাজি আমি কখনো দেখিনি৷ সাফ গেমসের প্রথম আসরে বাংলাদেশে আতশবাজি দেখানো হয়েছিলো৷ আবছা মনে পড়ে আমার৷ কিন্তু এই আতশবাজির কাছে তা নস্যি মাত্র৷ আধ ঘন্টা ধরে প্রমোদতরীগুলো কোয়িনিগ্সভিন্টারের রাইন এলাকা পাড়ি দেয় এবং ঝরতে থাকে আগুনের ফুলকি ধারা৷ মনটা একটু খারাপ হয়ে যায় আশেপাশের মানুষের কথা শুনে৷ এক একটা আতশবাজির যে দাম শুনলাম তাতে বাংলাদেশের একটা সাধারণ পরিবারের খাবার খরচ অনায়াসে উঠে যায়৷

এত আনন্দে নিজের মন খারাপ ভাবটা কখন যেন হারিয়ে যায়৷ জাহাজগুলো চলে যাওয়ার পর দেখি লোকজন দৌড়ে গিয়ে ট্রামে উঠছে৷ শুনলাম এরপর নাকি রাইনাউ পার্কে ঝরবে আতশবাজির বৃষ্টি৷ প্রমোদতরীগুলো সেখানেই যাচ্ছে৷ মানুষজনের পিছে পিছে আমিও দৌড়ে উঠি ট্রামে৷ গিয়ে দেখি লাখো মানুষ দাড়িয়ে আছে রাইনাউ পার্কের কাছে ব্রীজে৷ ব্রীজে দাঁড়াবার স্থান নেই৷ ছুটলাম পার্কের দিকে৷ আমাকে আর কষ্ট করতে হলোনা৷ মানুষের ভীড়ের ধাক্কায় পৌঁছে গেলাম পার্কের ভিতর রাইন নদীর পাড়ে৷ পৌঁছে অপেক্ষা করতে হলোনা৷ শুরু হয়ে গেল আতশের ভেলকিবাজি৷ আমি বাকরুদ্ধ হয়ে ঘাড় বাঁকা করে এই সৌন্দর্য উপভোগ করছি৷ একসময় ঘাড় ব্যাথা হয়ে গেল তবু আতশবাজি থামেনা৷ কখনো হৃদয় হয়ে ভাসে, কখনো বা নক্ষত্রের মেলা৷ যখন থামলো আতশবাজি, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ১২টা৷

আতশবাজি শেষ হয়ে গেলেও শেষ হয়না উৎসব৷ রাইনাউ পার্কের একটু উপরে উঠলেই দেখা যায় বিশাল মেলা বসেছে৷ নগর কর্তৃপক্ষের আয়োজিত মেলা৷ মেলায় বিভিন্ন ধরনের স্টল বসেছে, বসেছে নাগর দোলা, ঝুলন্ত বিমান আর খাবার দোকান৷ জার্মানির লোকজন পান করছে বিভিন্ন ধরনের পানীয়৷ এতো বোতল মাঠে জমেছে যে মনে হচ্ছিল মাটিতে কেউ বোতলের চাষ করছে৷ কিছু লোকজনকে দেখলাম প্রতিযোগিতা করে বোতল কুড়াচ্ছে কারণ বোতল জমা দিলে পাওয়া যাবে আটটি সেন্ট৷ একশ বোতল কুড়ালে নাকি পাওয়া যাবে একটু বেশি অর্থাৎ একশো ইউরো৷ মেলার একপাশে বসেছে কনসার্ট৷ তরুণ-তরুণীরা গানের সঙ্গে উত্তাল নৃত্যে মত্ত৷

এত কিছু দেখতে দেখতে ক্লান্ত আমি একসময় ঘরে ফিরতে শুরু করলাম৷ ফিরতে চাইলেই সহজে ফেরা যায়না সেখান থেকে৷ বের হতে হয় লাইন ধরে৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা সবাইকে লাইন ধরিয়ে ধীরে ধীরে বের করছে৷ এক ঘন্টা ধরে লাইন ধরে বের হই মেলার বাইরে, পৌঁছাই ট্রামস্টপের ধারে৷ আধ ঘন্টা পর যখন ট্রামে চড়তে পারি তখন বাজে রাত আড়াইটা৷ আমি ঘরে ফিরছি তাই বলে ভাটা ধরেনি মেলায়৷ রাইনাউ পার্কের মেলা চলে সারা রাত ধরে৷ চোখ বুজলেই বৃষ্টির ধারার মতো আতশবাজির ফুলকি দেখতে পাই৷ সত্যি এরই নাম ‘রাইন ইন ফ্লামেন'৷

প্রতিবেদক: ফারজানা কবীর খান, সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক