1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রাজনৈতিক আস্থাহীনতা ও চৈনিক কর্তৃত্ববাদ

যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলের সাংবাদিক
যুবায়ের আহমেদ
১২ জানুয়ারি ২০২৪

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সবসময়ই একে অপরের অ্যান্টি ন্যারেটিভে কাজ করেছে৷ তারা একে অপরকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে৷ এটাই দেশটির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দুর্বলতা৷

https://p.dw.com/p/4bAyS
সরকারি দলের লোকেরাই সংসদ বিরোধিতার একটি কাঠামো তৈরি করলে সেই সংসদের দিকে তাকিয়ে কেউ যদি একে চৈনিক গণতন্ত্রের বাংলাদেশি মডেল বলে ফেলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না৷
সরকারি দলের লোকেরাই সংসদ বিরোধিতার একটি কাঠামো তৈরি করলে সেই সংসদের দিকে তাকিয়ে কেউ যদি একে চৈনিক গণতন্ত্রের বাংলাদেশি মডেল বলে ফেলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না৷ছবি: Jia Qing/HPIC/picture alliance

বাংলাদেশ কি চৈনিক গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে? অর্থাৎ, দল অনেক, কিন্তু নেতা এক৷ এবারের নির্বাচনে নৌকা মার্কার প্রার্থীরা যেমন দলের সভাপতির দোয়া-আশীর্বাদ কামনা করে লড়াই করলেন, তেমনি লাঙল বা ঈগল প্রার্থীরাও নৌকার দলের সভাপতিরই আশীর্বাদ চাইলেন৷ ফলে চায়ের কাপের আড্ডায় কেউ একজন যখন চৈনিক গণতন্ত্রের সঙ্গে হুট করে তুলনা করে বসলেন, তখন একটু নড়েচড়ে বসতেই হয়৷

ঊনিশ শতকে চীনের গণতন্ত্র নিয়ে কাঁটাছেড়া হয়েছে ঢের৷ দেশটির নাম গণপ্রজাতন্ত্রী চীন৷ গণচীন বলে থাকেন অনেকে৷ চীনের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় গণ কংগ্রেস চীনের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ সংস্থা৷ গণ কংগ্রেসের স্থানীয় পর্যায়ের সদস্যেরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন৷

দেশটির বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, চীন একটি সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র এবং একটি জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব৷ চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপি সরকার চালানোর দায়িত্বে৷ রাজনীতি বিশ্লেষকেরা চীনকে কর্তৃত্ববাদী একদলীয় বা স্বৈরাচারী রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করলেও সেখানে আটটি ছোট রাজনৈতিক দল আছে৷ এসব দল বৈধ৷ তবে তারা সিসিপির রাজনৈতিক বিরোধিতা করতে পারে না এবং তাদের সিসিপির প্রাধান্য মেনেই রাজনীতি করতে হয়৷

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট অনেক ভিন্ন৷ বাংলাদেশের সংবিধান এমন কর্তৃত্ববাদী অধিকার কোন দলকে দেয় না৷ তবে নির্বাচনে অংশ নেয়া দলগুলোর সরকারি দলের পোষ্যতা শিকার এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর নামে সরকারি দলের লোকেরাই সংসদ বিরোধিতার একটি কাঠামো তৈরি করলে সেই সংসদের দিকে তাকিয়ে কেউ যদি একে চৈনিক গণতন্ত্রের বাংলাদেশি মডেল বলে ফেলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না৷

এরশাদের পতনের দিনগুলোতে রাজনীতির মাঠে জনতার স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, ১৯৯১-তে গণতন্ত্র ফেরার পর ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে বিজয়ী সরকারের পতনের আন্দোলন, কিংবা ২০০১ ও ২০০৮ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনগুলো সহিংসতা বা পেশীশক্তির প্রদর্শনের মঞ্চ হলেও সেগুলো জনগণের অংশগ্রহণে একটি আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক উৎসব ছিল৷ কিন্তু এরপর কী হলো?

২০১১ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় টার্নিং পয়েন্টের বছর৷ সে বছর বদলে গেল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা৷ চলতি সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল সে বছর থেকে৷ আর তার বিরোধিতা করে মুখে ফেনা তুলল আওয়ামী লীগের বিরোধী দলগুলো৷ বিএনপি নির্বাচন বর্জন করল৷

আজকে যে ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে এত কথা হচ্ছে, একটি অভূতপূর্ব নির্বাচনের মাধ্যমে চৈনিক গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করতে হচ্ছে, তার ভিত ২০১১৷ আর ২০১১-এর ভিত ২০০৬৷ কারণ নির্বাচন একটা প্রতিযোগিতা৷ সেই প্রতিযোগিতায় সবাই জিততে চায়৷ তাতে কোন সমস্যা নেই৷ সমস্যা হলো জিততে চাওয়ার প্রক্রিয়াটি নিয়ে৷ ২০০৬ সালে প্রচলিত ইয়াজউদ্দিনের সরকার গঠন ও আওয়ামী লীগের লগি বৈঠার আন্দোলন এবং এর ফলে একটি সেনা সমর্থিত অগণতান্ত্রিক সরকারের ‘রাজনীতি সংস্কার'-এর প্রচেষ্টা হলো৷ সেই সময়টা আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলের নেতাদেরই কাল হলো৷ তাই ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই বাতিল হওয়ায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলেরই স্বস্তি পাওয়ার কথা৷ কিন্তু তা হলো না৷ সরকারে থাকায় আওয়ামী লীগ নিজ সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সমস্ত সুযোগ পাবে বলে খুশি হলো৷ উলটো দিকে এমন সিদ্ধান্ত মানল না বিএনপি৷

সে সময় ‘ট্রেন ছেড়ে গেছে' বা ‘এক চুল নড়ব না' এমন হুমকি ধমকিতে হাসিনা-খালেদা রাজপথ গরম রাখলেন৷ বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করল বিএনপি৷ তাতে অভূতপূর্ব নির্বাচনের প্রথমটি দেখল দেশ৷ ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাশ করলেন৷ সে সময় বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে, বা এক দাবিতে অটল না থেকে, এবং আওয়ামী লীগ এক চুল সরে না আসার পরিস্থিতি  তৈরি না করে নির্বাচনকালীন সরকারের একটিসঠিক রূপরেখা নিয়ে দুই দল গঠনমূলক আলোচনা করে তার অধীন নির্বাচন করলে আজকে এই চৈনিক গণতন্ত্রের বাংলাদেশ মডেলের কথা শুনতে হতো না৷

এরপর এল ২০১৮৷ ‘রাতের ভোটের' এই নির্বাচনে ৯৬ ভাগ আসন পেল আওয়ামী লীগ৷ বিপুল কারচুপির অভিযোগ এলো৷ বিএনপি এবার অংশও নিল৷ কিন্তু মাত্র ছয়টি আসন কোনোভাবেই বিএনপিকে প্রতিনিধিত্ব করে না৷ বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল৷ ২০২৪ সালেও তাই তারা নির্বাচনে না যাবার সিদ্ধান্ত নিল, যদি তাদের এক দাবি প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের পদত্যাগ না মানা হয়৷ ২০১৮ সালের নির্বাচনের সমালোচনা ও বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার পথ সংকুচিত হওয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের চাপের কারণে এবার ভোট প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা জরুরি হয়ে পড়েছিল নির্বাচন কমিশন ও সরকারের জন্য৷ সে জায়গায় তাদের জন্য সবচেয়ে বড় অসুবিধা হত বিএনপি নির্বাচনে এলে৷ এক দফা দাবিতে আগের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ধারাবাহিকতায় ২৮ অক্টোবরও সমাবেশ করলো তারা৷ কিন্তু সেখানে সহিংসতার ঘটনা বদলে দিল পুরো চিত্র৷ বিএনপির হাজার হাজার কর্মীকে জেলে দিয়ে, শীর্ষ নেতাদের আটকে আওয়ামী লীগ পরিষ্কার করে দিল যে বিএনপিকে তারা নির্বাচনে চায় না৷ অথচ বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি এবার নির্বাচনে এলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ যেমন আরো বাড়ত এই নির্বাচনে, তেমনি আওয়ামী লীগও আরেকটি অভূতপূর্ব নির্বাচনের মডেল তৈরি করতে পারত না, যেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও তাদের নেতার নাম নেন, বিরোধীরাও নেন আর দলের মনোনীত প্রার্থীরাতো নেনই৷

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরের দলগুলোরও দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পাচ্ছে৷ জাতীয় পার্টি নখদন্তহীন পোষ্য দল হয়ে উঠেছে৷ বাকি দলগুলোরও কমবেশি একই অবস্থা৷ তাই আজ চৈনিক কর্তৃত্ববাদের বাংলাদেশি মডেল দৃশ্যমান৷ এর দায় সরকারি-বিরোধী সব দলেরই৷