‘রাজনৈতিক সহনশীলতা আশা করতে পারি, ভরসা পাই না’
৩০ ডিসেম্বর ২০২২আর এক বছর পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ সবকিছু মিলিয়ে বিদায়ী বছরটি কীভাবে পর করলাম, আর নতুন বছরে প্রত্যাশাই বা কী? এসব নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী৷
ডয়চে ভেলে : বিদায়ী বছরটি থেকে আমরা নতুন কী অর্জন করেছি?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : বিদায়ী বছরে দু'টি জিনিস হয়েছে, এক. পদ্মা ব্রিজের উদ্বোধন হলো৷ আর দুই. মেট্রোরেল চালু৷ এছাড়া রাজনৈতিক অঙ্গনটা তপ্ত হল৷ বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির একটা আত্মপ্রকাশ দেখলাম৷ বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, যানবাহনের খরচ বেড়েছে এগুলো ঘটেছে৷
বিদায়ী বছরে সামাজিক কোন পরিবর্তন আপনি লক্ষ্য করেছেন?
সামাজিক পরিবর্তন তো হঠাৎ করে চোখে পড়ে না৷ কিন্তু যেটা আমি বুঝতে পারছি, এই যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী তারা খুব বিপদে পড়েছে৷ মানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা অংশ নিচে নেমে গেছে৷ আরেকটা অংশ কোনমতে টিকে আছে কষ্ট করে৷ মধ্যবিত্ত শ্রেণীটা অনেক কষ্টে আছে৷ আর গরীব মানুষের যে কী হাল সেটা আমরা ধরতেও পারছি না৷ গরীব মানুষের সঙ্গে মধ্যবিত্তের যে যোগাযোগ সেটা অনেক কমে গেছে৷ সামাজিকভাবে মেরুকরণ ঘটছে৷ এটা আগেও ছিল কিন্তু সেটা বিদায়ী বছর অনেকটা বেড়েছে৷
সারা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দা ছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বিশ্ব মন্দায় বাংলাদেশও পড়েছিল৷ কিন্তু বাংলাদেশ খুব একটা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়েনি৷ এর মূল কারণ হচ্ছে এখানকার যে মেহনতি মানুষের শ্রম৷ তারা এর মধ্যেও বিদেশে গেছে, বিদেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠিয়েছে৷ তারা গার্মেন্ট খাতটাকে চালু রেখেছে, শুধু চালু রাখেনি, ভালোভাবেই চালু রেখেছে৷ মেহনতি মানুষের শ্রমের জন্যই কোন বড় বিপর্যয় ঘটেনি৷ কিন্তু মানুষের জন্য যেটা হয়েছে, দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়েছে৷ সমস্ত কিছুরই দাম বেড়েছে৷ চিকিৎসার দাম অনেক বেড়ে গেছে৷ ওষুধের দাম বেড়েছে৷ শুধু বিপর্যয় হয়নি মেহনতি মানুষের শ্রমের জন্য৷
রাজনৈতিক কোন পরিবর্তন কী আপনি লক্ষ্য করেছেন? ইতিবাচক বা নেতিবাচক?
ইতিবাচক একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, বিরোধী দল তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারবে৷ তার মধ্যেও তাদের উপর নানান ধরনের চাপ ছিল৷ পরিবহন ধর্মঘট হয়েছে৷ পরে দেখা গেল, সরকারের দিক থেকে সহনশীলতাটা কমে গেছে৷ যেটা আশা করা গেছিল, যে রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা উন্নত হবে সেটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলো না৷
বিদায়ী বছরে আমাদের ব্যর্থতা কী ছিল?
মূল ব্যর্থতা ছিল, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কোনো পরিকল্পনা ছিল না৷ দ্রব্যমূল্যটা মানুষকে খুবই বিপন্ন করেছে বলে আমার মনে হয়৷
শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা এগুতে পেরেছি, নাকি পিছিয়ে যাচ্ছি?
শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা মোটেই এগুতে পারিনি৷ অনেক ছেলে মেয়ে এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারিনি৷ আবার যে ফল প্রকাশ হয়েছে সেটা দেখেও বোঝা যাচ্ছে না যে, শিক্ষার গুণগত মান বেড়েছে৷ শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা এগুতে পারিনি৷
পরের বছরই তো জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ নির্বাচনি সংস্কৃতিতে কি কোনো পরিবর্তন আপনি আশা করেন?
আমরা সবসময় আশা করি৷ আমি নিজেও আশা করি পরিবর্তন হবে৷ কিন্তু কোন ভরসা করতে পারি না৷ আশা করতে পারি পরিবর্তন হবে, রাজনীতিতে সহনশীলতা আসবে এবং সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচন হবে৷ কিন্তু সেটা ভরসা করতে পারি না৷ যারাই ক্ষমতায় থাকে তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়৷ পরাজয় মানতে চায় না৷ পরাজয় হতে পারে সেই সম্ভাবনাটাও কেউ মানতে চায় না৷ এটা না মানলে বুর্জোয়া গণতন্ত্রটাও কাজ করে না৷ নির্বাচন তো গণতন্ত্রের একটা অংশ মাত্র৷ নির্বাচনটা কাজ করে না তখন যখন ক্ষমতাসীনরা মনে করে ক্ষমতায় থাকতেই হবে৷
নির্বাচন ঘিরে ইতিমধ্যে কূটনীতিকদের কিছু তৎপরতা আমরা দেখছি, এই তৎপরতাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এই তৎপরতা তো ভেতরের দূর্বলতার কারণেই৷ কূটনীতিকরা তো সব সময়ই প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করবে তাদের নিজেদের স্বার্থে৷ তারা পরছে বা সম্ভব হচ্ছে এই কারণে যে, ভেতরে যে রাজনীতি চলছে সেটা তাদের প্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে৷ সেই সুযোগটা তারা নিচ্ছে নিজেদের স্বার্থে৷ বাংলাদেশের স্বার্থে না৷
আমাদের মূল্যবোধের যে অবক্ষয় হচ্ছে, নতুন বছরে এ থেকে বের হওয়ার কোন পথ আপনি দেখেন কিনা?
আমাদের যে নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে সেটা অর্থনৈতিক কারণে৷ এর মূল কারণটা অর্থনৈতিক৷ এটা থেকে বের হয়ে আসতে হলে, যে ব্যবস্থার মধ্যে আমরা আছি উন্নয়নের এই ধারাটা ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে পারবে না৷ এই ধারাতে যত উন্নতি হবে, ততই বৈষম্য বাড়াবে৷ উন্নয়নের এই ধারাকে পরিত্যাগ করে, যে উন্নয়নের ধারাটা সার্বজনীন হয়, উন্নয়ন যাতে সবার কাছে পৌঁছায় সেই চেষ্টা করা দরকার৷ এই চেষ্টাটাই আবশ্যক বলে আমি মনে করি৷
আমরা যে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে দেখছি, সেটা কি উন্নয়নের ধারা?
বড় বড় যে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে সেটাকে উন্নয়ন বলা যাবে না৷ দৃশ্যমান এগুলো দেখে মনে হয় উন্নতি হচ্ছে৷ কিন্তু উন্নয়নের ফলটা তো পাওয়া যায় না৷ যেমন পদ্মা ব্রিজ চালু হল, এতে তো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হলো না৷ রাজধানী থেকে যে লোক বাইরে যাবে তা নয়, বরং বাইরের লোকই ঢাকায় বেশি করে আসছে৷ যে কারণে উন্নয়নটা মানুষের উপকারে লাগানোর জন্য যে ধরনের দুরদৃষ্টি দরকার সেটার অভাব দেখতে পাচ্ছি৷
নতুন বছরে আপনার প্রত্যাশা কী হবে?
একটা হল, রাজনীতিতে যেন সহিংসতা না বাড়ে৷ রাজনীতির ক্ষেত্রে যেন সহনশীলতা দেখা দেয়৷ রাজনীতি হল সবচেয়ে বড় ব্যাপার৷ সেখানে যদি সহনশীলতা দেখা দেয় সেটা আমাদের জন্য সুখকর হবে৷ এই সহনশীলতা সৃষ্টির জন্য উদ্যোগটা কিন্তু সরকারকেই নিতে হবে৷ সরকারের পক্ষ থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে যাতে সহনশীলতা বাড়ে৷ যাতে সবার বক্তব্য উপস্থাপন করার সুযোগ ঘটে৷ যেসব রাজনৈতিক দল আছে তারা যেন প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারে এবং তাদের যেন সেই সুযোগ থাকে৷