1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রোলাল্ড শার্বাটকে: পৃথিবীর তিন শ্রেষ্ঠ গিটার প্রস্তুতকারির একজন

৬ জুলাই ২০০৯

অনেকেই বলেন ইসারলোন শহরের আবহাওয়ার নাকি কোন চরিত্র বোঝা যায় না৷ ঠিক এমনটাই হলো সকালে যখন সেখানে পৌঁছলাম, তখন আকাশটা একটু মেঘলা ছিল৷ তারপর খটখটে রোদ্দুর৷ দুপুরের পর এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেল৷

https://p.dw.com/p/Ihx2
ছবি: Siegfried Schmidt

অদ্ভুত সুন্দর এক রোদের ছোঁয়া চারিদিকে৷ শান্ত এই শহরের সবচেয়ে পুরানো একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমার প্রথমেই মনে হলো ভেঙ্গে পড়বে না তো! দরজার খুঁজে তাতে টুং টাং শব্দের দরজাঘন্টা বাজাতেই একজন এসে দাঁড়ালো৷ মুখে তাঁর হাসি৷ ‘গুটেন টাগ' বা শুভ দিন বলে হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বললো

: আমি রোলাল্ড শার্বাটকে৷ আসুন ভিতরে আসুন৷

আমি একটু চমকালাম, আনন্দে৷ আমি রোলাল্ড শার্বাটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ বিশ্বের তিন শ্রেষ্ঠ গিটার প্রস্তুতকারীর একজন৷ শার্বাটকে কে বলা হয় গিটারের সুনিপুণ কারিগর৷ তাঁর গিটারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে৷ আর তা হলো বাজনা, একেবারে একশ ভাগ বাজবে, এতে কোন রকম সমস্যা থাকবে না৷ প্রকৃতির বাজনা যেন উঠে আসতে পারে গিটারে তার সকল ব্যবস্থাই তিনি করছেন৷

Gitarrenbauer Roland Scharbatke aus Iserlohn und seine Werkstatt Freies Format
বিশ্বের তিন শ্রেষ্ঠ গিটার প্রস্তুতকারীর একজন রোলাল্ড শার্বাটকছবি: Siegfried Schmidt

সিঁড়িটা কাঠের৷ দেয়ালটা ভাঙ্গাচোরা৷ এই আস্তানাই শার্বাটকের ষ্টুডিও, কারখানা, ভালোবাসার জায়গা৷ আমাকে দেয়ালটি দেখিয়ে বললেন

: বলুন তো কত হতে পারে এর বয়স?

: জানি না

: আন্দাজ করুন

: আর কত শ খানিক বছর হবে হয়তো!

: না আরও বেশী৷ শ তিনেক বছর তো হবেই৷

: গিটারের কাজ শুরু হলো কবে?

:সাংবাদিকতা রাখুন না৷ বরঞ্চ একটু গল্প করি

‘...গান শুনতে আমার বেশ ভালো লাগতো৷ এখানে ওখানে গিয়ে গান শুনতাম৷ দারুণ লাগতো সুরের ছোঁয়া, বাজনা৷ কিন্তু জানেন অদ্ভুত এক ভালোবাসা আমাকে ধরে রাখতো সেই গানের মধ্যে থাকা নানা ধরনের যন্ত্রের বাজনা৷ আমার জন্ম ১৯৫২ সালে৷ এই জার্মানিরই গোটা শহরে (টুরিঙ্গিয়া রাজ্য)৷ বাবার কর্মসূত্রে আমার বসবাস তখন সেখানে৷ কিন্তু সেই সময়ে আমার স্কুলের শুরু হলো সেখানে৷ সুন্দর বাদামি রঙের দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে আসার সময় আমি তাকিয়ে থাকতাম সবুজ পাহাড়ের দিকে৷ সেই সবুজ পাহাড়ের পায়ে চলা পথে ঘুরে ফিরে দেখতাম প্রজাপতি, মৌমাছি আর জানা না জানা পাখিদের গান৷ ১৯৫৯ সালে আমার বাবা মা চলে এলো ইসারলোনে৷ আমিও তাদের সঙ্গে৷ এখানে এসে আমার বেশ ভালো লেগে গেলো এখানকার মানুষদের৷ আস্তে আস্তে এখানেই বড় হচ্ছি৷ একটি বিষয় আমার বেশ মনে হতে লাগলো আর তা হলো আমি পেপার ওয়ার্ক করার চেয়ে হাজার গুণ পছন্দ করি হাতে কলমের কাজ৷'

Gitarrenbauer Roland Scharbatke aus Iserlohn und seine Werkstatt Freies Format
শাবার্টকের গিটারে কোন নাম লেখা থাকে না৷ কেবল গিটারের কুঠুরির মধ্যে থাকে ছোট্ট একটি কাগজের উপর প্যাঁচানো গোছানো একটি স্বাক্ষরছবি: Siegfried Schmidt

: তারপর

: আমার পড়া লেখা তাই হস্তশিল্প নিয়েই৷ স্কুলের সীমানা পেরনোর আগেই অর্থাৎ আমার ষোল বছরের সময়ে আমার শেখা হয়ে গেলো কাঠের কাজ৷ মানে এক কথায় বলতে পারেন ছুতোর মিস্ত্রী৷ কিন্তু এর উপর আমাকে নিতে হবে উচ্চ শিক্ষা৷ ঘড়ির কাটা এগিয়ে যায় যেভাবে, ঠিক সেভাবে একদিন এই বিষয়ে আমার মাষ্টার্সও হয়ে গেলো৷ ... এরপর রুটি রুজির সন্ধানে কাজে নেমে পড়লাম৷ আসবাব থেকে শুরু করে নানা ধরনের কাঠের কাজ৷

...এভাবেই যাচ্ছিলো রোলাল্ড শার্বাটকে এর জীবন৷ এরই মধ্যে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত পর্যন্ত৷ চিনে নিচ্ছেন পৃথিবীর কোন প্রান্তের কোন গাছের কাঠ কি রকম হয়৷ পাখি কোন গাছে বেশী বসে, সেই গাছের বাকলের রং কি, কেন আফ্রিকার সেই গাছের কাঠের রংটি কালো.. কেন ভারত উপমহাদেশের কাঠ শুকোতে সময় বেশী লাগে বা আমাজানের বিখ্যাত রেইন ফরেষ্টের কোন গাছের কাঠে বানানো যায় সবচেয়ে ভালো জিনিসটি... ইত্যাদি নানা তথ্য৷

‘সালটা ১৯৮৮৷ আমার জীবন নদীর বাঁক ঘুরে যাবার সময়৷ কাঠ নিয়ে কাজ করতে করতে করতে আবার আমার মনে পড়ে গেলো সেই ছেলেবেলার কথা, গানের কথা, বাজনার কথা৷ এতদিন যা মনের মধ্যে ছাই চাপা ছিল৷ পরিচয় হলো খ্যাত নামা গিটার প্রস্তুতকারী গেরল্ড কার্ল হানাবাখ এর সঙ্গে৷ তাঁর শরণাপন্ন হলাম৷ তিনি আমাকে নিয়ে নিলেন তার শিক্ষানবিশ হিসাবে৷ শুরু হলো সুরের জগতে আমার পথ চলা৷'

...রোলাল্ড শার্বাটকে নুরেমবার্গে বেশ ভালো ভাবেই শিক্ষা নিতে শুরু করলেন৷ অটোমেশিনে নয়, হাতে গিটার তৈরির৷ এক সময় গুরুর যোগ্য শিষ্যের তালিকার প্রথমে চলে এলো তার নাম৷ শুরু হলো আসল কাজ৷ ছেড়ে দিলেন আগের কাজ৷ ইসারলোনের সেই পুরানো বাড়িতে উঠলেন৷ ইতিমধ্যেই তাঁর কাজ, মানে প্রথম বানানো গিটারটিই পছন্দের শ্রেষ্ঠ তালিকায় চলে এলো৷ শুরু হলো একের পর এক অডার্র আসা৷ ভালো আর সঠিক বাজনা চাও তো শাবার্টকের গিটার! যে গিটারে কোন নাম লেখা থাকে না৷ কেবল গিটারের কুঠুরির মধ্যে থাকে ছোট্ট একটি কাগজের উপর প্যাঁচানো গোছানো একটি স্বাক্ষর৷

আরও কিছু তথ্য

শার্বাটকে বছরে ১২টির বেশী গিটার তৈরী করেন না৷ আর একটি গিটারের যদি তিনি অর্ডার নেন তাহলে তার সব কাজ শেষে গ্রাহককে দিতে সময় লাগে এক বছর৷ প্রতি মাসে তাঁর আগামীর জন্য তৈরী করা গিটারের সিরিয়ালে যোগ হয় একটি গিটারের ভ্রুণ৷ এরপর প্রতি মাসে তাতে যোগ হয় একটু একটু করে রক্ত মাংস৷ শাবার্টকের গিটারটি বলতে গেলে পুরোপুরি আন্তর্জাতিক৷ এর কোন অংশ আসে বিলেত থেকে, আবার কোন অংশ আসে সেই সুদূর আফ্রিকা থেকে৷ গিটারের বাজনায় সুনিপুণতা আনতে কেবল লোহা, গুনো কিংবা খুবই দুষ্প্রাপ্য গাছের কাঠই যে তিনি ব্যবহার করেন, তাই নয়, ব্যবহার করা হয় হাতির দাঁত কিংবা সেই শত বছরের পুরানো হারিয়ে ম্যামথের হাড়ও৷ কোথা থেকে আসে ম্যামথের হাড়?

Gitarrenbauer Roland Scharbatke aus Iserlohn und seine Werkstatt Freies Format
শার্বাটকে বছরে ১২টির বেশী গিটার তৈরী করেন নাছবি: Siegfried Schmidt

: পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আমার লোক আছে৷ যারা আমাকে ভালোবাসেন৷ গিটার বানাতে আমার যা যা প্রয়োজন সব কাঁচামালের যোগানদাতা তারাই৷ তারাই এগুলো আমার জন্য যোগাড় করে রাখেন৷ আমি সব কিছু একশ ভাগ নিরেট চাই৷ এখানে আমি কোন ছাড় দিই না৷

একেক ঋতুতে শার্বাটকে গিটারের একেক অংশের কাজ করেন৷ বৃষ্টির দিনে যে অংশের কাজ করেন সেটা খরখড়ে তাপের দিনে করেন না৷ আর এ সবের সঙ্গেই তিনি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন৷ তাঁর ষ্টুডিওর ব্যরোমিটারটিই যেন তাঁর নিয়ন্ত্রক৷ প্রতিটি কাজ তাকে করতে হয় সূক্ষ্মভাবে৷ আর এ জন্য তাঁর সূক্ষ্ম সব বড় ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি রয়েছে৷ কোনটাই অটোমেটিক নয়৷ খুব সন্তর্পণে শাবার্টকে -কে জিজ্ঞাস করি... একেকটি গিটারের দাম কত?

: দেখুন আমি ভালো জিনিস বানাই৷ ভালো এবং উন্নতমানের হাতের তৈরী এই গিটার৷ আমি একেকটি বিক্রি করি ১২ কে ১৫ হাজার ইউরোয়৷ আমার গিটারগুলোর প্রধান ক্রেতা আসে জাপান, কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে৷ এই তো কয়েকদিন আগে জাপানি এক ওয়েব সাইটে দেখলাম আমার একটি গিটার সেখানে বিক্রি হয়েছে ২২ হাজার ইউরোয়৷

শার্বাটকের গিটারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে৷ আর তা হলো এর মাথাটি একেবারে সোজা৷ মানে সোজা সাপ্টা সুর..... ভালো সুর, মধুর সুর৷

শার্বাটকের ঘরে কোন টেলিভিশন নেই৷ না, বাসা কিংবা ষ্টুডিও কোথায় নেই৷ টেলিভিশন মেধা কমিয়ে দেয় প্রায় হেসেই আমাকে কথাগুলো বলেন তিনি৷ এর আগে ছোট্ট কাঠের চেয়ারে বসে বাজাতে লাগলেন তাঁর সৃষ্ট গিটারটি৷ যে গিটারটি আমার কাছে এখনো খুব অচেনা ...

প্রতিবেদক: সাগর সরওয়ার, সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন