1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশের স্কুলশিক্ষার চেহারা

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৩ মার্চ ২০১৭

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো একক রূপ নেই৷ বাংলা মাধ্যমের সঙ্গে আছে ইংরেজি ও আরবি মাধ্যমে পড়াশোনা৷ পাঠক্রমও কোথাও এক নয়৷ ফলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার চোহারা কেমন – তা এক কথায় বলতে গেলে অন্ধের হাতি দর্শনের মতো হবে৷

https://p.dw.com/p/2Z3Ey
Organisation Shidhulai Swanirvar Sangstha in Bangladesh
ছবি: Getty Images

বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা – সবখানেই আছে সরকারি এবং বেসকারি ব্যবস্থা৷ আছে কম খবরচ আর খরচের লেখা-পড়া৷ এমনকি এখানে দেশি সিলেবাসে যেমন পড়াশোনা করা যায়, তেমনি পড়াশোনা করা যায় বিদেশি সিলেবাসে৷

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্ট – প্রাথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর এবং উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তর৷ সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয় পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক, সাত বছর মেয়াদি মাধ্যমিক – এর মধ্যে তিন বছর মেয়াদি জুনিয়র, দু'বছর মেয়াদি মাধ্যমিক এবং দু'বছর মেয়াদি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়৷'

বাংলাদেশে তৃতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি৷ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ৩৬টি পাবলিক ও ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-এর তত্ত্বাবধানে অধিভুক্ত কলেজের মাধ্যমে এ শিক্ষা দেয়া হয়৷ শিক্ষার্থীরা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা বা ইংরেজির মধ্যে যে কোনোটিকে বেছে নিতে পারে৷

Mojibor Rahman - MP3-Stereo

এটা কারা নিয়ন্ত্রণ করে? এর জবাবে বলা হচ্ছে, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় হলো শিক্ষার জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দপ্তর৷ এর অধীন কয়েকটি অধিদপ্তর রয়েছে৷ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের (শিক্ষা প্রকল্প ও কারিগরি প্রকল্প ) মাধ্যমে এ অধিদপ্তরসমূহের কার্যক্রম পরিচালিত হয়৷'

বাংলাদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন৷ বোর্ডগুলো তিনটি পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা করে: জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা,মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি)পরীক্ষা এবং উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি)পরীক্ষা।

উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলেজ হিসেবে পরিচিত৷ এছাড়া রয়েছে মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল৷ এগুলো যথাক্রমে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড এবং বিদেশি শিক্ষা বোর্ডের তালিকাভুক্ত৷ মাধ্যমিক পরবর্তী পর্যায়ে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ স্কুল পরিচালনার জন্য কারিগরি শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হয়েছে৷ কিন্তু কওমী মাদ্রাসাগুলো কারুর নিয়ন্ত্রণে নেই৷ তারা তাদের মতো করে পরিচালিত হয়৷

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই উন্নয়ন, অনুমোদন এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত৷ এছাড়াও ‘অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো'-র তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে অনেক অলাভজনক সংগঠন রয়েছে, যারা সামাজিক সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য অনানুষ্ঠানিক ও আধা-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে৷

বাংলাদেশে  সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় ৮২,৯৮২টি, মাধ্যমিক ৫৩,৫৮৯টি, নিম্ম মাধ্যমিক ৩,৪৪৯৪টি, মাদ্রাসা ৯,০১০৫টি এবং কলেজ ২,৩০০টি৷ এর বাইরে আছে মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷

সরকার ২০০৩ সাল থেকে সীমিত পর্যয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রম প্রবর্তন করে৷ ২০১৩ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল ছাত্র-ছাত্রীকে এই কর্মসূচীর আওতায় আনা হয়৷ এখন নতুন শিক্ষা বৎসর শুরুর আগেই ৩ কোটি পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে পৌঁছে দেয়া হয়৷

তবে এই পাঠ্যপুস্তক নিয়ে এবার বিতর্ক তৈরি হয়েছে৷ নানা ধরনের ভুল আর মৌলবাদী গোষ্ঠীর চাপে পাঠ্যপুস্তক থেকে অনেক প্রগতিশীল লেখকের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে৷

প্রথম শ্রেণির বাংলা পাঠ্য বইয়ে অক্ষরজ্ঞান সূচিতে পাঠ ১২-তে ‘ও' অক্ষর চেনানোর উপকরণ হিসেবে ‘ওড়নাকে' ব্যবহার করা হয়েছে৷ শুনি ও বলি পাঠে ‘ও' অক্ষর চেনাতে ওড়না পরা একটি কন্যাশিশুর ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে – ‘ওড়না চাই'৷

প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ের লেখা ও ছবিতে ‘ছাগল গাছে উঠে আম খাচ্ছে' বোঝাতে চেয়েছেন লেখক৷ বাংলা পাঠ্যবইটির ১১ পাতায় অ-তে অজ (ছাগল) বোঝাতে গিয়ে ছাগলের ছবি জুড়ে দেয়া হয়েছে৷ ছাগলের গাছে উঠে আম খাওয়ার মতো অসম্ভব বিষয় শিখতে হবে শিশুদের৷

তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের আদর্শ ছেলে কবিতা বিকৃত করা হয়েছে৷ ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে' না লিখে লেখা হয়েছে ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে?' এছাড়া ‘মানুষ হইতে হবে' – এই তার পণ না লিখে ‘মানুষ হতেই হবে' – এই তার পণ লেখা হয়েছে৷ ‘হাতে প্রাণে খাট সবে শক্তি কর দান'৷ এই লাইনে ‘খাট' শব্দটিকে বিকৃত করে লেখা হয়েছে ‘খাটো'৷

এছাড়া চতুর্থ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়' বইয়ের ৭৮ পাতায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ লেখায় মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি কখনো ‘মুক্তিযুদ্ধ' আবার কখনো ‘মুকতিযুদ্ধ'৷ ‘বঙ্গবন্ধু' বানানটি ভেঙে ঙ-গ আলাদা আলাদা করে লেখা৷

অষ্টম শ্রেণির ‘আনন্দপাঠ' বইটির সাতটি গল্পের সবগুলোই বিদেশি লেখকদের গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে লেখা বা সেগুলির ভাষাগত রূপান্তর করা হয়েছে৷ গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে – আরব্য উপন্যাস অবলম্বনে ‘কিশোর কাজী', মার্ক টোয়েনের ‘রাজকুমার ও ভিখারির ছেলে', ড্যানিয়েল ডিফোর ‘রবিনসন ক্রুশো', ফরাসি উপন্যাসিক মহাকবি আবুল কাশেম ফেরদৌসীর ‘সোহরাব রোস্তম', উইলিয়াম শেকসপিয়ারের ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস', ওয়াশিংটন আরবি রচিত গল্প অবলম্বনে ‘রিপভ্যান উইংকল' এবং লেভ তলস্তয়ের ‘সাড়ে তিন হাত জমি'৷ এটা নিয়ে সমালোচনা করেছেন অনেকেই৷ আবার হুমায়ূন আজাদসহ অনেক লেখকের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে৷ বাদ দেয়া হয়েছে কয়েকজন ‘হিন্দু লেখক'-এর লেখাও৷ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার না লিখে লেখা হয়েছে বাংলাদেশ সরকার৷

বাংলাদেশে একটি সার্বজনীন শিক্ষানীতির দাবি আছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই৷ ২০১৬ সালে শিক্ষানীতির একটি খসড়াও শিক্ষামন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়৷ খসড়ায় শিক্ষার চারটি স্তর রাখা হয়েছে – প্রাক-প্রাথমিক (৪ থেকে ৬ বছর), প্রাথমিক (প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম), মাধ্যমিক (নবম থেকে দ্বাদশ) এবং উচ্চশিক্ষা (দ্বাদশ শ্রেণি থেকে স্নাতক ও তদুর্ধ) স্তরের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকসহ প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক এবং এই শিক্ষা শিশুর অধিকার হিসেবে গণ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷

ইংরেজি মাধ্যমসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি সরকারের অনুমোদন ছাড়া নির্ধারণ করা যাবে না৷ আইন লঙ্ঘন করলে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা এক বছরের কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে আইনে৷ ইংরেজি মাধ্যমের প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলা ও বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয় পড়ানো হবে বাধ্যতামূলক৷ এই খসড়ায় কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা বলা হয়েছে৷

Rasheda K Chowdhury - MP3-Stereo

শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘‘সংবিধান সবার জন্য শিক্ষা এবং সমশিক্ষার কথা বলেছে৷ কিন্তু আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে নানা ধরনের বৈষম্য দেখি৷ শিক্ষার ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ লক্ষ্যণীয়৷ অবকাঠামো, আর্থিক এবং বিষয়গত বৈষম্য শিক্ষাকে সার্বজনীন করতে পারিনি৷''

তিনি বলেন, ‘‘তাই আমরা শিক্ষা আইনের দাবি করে আসছি৷ শিক্ষা সবার জন্য এবং সার্বজনীন করতে হলে শিক্ষা আইন জরুরি৷ ভারতেও শিক্ষা অধিকার আইন আছে৷ বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসায় কী পড়ানো হয় তা কেউ জানে না৷ এটা তো হতে পারে না৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে প্রয়োজন কমিশন৷ কারুর চাপে বা আগ্রহে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন নয়, পাঠ্যপুস্তক প্রঁয়ন হবে শিক্ষানীতির আলোকে৷''

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাই আছে ১০ ধরনের৷ সুধু তাই নয়, একই শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিকে কেউ পড়ছে দেশের কথা, কেউ লন্ডন-অ্যামেরিকার কথা৷ আবার কেউ বা পড়ছে আরব দেশের মরুভূমির কথা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মো, মজিবুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘সংবিধানে সবার জন্য একই মানের শিক্ষার কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু শিক্ষার শুরুতেই নানা শ্রেণির নানা ধরন৷ ফলে এই শিক্ষা দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে তোলে না৷ এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে৷''

তাঁর কথায়, ‘‘আবার এটাও ঠিক যে প্রত্যেকের অধিকার আছে তার পছন্দের শিক্ষা নেয়ার৷ কিন্তু এর মানে এই নয় যে, নানারকম শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে বিভেদ সৃষ্টি করা৷ শিক্ষা সমাজে যদি শ্রেণি পার্থক্যের সৃষ্টি করে, তা ভালো শিক্ষা হতে পারে না৷''

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য