1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

স্বাধীনতা পেলেও মুক্তি মেলেনি

২২ জানুয়ারি ২০১১

চোখের সামনে গোয়েন্দা কর্মকর্তা বাবার হত্যাকাণ্ড আর দাদাকে হত্যা করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখার মতো ঘটনা যুদ্ধে নিয়ে যায় ডা. লায়লা পারভীন বানুকে৷ দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেন তিনি, দেন প্রশিক্ষণ৷

https://p.dw.com/p/100aq
Female, Freedom, Fighter, Dr, Laila, Parvin, Banu, Mediterranian, Sea Savar, Bangladesh, ১৯৮১, ১৯৭১, মুক্তিযোদ্ধা, ডা, লায়লা, পারভীন, বানু, স্বাধীনতা, মুক্তি, বাংলাদেশ, যুদ্ধ,
১৯৮১ সালে ভূমধ্যসাগরের তীরে মুক্তিযোদ্ধা ডা. লায়লা পারভীন বানুছবি: Dr. Laila Parvin Banu

১৯৪৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার ধর্মদহ গ্রামে প্রগতিশীল পরিবারে জন্ম ডা. লায়লা পারভীন বানুর৷ মা আনোয়ারা রহমান এবং বাবা আজিজুর রহমান৷ বর্তমানে সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও এনাটমি বিভাগের প্রধান৷

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস৷ ডা. বানু তখন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী৷ বাবা আজিজুর রহমান ছিলেন পুলিশের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিদর্শক৷ ২৬ মার্চ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও রাজশাহী শহর ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে৷ এর পরদিনই এক ভয়াবহ করুণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন ডা. বানু৷

১৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮টা৷ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার রাজশাহী অফিসের সামনে এসে থামে হানাদার বাহিনীর ট্রাক৷ ট্রাক থেকে নেমে আসে নরপিশাচরা৷ একে একে পাঁচজন অফিসারকে টেনেহিঁচড়ে অফিসের সামনেই লাইন করে দাঁড় করায়৷ ওই পাঁচজনের মধ্যে তাঁর বাবাও ছিলেন৷ নিমেষেই গর্জন করে উঠল মেশিনগানগুলো৷ লুটিয়ে পড়লেন সবাই৷ ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন তাঁর বাবা ও গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক৷

এই করুণ কাহিনীর কথা স্মরণ করে ডা. বানু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাবার লাশ পাশে রেখে আহতদের চিকিৎসা আমাকেই করতে হয়েছে৷ কিন্তু লাশ দুটি ফেলে রাখা হলো দুই দিন৷ দাফনের উদ্যোগ নিল না কেউ৷ অফিসের ভেতরে বাগানে এনে লাশ দুটি দাফন করার অনুরোধ জানিয়ে ঘুরতে লাগলাম সবার কাছে৷ কেউ রাজি হলো না৷ সে মুহূর্তে নিজের প্রাণ বাঁচানোটাই সবার কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছিল৷ বাবার লাশ দাফন না হওয়া, চোখের সামনে পচে যেতে দেখা কী যে অসহনীয় এক অভিজ্ঞতা ছিল তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়৷ ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যা পর্যন্ত ওখানেই পড়ে ছিল লাশ দুটি৷ সন্ধ্যার পর লাশভর্তি ট্রাক নিয়ে উপস্থিত হলো পাকিস্তানি সেনারা৷ কিন্তু লাশ দুটি ট্রাকে না উঠিয়ে রাস্তার পাশেই অল্প জায়গায় গর্ত খুঁড়ে একসঙ্গে মাটিচাপা দিল৷ তাঁদের দাফনও হলো না৷ আমার চোখ ফেটে পানি এল৷’’

Freiheitskämpferin Dr. Laila Parvin Banu mit ihrem Ehemann Dr Shafiqul Alam in the last convocation of the university, Savar, Bangladesch
২০১১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে স্বামী ডা. শফিকুল আলমের সাথে মুক্তিযোদ্ধা ডা. লায়লা পারভীন বানুছবি: Dr. Laila Parvin Banu

১৬ এপ্রিল কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নিলে রাজশাহীর সাগরপাড়ায় নিজেদের বাড়িতে চলে যান লায়লা পারভীন বানু৷ ১১ মে পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন৷ এরপর গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার ধর্মদহ গ্রামে চলে যান তাঁরা৷ গ্রামটি ছিল সীমান্তের কাছে মাথাভাঙা নদীর পাড়ে৷ এ সময় প্রতিদিন শত শত শরণার্থী এই সীমান্ত দিয়ে ভারতে পার হয়ে যেত৷ ডা. বানু এই শরণার্থীদের চিকিৎসা সেবা, খাবার ও পানির ব্যবস্থা করতেন৷ এ সময় থেকে প্রতিদিনই পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে আসতে শুরু করে৷ শুরু হয় যুদ্ধ৷ নদীর এপারে পাকিস্তানি সেনা আর ওপারে মুক্তিসেনার মধ্যে দিনের বেলা চলতে থাকে গুলিবিনিময়৷

২৪ মে পাকিস্তানি সেনারা সব গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ এরপরই আরো এক হৃদয় বিদারক ঘটনার খবর আসে ডা. বানুর কাছে৷ খবর পান, তাঁর দাদা পিজার উদ্দীন মন্ডলের লাশ লুঙ্গি প্যাঁচানো অবস্থায় গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা৷ বাবা ও দাদার এমন করুণ মৃত্যুই তাঁকে যুদ্ধে অংশগ্রহণে বেশি করে উৎসাহ জোগায়৷

ছোট ভাইকে নিয়ে ভারতের করিমগঞ্জে চলে যান যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য৷ জুনের প্রথম দিকে গোবরা ক্যাম্পে হাজির হন ডা. বানু৷ সেখানে সেবামূলক, আত্মরক্ষামূলক ও প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নেন৷ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ঐ ক্যাম্পে মেয়েদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন৷ তিনি সেখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন৷

সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন ডা. লায়লা পারভীন বানু৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘প্রশিক্ষকরা ক্লাস নিয়ে চলে যাওয়ার পর মেয়েদের সব কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর৷ এ ছাড়া সেবামূলক প্রশিক্ষণের জন্য মেয়েদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, কোনো মেয়ে অসুস্থ হলে চিকিৎসা করা, প্রয়োজনে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং ক্যাম্পের জন্য দরকারি ওষুধপত্র নিয়ে আসা ইত্যাদি কাজ করতে হতো আমাকে৷ দেশ স্বাধীনের পর আমি আবার রাজশাহী সরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা শুরু করি৷ ১৯৭৬ সালে এমফিল করার জন্য পিজি হাসপাতালে আসি৷ তখন একবার সাভারের মির্জানগরে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার পরিবেশ দেখে, বিশেষ করে তাদের ‘গ্রামে চলো, গ্রাম গড়ো’ স্লোগানে মুগ্ধ হই৷ সরকারি চাকরি ছেড়ে সে বছরই গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই৷’’

যে প্রত্যাশা নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন ডা. লায়লা পারভীন বানু, তার কতোটা পূরণ হয়েছে - এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটা স্বাধীন দেশ, একটা ভূখণ্ড, একটা পতাকা পেয়েছি, কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণে জাতির জনক যে বলেছিলেন যে, এটা আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম৷ আমরা দ্বিতীয়টা পেয়েছি৷ অর্থাৎ স্বাধীনতা পেয়েছি কিন্তু মুক্তি এখনও আমরা পাইনি৷ তাই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য এখনও যুদ্ধ করে যাচ্ছি আমরা৷’’

প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য