1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মানবাধিকার যেখানে সংকুচিত

হাসান ইমাম
৭ জানুয়ারি ২০১৯

২০১৮ সালটি শুরু হয়েছিল বিশ্ব রাজনীতির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে৷ জানুয়ারিতে চিরবৈরী উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সম্প্রীতির আবহ তৈরি হয়৷ এই বন্ধুপ্রতিম প্রবণতা দেশ দুটি অব্যাহত রাখে সারা বছর৷

https://p.dw.com/p/3B8v3
Bilder des Jahres - Proteste
ছবি: picture-alliance/AP Photo/K. Hamra

আর গত ১২ জুন সিঙ্গাপুরে মুখোমুখি আলোচনার টেবিলে বসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন, যা ছিল বিশ্ববাসীর জন্য চমক৷ তবে একে অপরের চক্ষুশূল এই দুই দেশের মোলাকাত তেমন কোনো ফল বয়ে আনেনি৷ তা সত্ত্বেও এই বৈঠককে গত বছরের অন্যতম ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া চলে৷ এর মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে চরম সংকট কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে৷

তবে মার্চের শুরুতে ইতালিতে উগ্র ডানপন্থিদের বিপুল বিজয় শরণার্থী-অভিবাসী সম্প্রদায়সহ মহাদেশীয় উদার গণতন্ত্রীদের মধ্যে আশঙ্কার জন্ম দেয়৷ রাশিয়ায় মার্চে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভ্লাদিমির পুটিন আরেক দফা নির্বাচিত হন৷ একই মাসে চীনের শি জিনপিং সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করে নেন৷

মে মাসের শুরুতে ট্রাম্প আরো বড় খবরের জন্ম দেন ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে৷ এটি ছিল তাঁর অ্যামেরিকা ফার্স্ট' নীতির প্রতিফলন৷ একই মাসে ইসরায়েলের মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেওয়া হয় জেরুসালেমে৷ এর ফলে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিরোধ আরো তীব্রতা পায় এবং ট্রাম্প যথারীতি সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখেন৷

বছরভর যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যবিরোধ জিইয়ে থাকায় বিশ্ব অর্থনীতি নুতন করে ঝুঁকির মুখে পড়ে৷একুশ শতকের শুরুতেই বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান অর্থনীতি হিসেবে চীনের উত্থান ঘটলেও বিদায়ী বছরে দেশটি হয়ে উঠল যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর প্রতিপক্ষ৷ট্রাম্পের ভাষায়, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের জন্য রাশিয়ার চেয়েও বড় শত্রু চীন৷'' যদিও রুশ-মার্কিন বৈরিতা ব্রিটেনে রুশ নাগরিক সের্গেই স্ক্রিপালের নার্ভ গ্যাস হামলার শিকার হওয়ার জেরে আরো প্রকট হয়৷ সের্গেই যুক্তরাজ্যে নিজের দেশের তথ্য পাচার করতেন বলে অভিযোগ৷ তাঁকে হত্যাচেষ্টার পর পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার কূটনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়৷ সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকে যেভাবে বিদ্যমান অবস্থার বিপরীতে নিয়ে গেছেন, তাতে গোটা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়েই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে৷ জাতীয় স্বার্থের কথা বলে জাতিসংঘের ‘জলবায়ু চুক্তি' থেকে এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র৷ অথচ বলা হচ্ছে, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে ব্যর্থ হলে বিপদ থেকে রেহাই পাবে না কেউই৷ এরই মধ্যে গত বছর ইউরোপের খরা থেকে শুরু করে অ্যামেরিকার দাবানল, এশিয়ার প্রবল বৃষ্টিপাত ইত্যাদি চরম আবহাওয়ার জোরালো আলামত দিয়ে গেছে৷ জাতিসংঘের ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-র বিজ্ঞানীদের মতে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখতে না পারলে বিপর্যয় অনিবার্য৷

যে জাতীয় স্বার্থের জিগির তুলে ট্রাম্প বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন বিশ্বকে, তার পালে জাতীয়তাবাদী হাওয়া, কেন্দ্রে অভিবাসনবিরোধী প্রবণতা৷ আর এই জাতীয়তাবাদী প্রবণতার মূলে রয়েছে বর্ণবাদ৷ ট্রাম্প তো বলেও দিয়েছেন, অভিবাসনে তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু আফ্রিকা বা ক্যারিবীয় দেশগুলো থেকে কাউকে চান না৷ তাঁর পছন্দ নরওয়ের মতো দেশ, যেখানকার ৯৪ শতাংশ মানুষ শ্বেতাঙ্গ৷ আফ্রিকার কয়েকটি দেশকে ট্রাম্পের ‘শিটহোল কান্ট্রিজ' বলার বিষয়টি কেউ বিস্মৃত হয়নি৷

হাসান ইমাম
হাসান ইমাম, লেখক ও সাংবাদিক ছবি: Sazzad Hossain

ইউরোপেও বর্ণবাদী জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে পড়েছে৷ যুক্তরাজ্য অভিবাসীদের প্রবেশ ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে৷ যদিও গত ৭ জুলাই ঘোষিত ‘ব্রেক্সিট' পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে৷

অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, এমনকি ‘উদারনৈতিক' সুইডেনেও বর্ণবাদী প্রবণতা মাথা চাড়া দিচ্ছে৷ বর্ণবাদী জাতীয়তাবাদের সমান্তরালে উত্থান ঘটছে কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্বেরও৷ কেবল ইউরোপ বা উত্তর অ্যামেরিকা নয়, কর্তৃত্ববাদী শাসকদের কবলে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন অ্যামেরিকার অনেক দেশও৷ ইউরোপে বর্ণবাদ রাজনীতির ‘ট্রাম্পকার্ড' হলে বাদবাকি বিশ্বে ক্ষমতা দখলের ‘হাতিয়ার' হলো ধর্ম, ধর্মের নামে বিভক্তি৷ মিয়ানমারেও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভক্তি, যার পরিণতি রোহিঙ্গা সংকট৷ এক অর্থে, গত বছর কর্তৃত্ববাদের বিস্তারে দেশে দেশে গণতন্ত্র কোণঠাসা হয়ে পড়ে৷ তবে মালয়েশিয়ায় প্রধানমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের পতন, মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনকে হটানোও সম্ভব হয়েছে জনতার সম্মিলিত আন্দোলনে৷

গত অক্টোবরে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের ভেতর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সাংবাদিক জামাল খাশোগজি৷ প্রথমদিকে সৌদি সরকার এ কথা অস্বীকার করলেও পরে কবুল করতে বাধ্য হয়৷ তবে দেশটি এখনো পরিষ্কার করেনি কার নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড৷

ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস (আইএফজে)-এর হিসাবে, ২০১৮ সালে সারা বিশ্বে খাশগজির মতো ৯৪ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে৷ ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮২৷

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে বাংলাদেশে গত বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন চার শতাধিক মানুষ৷ এছাড়া নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ‘গুজব' ছড়ানোর অভিযোগে আটক হন খ্যাতিমান আলোকচিত্রী শহিদুল আলম৷ ১০৮ দিন পর কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়া শহিদুলকে টাইম সাময়িকী ২০১৮ সালের আলোচিত চরিত্র ‘দ্য গার্ডিয়ান্স অ্যান্ড দ্য ওয়ার অন ট্রুথ' তালিকায় স্থান দিয়েছে৷

গত বছর মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে সমর্থ হলেও ‘স্বৈরতান্ত্রিক দেশ'-এর তালিকায়ও ঢুকে পড়ে বাংলাদেশ৷ বিশ্বের ১২৯টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে গবেষণা করে জার্মান গবেষণা সংস্থা ব্যার্টেল্সমান ফাউন্ডেশন এক প্রতিবেদনে ৫৮টি দেশকে স্বৈরতন্ত্রের অধীন এবং ৭১টি দেশকে গণতান্ত্রিক বলে উল্লেখ করেছে৷ প্রতিষ্ঠানটির মতে, ‘ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স ২০১৮' সূচকে নীচে নেমে যাওয়া ১৩টি দেশের মধ্যে ৫টি দেশ আর গণতন্ত্রের নূন্যতম বৈশিষ্ট্যও ধারণ করে না৷ তাদের মতে, ওই ৫টি দেশ হলো বাংলাদেশ, লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া ও উগান্ডা৷

গবেষণা সংস্থাটির এই মূল্যায়নের ভিত্তি ১২৯টি দেশের গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থা নিয়ে করা সমীক্ষা৷ এই সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি করা সূচকে বাংলাদেশের সঙ্গে ৮০ নম্বরে অবস্থান করছে রাশিয়াও৷

রিপোর্টার উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) গত বছরের গোড়ায় বলেছিল, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে মাত্র ৯ শতাংশ দেশের অবস্থা ‘ভালো' এবং ‘মোটামুটি ভালো' ১৭ শতাংশ দেশ৷ অর্থাৎ বাকি ৭৪ শতাংশ দেশের অবস্থা খারাপ, এর মধ্যে ১২ শতাংশ দেশের পরিস্থিতি ‘ভয়াবহ'

দেশে দেশে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের দিকে নজর রাখা ফ্রিডম হাউস হিসাব কষে বলছে, বিশ্বের মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ ‘মুক্ত গণমাধ্যমের' দেশে বাস করে৷ আর গণমাধ্যম ‘মুক্ত নয়' এমন দেশে বসবাসকারী মানুষ ৪৫ শতাংশ৷

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বৈশ্বিকভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথা বাকস্বাধীনতা হরণের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন এবং সেগুলোর যথেচ্ছ ব্যবহার৷ এ পটভূমিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আচরণকে প্রমাণ হিসেবে হাজির করা যেতে পারে৷ তাঁর ভাষায়, ‘গণশত্রু' গণমাধ্যম ‘ফেক নিউজ' প্রচার করে৷ ট্রাম্পের মতো একই মানসিকতার শাসকের অভাব নেই বিশ্বে৷ রাশিয়ার পুটিন, তুরস্কের এর্দোয়ান, ফিলিপাইন্সের দুতার্তে, মিসরের জেনারেল সিসি, চেক প্রজাতন্ত্রের জিমান প্রমুখ ‘উজ্জ্বল' উদাহরণ৷

অর্থাৎ ক্রমাগতভাবে দৃশ্যত গণতান্ত্রিক, কিন্তু কার্যত কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিস্তার ঘটছে বিশ্বে৷ তুরস্ক থেকে রাশিয়া, ভিয়েতনাম থেকে বলিভিয়া— যেখানেই জনগণের কণ্ঠরোধী শাসনের বিস্তার ঘটছে, সেখানেই ক্ষমতাসীনরা সিভিল সোসাইটির বিরুদ্ধে, গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে, ভিন্নমতের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত৷

গত ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৭০ বছর পূর্ণ হলো৷ অথচ ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকারের নিশ্চয়তার বিষয়টি এখনো হুমকির মুখে৷ দেশে দেশে চলছে গণহত্যা, জাতিগত নিধনযজ্ঞ৷ মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী ও সংঘবদ্ধ বৌদ্ধ অধিবাসীদের অভিযান এর চরমতম দৃষ্টান্ত৷ মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া ও ইয়েমেনের মতো দেশগুলোতে ধুঁকছে মানবতা৷ দুর্ভিক্ষের কবলে লাখ লাখ মানুষ৷ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের ভূমির অধিকার৷ একই ভাগ্য বরণ করছে ভারতের কাশ্মীরের অধিবাসীরাও৷ সম্প্রতি এ তালিকায় যোগ হয়েছে চীনের উইঘুর জাতিগোষ্ঠী৷

হাসান ইমামের লেখাটি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য চাই৷ তাই লিখুন নীচের ঘরে৷