1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ধর্ম, ট্যাবু ও বিবাহ বন্ধন

১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

প্রায় সব ধর্মেই বিয়ে এবং এর আচার অনুষ্ঠানকে এখন অনেকেই কেবল সামাজিকতা হিসেবেই দেখে থাকেন৷ কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইনের দৃষ্টিতে বিয়ে এখন অনেকটাই উদার হলেও, সমাজ কি সেই সাথে তাল মিলিয়ে ততদূর এগিয়েছে?

https://p.dw.com/p/2jdJX
Symbolbild Hochzeit Ehe Indien Pakistan
ছবি: Fotolia/davidevison

দক্ষিণ আফ্রিকায় অ্যাপারথাইড বা বর্ণবাদ নিয়ে লেখা একটা বই পড়ছিলাম৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি লেট নাইট টিভি শো-এর উপস্থাপক এবং জনপ্রিয় স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান ট্রেভর নোয়ার লেখা বইটির নাম ‘বর্ন আ ক্রাইম'৷ বাংলায় এর অনুবাদ করা যেতে পারে, ‘জন্মই যার পাপ'৷

বইটিতে নিজের জীবনের নানা ঘটনার মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে অদ্ভুত সম্পর্ককে তুলে ধরেছেন লেখক৷ কালো চামড়ার মানুষদের সাথে সাদা চামড়ার কারও বিয়ে ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ৷ এখানে ভালোবাসার কোনো দাম ছিল না৷ ফলে আইন অমান্য করে জন্ম নেয়া ট্রেভর নোয়াকে শৈশবের পুরোটাই কাটাতে হয়েছে সবার চোখ এড়িয়ে ‘পালিয়ে থাকার' মনোবৃত্তি নিয়ে৷

ভারতীয় উপমহাদেশেও বর্ণপ্রথা, সতীদাহ নিয়ে কম আন্দোলন হয়নি৷ রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং আরো নামিদামি ব্যক্তি এগিয়ে আসার ফলে অমানবিক এসব প্রথা বাতিল হয়েছে৷ অন্তত আইনত হয়েছে৷ একসময় অল্প বয়সে বিধবা হলে বাকি জীবন মেয়েদের কাটাতে হতো একা৷ বন্ধ হয়েছে সেটিও, চালু হয়েছে বিধবাবিবাহ আইন৷ 

কিন্তু আইন করে অনেক কিছুর বৈধতা দেয়া গেলেও, বাস্তবে সমাজে তাঁর প্রভাব পড়ে কতটুকু?

‘জাত গেল জাত গেল বলে, একি আজব কারখানা' – লালন সাঁইয়ের এই গানটা অনেকেরই মুখে মুখে ঘোরে, কিংবা ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব, জাত জালিয়াত খেলছ জুয়া' – নজরুলের এই কবিতারই বা মর্মার্থ আমরা বাস্তব জীবনে কতটা অনুভব করি?

ধর্মের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র গঠন করার মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব' কতটা অকার্যকর, বাঙালি তা প্রমাণ করেছে সেই ১৯৭১ সালেই৷ কিন্তু তারপরও উলটো পথেই হাঁটছে দেশ৷

ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়েছিলাম, বিয়ের মাধ্যমে পরিবার গঠিত হয়৷ আর সেই পরিবারই হচ্ছে সমাজের সবচেয়ে ছোট ইউনিট৷ সেই ইউনিট আস্তে আস্তে বড় হয়ে সমাজ, দেশ এবং মানবজাতিতে পরিণত হয়৷ ফলে গোড়ায় গলদ থাকলে সে গলদ নিয়ে গড়ে ওঠা সমাজ গোটা মানবজাতিতে কী প্রভাব ফেলবে, সহজেই অনুমেয়৷ গলদটা কি? সে কথাতেই আসছি৷

রাষ্ট্র যেভাবে একটি সীমানা দিয়ে নাগরিকদের এক জায়গায় আবদ্ধ করে রাখতে চায়, ধর্মও তেমনি কিছু সুনির্দিষ্ট নীতি ঠিক করে দিয়ে অনুসারীদের আবদ্ধ রাখতে চায়৷ এটা খুবই স্বাভাবিক৷ যতই আমরা সীমানাবিহীন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি না কেন, সে স্বপ্ন সুদূর পরাহত৷ কিন্তু পাশের মানুষটির সাথে আমার যে দেয়ালটুকু, সেটুকু দূর করার পদক্ষেপ এখনই শুরু করা উচিত৷

শুরুটা হয়েছিল সেই ১৮৭২ সালে৷ তখন ভারতবর্ষ ইংরেজ দখলদারদের অধীনে৷ রাজা রামমোহন রায়ের মতো কিছু সমাজ সংস্কারক ধর্মের মতো ভয়াবহ আগুন নিয়ে খেলার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ও পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাথে নিয়ে শুরু করেন ধর্ম সংস্কার৷

নানা ধর্ম পাঠ করে, সব ধর্মের কুসংস্কার বাদ দিয়ে চালু করেন ব্রাহ্ম সমাজের৷ জাতপ্রথা বিলোপ হয়, নারীমুক্তি ও নারীশিক্ষা আন্দোলন চাঙ্গা হয়৷ তবে এই আন্দোলনের বড় অর্জন হিসেবে ১৮৭২ সালে পাশ হয় সিভিল বিবাহ আইন৷ এই আইনের অধীনে, যে কোনো ধর্মের ছেলে বা মেয়ে, অপর ধর্মের ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে করার যে বাধা, তা দূর হয়৷

শুধু তাই নয়, যুগের বিবেচনায় বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়া হয় এই আইনে৷ এই আইনে কাউকেই নিজের ধর্ম বা বিশ্বাস পালনে বাধ্য করা যাবে না৷ স্বামী বা স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় কেউ আবার বিয়ে করতে পারবে না৷ অর্থাৎ কেবলমাত্র ডিভোর্সের পরই আবার বিয়ে করার সুযোগ থাকছে৷ বেঁধে দেয়া হয় পাত্র-পাত্রীর সর্বনিম্ন বয়সও৷

মনে রাখবেন, সেটা ছিল ১৮৭২ সাল৷ বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানে কেউ এই আইনের দাবি তুললে তাঁর সে দেশে বসবাস তো দূরের কথা, বেঁচে থাকাটাও ছেড়ে দিতে হতো ভাগ্যের হাতে৷ 

ব্রাহ্মসমাজ আর কার্যকর না থাকলেও বাংলাদেশে বাতিল হয়নি এই আইন৷ ১৮৭২ সালের এই আইন সংশোধন করা হয় ২০০৭ সালে৷ প্রাণেশ সমাদ্দার নামে এক ব্রাহ্ম প্রচারক ছিলেন দেশের একমাত্র বিশেষ বিবাহ আইনের রেজিস্ট্রার৷ কয়েক বছর আগে তিনি মারা যাওয়ার পর যাতে আর কাউকে নিয়োগ না দেয়া হয়, সে নিয়ে আন্দোলনও করেছেন সমাজের এক অংশ৷

কিন্তু তারপরও বাড়ছে বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ের সংখ্যা৷ ১৯৮৩ সাল থেকে পাঁচ শতাধিক দম্পতি নিজ নিজ ধর্ম পরিবর্তন না করেই বিয়ে করেছেন৷ না, তাঁরা কোনো অনাচারে জড়াননি৷ জাতি, ধর্ম, দেশ কিছুই ধ্বংস হয়ে যায়নি৷

রাষ্ট্র আইন করে এই ব্যবস্থা কোনোরকমে টিকিয়ে রাখলেও সমাজ কিন্তু ঠিকই তার প্রতিশোধ নিচ্ছে৷ এতটাই যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই দম্পতিদের থাকতে হচ্ছে সমাজচ্যূত অবস্থায়, একঘরে হয়ে৷ ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, মাদকসেবন, ঘুস, দুর্নীতির মতো আন্তঃধর্ম বিয়েকেও দেখা হয় একটি অপরাধ হিসেবে৷ পার্থক্য একটিই, অন্যসব অপরাধ আইনের হাতে ছেড়ে দিলেও এই অপরাধটিকে সমাজ তুলে নেয় নিজের হাতে৷

সারা জীবন সততা, একাগ্রতা, নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাওয়া একজন মানুষকেও কোনো অপরাধ না করা সত্ত্বেও দাঁড়াতে হয় সমাজের আদালতে৷ ‘সর্বজনস্বীকৃত' ‘নামিদামি' দুর্নীতিবাজদের দায়িত্বে দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান, সংস্থার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত আছি৷ তাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারলে আমরা ধন্য হই৷ কিন্তু বিপত্তি বাঁধে যখন তা এসে দাঁড়ায় বিয়ের কথায়৷

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ‘যাঁর বিয়ে তাঁর হুঁশ নাই, পাড়া পড়শির ঘুম নাই'৷ এই প্রবাদটি মনে হয় এই অবস্থার ব্যাখ্যাতেই সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে৷ পরিবারটা যাঁদের হতে যাচ্ছে, ভবিষ্যত জীবনটা যাঁদের একসাথে কাটাতে হবে, তাঁদের বাদ দিয়ে বাজারে পণ্য দামদরের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়েন সমাজের কর্তাব্যক্তিরাই৷ পরামর্শ, উপদেশ, আর বাধ্য করার মধ্যে ফারাকটা নিশ্চয়ই আমাদের সবারই জানা৷ 

পরিচিত এক ব্যক্তি বলছিলেন, ‘‘চাকরি না পেয়ে অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটালাম, কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করল না৷ বিয়ের সময় ঠিকই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল সমালোচনার ঝাঁপি নিয়ে৷'' ব্যক্তিটির নামটা সংগত কারণেই প্রকাশ করলাম না৷ সমাজচ্যূত হওয়ার ভয় কার না আছে?

Anupam Deb Kanunjna DW-Bengali Service
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: Privat

জার্মানির মতো দেশেই এমন এক নারীর কথা জানি, যিনি পরিবারের অমতে তুর্কি নাগরিককে বিয়ে করায় ২৫ বছর ধরে দিন কাটাচ্ছেন ত্যজ্য অবস্থায়৷ বাংলাদেশে কি অবস্থা তা সহজেই অনুমান করা যায়৷ ভারত ও পাকিস্তানে তো পরিবারের ‘সম্মান রক্ষার' নামে ‘অনার কিলিং' নামের বর্বর কাজও ঘটে থাকে৷

এই সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা ‘আলাদা', আমরা ‘সেরা' ধরনের যে মনোভাব তৈরি হচ্ছে, তা কি হিটলারের নাৎসিবাদী ‘আর্যরাই সেরা' চিন্তাভাবনা থেকে কোনোভাবে আলাদা? সব ধর্মেই ‘মানুষকে' বলা হয়েছে ‘সৃষ্টির সেরা জীব', শুধু এক ধর্ম বা মতের ব্যক্তিদের নয়৷

আগুনের ধর্ম তাপ উৎপাদন করা৷ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে তা সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে, আবার নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে তা দিয়ে রান্নাও করা যায়৷

মানুষের ধর্ম ভালোবাসা৷ তবে তার কাজ আগুনের বিপরীত৷ ভালোবাসা ছড়িয়ে দিলে সৃষ্টি হয় অপূর্ব এক পৃথিবীর, নিয়ন্ত্রণ করলে হয়ে ওঠে বিধ্বংসী৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷