1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অরগ্যানিক পণ্য নিয়ে সংশয় কাটাবে কে?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাংলাদেশে অরগ্যানিক চাষাবাদে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে৷ বাড়ছে অরগ্যানিক পণ্যের চাহিদা৷ গড়ে উঠছে খামার৷ কিন্তু এখানে সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদকরা পড়ছেন বিপাকে৷ সাধারণ মানুষ নিশ্চিতই হতে পারছেন না কোনটা অরগ্যানিক৷

https://p.dw.com/p/2jFhq
ছবি: DW/M. Mamun

২০০৩ সালে আব্দুস সালামের জীবনে একটি সুযোগ আসে৷ তিনি নরওয়েতে অরগ্যানিক বরবটি রপ্তানির সুযোগ পান৷ নরওয়ের ক্রেতা বলেছিল, বরবটি এক ইঞ্চি করে কেটে প্যাকেটজাত করে ফ্রোজেন ভেজিটেবল হিসেবে পাঠাতে হবে৷ সব প্রস্তুতির পরও তাঁর আশা এবং উৎসাহে পানি ঢেলে দেয় বাংলাদেশের নিয়ম৷ এখানে অরগ্যানিক ফুডের কোনো সার্টিফিকেশন বডি নেই৷ কিন্তু নরওয়ের ঐ ক্রেতা সার্টিফিকেশন ছাড়া বরবটি নেবেন না৷ তারপরও হাল ছাড়েননি আব্দুস সালাম৷ চেষ্টা করেন বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ এনে সার্টিফিকেশন নিতে৷ যোগাযোগ করে দেখেন মুম্বই থেকে বিশেষজ্ঞ ঢাকায় এনে এই অরগ্যানিক সার্টিফিকেট নিতে সে সময় খরচ হতো সাড়ে ছয় লাখ টাকা৷ লাভ-লোকসান হিসেব করে তাই সেবার আর নরওয়েতে অরগ্যানিক বরবটি রপ্তানি করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে৷

কিন্তু এরপরও তিনি অরগ্যানিক খাদ্য উৎপাদন থেকে সরে যাননি৷ বরং সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করেন৷ গড়ে তোলেন বাংলাদেশ অরগ্যানিক প্রোডক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিওপিএমএ)৷ এরইমধ্যে তারা সরকারের মাধ্যমে অরগ্যানিক ফুড পলিসি করাতে সক্ষম হয়েছেন৷ আশা করছেন, সার্টিফিকেশন বোর্ডও হয়ে যাবে অচিরেই৷

বিওপিএমএ-র সভাপতিও আব্দুস সালাম৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এখন অন্তত ৭০টি বৃহৎ কৃষি ফার্ম আছে, যারা অরগ্যানিক ভোগ্যপণ্য উৎপাদন করে৷ এছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে কয়েক হাজার চাষী এ মুহূর্তে অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত৷''

‘সার্টিফিকেশনের সুবিধা না থাকায় রপ্তানির সুবিধাও কম’

তিনি জানান, ‘‘শাক-সবজি, মাছ-মাংস-ডিম-ফল সবই এখন অরগ্যানিক উৎপাদনের আওতায় এসেছে৷ কিন্তু এর দাম বেশি৷ সে কারণেই মানুষের আগ্রহ কম৷ আর সার্টিফিকেশনের সুবিধা না থাকায় রপ্তানির সুবিধাও কম৷ তাই প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে জিএম (জেনেটিক্যালি মডিফায়েড) পণ্যের সঙ্গে৷''

তাঁর দাবি, ‘‘এরপরও বাংলাদেশের মোট কৃষি এবং কৃষিপণ্যের ১০-১২ ভাগ অরগ্যানিক৷'' তিনি জানান, ‘‘কৃত্রিম সার ও কীটনাশক ছাড়া জৈব সার এবং জৈব কীটনাশক দিয়ে এ সমস্ত অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদন করা হয়, যা সুস্থ শরীরের জন্য অপরিহার্য৷''

অরগ্যানিক চাষাবাদের সমস্যা হচ্ছে, জৈব সার ও জৈব কীটনাশকের অভাব৷ আগে এটা উৎপাদনের বাধা ছিল৷ কিন্তু সেই বাধা দূর হয়েছে৷ এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাগেরহাটের ফকিরহাটে বেতাগা অরগ্যানিক পল্লি৷ ২০১৩ সালে কয়েকজন কৃষককে সমবেত করে মাত্র ২৫ একর জমিতে অরগ্যানিক চাষাবাদ শুরু করেন ঐ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান স্বপন দাস৷ এখন সেখানে ১০০ একর জমিতে অরগ্যানিক চাষাবাদ হচ্ছে৷ ৭০ জন কৃষক কাজ করছেন সেখানে৷ আরো অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন৷ স্বপন দাস ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা মূলত কৃষকদের অরগ্যানিক চাষাবাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি৷ তাঁদের জন্য জৈব সার উৎপাদন করছি৷ জৈব সার উৎপাদনের একাধিক প্ল্যান্ট করেছি আমরা৷ আমাদের এসব কাজে সার্বক্ষণিক সহায়তা করছে স্থানীয় কৃষি অফিস৷''

‘এটা একটা সমস্যা যে ক্রেতারা অরগ্যানিক কৃষি পণ্য চিনবেন কীভাবে?’

রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই লাউ, ঝিঙে, পটল, উচ্ছে, করলা, ডাঁটাশাক, পুঁইশাক, শসা, চিচিঙ্গা, শসা, বেগুন, আলু, টমেটো, সূর্যমুখী, থাইপেয়ারা ও মাল্টার চাষ হচ্ছে সেখানে৷ গবাদি পশু পালন হচ্ছে৷ অরগ্যানিক দুধ আসছে ঢাকার বাজারেও৷ শুরু হবে মৎস চাষ৷ এইসব অরগ্যানিক পণ্য বাজারজাত করার জন্য আলাদা একটি বাজারও স্থাপন করা হয়েছে৷ কৃষকদের পরামর্শ দিতে স্থাপন করা হয়েছে কৃষি ও তথ্য সার্ভিস সেন্টার৷

স্বপন দাস জানান, ‘‘নেপালের কাঠমান্ডুর অরগ্যানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এখানে পরিবেশবান্ধব শাক-সবজির আবাদ করা হচ্ছে৷ আমি ইউরোপের কয়েকটি দেশ এবং ভারতে অরগ্যানিক চাষাবাদ দেখে উদ্বুদ্ধ হই৷ আমি চেয়েছি সবাই যেন এতে উদ্বুদ্ধ হয়৷ তাই সবাইকে নিয়ে কাজ করছি৷ এতে একদিকে যেমন কীটনাশক থেকে পরিবেশ রক্ষা পাচ্ছে, অপরদিকে স্বাস্থ্য সম্মত খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে৷''

ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ অরগ্যানিক এগ্রিকালচারাল মুভমেন্ট-এর (আইএফওএএম) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩৪টি এনজিও তাদের সদস্য৷ এর মধ্যে ৪৭টি এনজিও সরাসরি অরগ্যানিক কৃষিকাজ করে৷ ৮৭টি টেকসই কৃষি নিয়ে কাজ করে এবং তিনটি কৃষি সংক্রান্ত অ্যাডভোকেসির সঙ্গে জড়িত৷

তাঁদের মতে, বাংলাদেশে মোট ০ দশমিক ১৭৭ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে অরগ্যানিক চাষাবাদ হয়, যা মোট চাষযোগ্য জমির শতকরা ২ ভাগ৷ প্রশিকা এই অরগ্যানিক চাষাবাদে সবচেয়ে এগিয়ে৷

‘আমরা মূলত কৃষকদের অরগ্যানিক চাষাবাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি’

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. গোলাম মারুফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা অরগ্যানিক কৃষিকে উৎসাহিত করি৷ তবে এ নিয়ে আমাদের আলাদা কোনো শাখা নেই৷ আমাদের নীতি হচ্ছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক যত কম ব্যবহার করা যায়৷ বিটি ব্রিঞ্জেল তারই উদাহরণ৷'' এছাড়া অরগ্যানিক পণ্যের সার্টিফিকেশন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘হ্যাঁ, এটা একটা সমস্যা যে ক্রেতারা অরগ্যানিক কৃষি পণ্য চিনবেন কীভাবে? তারা কীভাবে নিশ্চিত হবেন? এ জন্য আমাদের কাজ চলছে৷ আমরা আশা করি, এই সার্টিফিকেশন এখানেও চালু হবে৷''

বাংলাদেশের অরগ্যানিক চা বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে৷ পঞ্চগড়ের কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের চা এখন নিয়মিত বিক্রি হয় লন্ডনের হ্যারড্স ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে৷ এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের প্রতিনিধি দল অরগ্যানিক চা চাষ পদ্ধতি সরোজমিনে পরিদর্শন করে এর কোয়ালিটি যাচাই করে তারপর এই চায়ের অর্ডার দেয়৷ এখানকার অরগ্যানিক চা চাষের বৈশিষ্ট্য হলো কোনো প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় না৷ অরগ্যানিক চা চাষের জন্য এখানে গরুর একটি খামার গড়ে তোলা হয়েছে৷ খামারের জৈব সার ব্যবহার করে এখানে সাতটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট গড়ে উঠেছে৷ আর চা ভ্যালিতে ইপিল-ইপিল গাছ ব্যবহার না করে হারবাল ঔষধি গাছ শেড ট্রি হিসেবে ব্যবহার হয়৷ যেমন – নিম, হরিতকি, আমলকি, বহেরা, নিশিন্দা ,কাঞ্চন, অর্জুন প্রভৃতি৷

‘দাম একটু বেশি হলেও ক্রেতারা ধীরে ধীরে অরগ্যানিক খাদ্যের দিকে ঝুঁকছেন’

কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট ছাড়াও টিটিসিএল (তেঁতুলিয়া টি কর্পোরেশন লি.), স্যালিনা টি এস্টেট, করতোয়া টি এস্টেট, ডাহুক টি এস্টেটে অরগ্যানিক চা উৎপন্ন হচ্ছে৷

বাংলাদেশের আমও এখন ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে যাচ্ছে৷ এ সমস্ত আম অরগ্যানিক৷ এর পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া অরগ্যানিক কিনা, তা মনিটর করেন ক্রেতারাই৷ তাছাড়া এখন অরগ্যানিকভাবে মাছ, গবাদি পশু এবং হাস-মুরগির চাষও হচ্ছে৷ অরগ্যানিক ডিম, মাংস সহজেই পওয়া যাচ্ছে৷

ঢাকার বেশ কিছু চেইনশপ ছাড়াও অনেক ছোট ছোট দোকান গড়ে উঠেছে, যেখানে অরগ্যানিক কৃষিপণ্য বিক্রি হয়৷ তাদের কেউ কেউ নিজেরাই অরগ্যানিক শাক-সবজি উৎপাদন করেন৷ আবার কেউ কেউ কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন অরগ্যানিক চাষাবাদে৷

অরগ্যানিক চাষাবাদে উৎপাদন কিছুটা কম হয়৷খরচ একটু বেশি, তাই এর দামও একটু বেশি৷ কিন্তু বিষমুক্ত, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার চাইলে একটু বেশি দাম দিতেই হবে বলে মনে করেন বিওপিএমএ-র আবুল কালাম আজাদ৷ তিনি বলেন, ‘‘অরগ্যানিক বিডি লিমিটেড নামে আউটলেটের মাধ্যমেও আমরা বিক্রি করি, আবার চেইন শপেও দেই৷ কিন্তু মানুষ এখনো অরগ্যানিক বলে বিশ্বাস করতে চায় না৷ এই বিশ্বাসের জন্য দরকার সার্টিফিকেশন৷ সার্টিফিকেশন অথরিটি হলে বাংলাদেশের অরগ্যানিক পণ্য দেশের বাইরে অনেক বড় বাজার পাবে৷''

‘শরীরের কথা চিন্তা করলে, এই বেশি দাম আমাদের দিতেই হবে’

বাংলাদেশ রিসার্চ সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) অরগ্যানিক চাষাবাদের প্রশিক্ষণ এবং কৃষকদের সহায়তা করে৷ তারা সাতক্ষীরা এলাকার ৪০টি গ্রাম এবং ২৩টি সংগঠনকে অরগ্যানিক চাষাবাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে৷ তারা জৈব সার ও জৈব কীটনাশক তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়৷ ঐ এলকার কৃষরা এখন ব্যাপকভাবে সবজি, ফল, মাছ ও হাঁস-মুরগির চাষ করছেন অরগ্যানিক পদ্ধতিতে৷ বারসিক-এর প্রোগ্রাম অফিসার মননজয় মন্ডল ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘স্থানীয় বাজারে কৃষকদের উৎপাদিত অরগ্যানিক পণ্য বিক্রি হয়৷ তাঁরা বিভিন্ন দোকানেও দেন, আবার আলাদাও বিক্রি করেন৷ হাটে অরগ্যানিক শাক-সবজির আলাদা জায়গা আছে৷ তবে কৃষকদের বাড়িতে গিয়েই সারাসরি ক্রেতারা বেশি কেনেন৷ দাম একটু বেশি হলেও ক্রেতারা ধীরে ধীরে অরগ্যানিক খাদ্যের দিকে ঝুঁকছেন৷''

অ্যাপোলো হাসপাতালের পুষ্টিবিদ ড. তামান্না চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এক সময় সব কিছুই তো প্রাকৃতিকভাবে হতো৷ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদনই অরগ্যানিক৷ এখন উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে বা দ্রুত উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছি৷ কিন্তু আমাদের অরগ্যানিকেই ফিরতে হবে৷ কারণ, আমরা আমাদের শরীরকে বিষাক্ত করতে পারি না৷ এখন হয়ত অরগ্যানিকভাবে উৎপাদিত খাদ্যের দাম বেশি৷ কিন্তু শরীরের কথা চিন্তা করলে, পুষ্টির কথা চিন্তা করলে, এই বেশি দাম আমাদের দিতেই হবে৷''

তাঁর কথায়, ‘‘সুসম পুষ্টির কথা চিন্তা করলে অরগ্যানিকের কোনো বিকল্প নেই৷ তাই ধীরে ধীরে মানুষ অরগ্যানিক খাদ্যের দিকে ঝুঁকছে৷ আর আমরাও অরগ্যানিক খাদ্যেরই পরামর্শ দিই৷''

আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য