1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঈদ আনন্দের কারিগর মা

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৩ জুলাই ২০২১

আমাদের ছোটবেলার ঈদ মানে উত্তেজনা আর নানা পরিকল্পনা। বাবার ছিলো নানা ব্যস্ততা আর চাপ। কিন্তু  সব কিছু সমন্বয় করে ঈদের দিন সবার জন্য আনন্দময় করার কারিগর ছিলেন মা।

https://p.dw.com/p/3xwhF
ছবি: Shahnaz Munni

বেশ ছোট তখন আমি। ফোর ফাইভ-এ পড়ি।  বাবার চাকরির কারণে আমরা থাকি পিরোজপুরের নাজিরপুরে। তখন সবেমাত্র উপজেলা ব্যবস্থা শুরু হয়েছে।  সেই নাজিরপুর বাজারে দর্জির দোকান তখন একটিই। দোকানের আলাদা করে নাম নেই। মালিকের নামে পরিচিতি- সুখলাল বাবুর দোকান।

এখনকার মতো  গার্মেন্টস-এর তৈরি পোশাকের তেমন চল ছিল না তখন। তাই ঈদের কয়েকদিন আগেই বাবা আমাদের ভাই-বোনদের সুখলাল বাবুর দোকানে নিয়ে যেতেন। নিয়ম ছিল কেউ জামা পেলে জুতা পাবে না। আবার জুতা নিলে জামা প্যান্ট নয়।

সুখলাল বাবুর দেকানে নতুন জামা কাপড়ের মাপ নেয়ার পর আমরা কাপড় (থান কাপড়) পছন্দ করতাম। আমরা তো বুঝতাম না যে বাবা কতটা দিতে পারতেন। ফলে দেখা যেত কাপড় পছন্দ করার পর বাবার মুখটা বেশ কালো হয়ে উঠত। তারপরও অর্ডার দিয়ে দিতেন বাকিতে।

বাসায় গিয়ে মায়ের সঙ্গে যেন কী বলতেন। তারপর সব কিছু যেন ঠিক হয়ে যেত। আমরা বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই দর্জির দোকানে হাজিরা দিতাম। কিন্তু কাজের কোনো অগ্রগতি দেখতাম না। তারপর  একদিন মা যেতেন। তার জমানো টাকায় হাত পড়ত। দর্জির কাজের গতি বেড়ে যেত। তারপরও ঈদের দিন ভোরে আমাদের জামাকাপড় পেতাম। দেখা যেত কোনোটার সেলাই ঠিক নেই, কোনো পাজামার দড়ি নেই। নামাজের আগেই মা সেগুলো ঠিক করে দিতেন। বসে যেতেন সেলাই মেশিন নিয়ে।

রোজার ঈদে সাধারণত সকাল থেকেই পোলাও মাংস খাওয়ার রেওয়াজ আমরা দেখে এসেছি। আর কোরবানির ঈদে মাংস তৈরি হতে যতক্ষণ। কিন্তু এই আয়েজনটা এক দিনের নয়। মাকে দেখেছি বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই আয়োজন শুরু করতে। তখন আমরা  পিরোজপুরের বানারিপাড়া নামে একটা উপজেলায় থাকি।  ঈদের আগে সবার আগে কাদের ঘরে রান্না হয় তার একটা প্রতিযোগিতা ছিল। নামাজ পড়ে এসে দেখতাম সব কিছু রেডি। কিন্তু আমাদের এই ফার্স্ট হওয়ার পিছনে ছিলো মায়ের নির্ঘুম রাত।

তখন আমরা আরেকটু বড় হয়েছি। ঈদে মা আমাদের নিয়ে শপিং করতে গেলেন বরিশাল শহরে। সবার জন্য টাকা নির্ধারিত। তার বেশি খরচ করা যাবে না। কিন্তু আমার বড় বোন এমন একটি থ্রি পিস পছন্দ করলেন যার দাম তার জন্য বরাদ্দের তিনগুণ, যা না  পেলে তার ঈদ হবে না। বোনের ইচ্ছারই জয় হলো। মা তার নিজের শাড়ির টাকা কোরবানি দিলেন । বাবাকেও বুঝতে দেননি। বড় আপার সেই খয়েরি রং-এর থ্রি পিসটার কথা আমার আজও মনে আছে।

হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে
হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলেছবি: DW

সেই শৈশব পেরিয়েছে অনেক  দিন আগে। এখন আমার নিজেরও সংসার হয়েছে। এবার ঈদের কথাই বলি। লকডাউন, করোনা- সব মিলিয়ে গরু কীভাবে কিনব তা নিয়ে রাজ্যের দুশ্চিন্তা। পরিস্থিতি এমন যে কোরবানি দেয়াই যেন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আমার দুই সন্তানেরও মন খারাপ। স্ত্রীকে কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।  কিন্তু তখন হয়তো মা মনে মনে হাসছেন। ঈদের দুইদিন আগে বললেন, ‘অত চিন্তার কিছু নাই , আমি সব ব্যবস্থা করেছি'। তার কথা মতো ঠিকই গরু চলে এলো। আমাদের সন্তানদের আনন্দ আর ধরে না। তারা রাত দিন বাসার কম্পাউন্ডে গরুর সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

কয়েক বছর আগের আরেকটি কোরবানির কথা আমার এখনো মনে আছে। আমার ছেলে মেয়ে গো ধরছে তাদের একটি ছাগল কিনে দিতে হবেই। আমি পাত্তা দিই না। সময়ও হয় না। তারা কান্নাকাটি শুরু করে। ঈদের আগে একদিন বাসায় ফিরে দেখি তাদের  বেশ আনন্দ। আমাকে টেনে নিচে নিয়ে যায়, দেখায় তাদের ছাগল। আমি অবাক হই। জানতে পারি তাদের মা তাদের সাথে নিয়ে রাস্তার পাশে পাশে ঘুরে ছাগল কিনে দিয়েছে

আমার শাশুড়ির  বয়স হয়েছে। কিন্তু ঈদের আয়োজনে তাকে দমানো যায় না। যে করেই হোক পরিবারের সদস্যদের সবার পছন্দের দিক নজর রেখে তিনি ঈদে খাবার তৈরি করবেনই। ওই পরিবারে আমার বিয়ে হওয়ার পর থেকে আমার শাশুড়ি সবার আগে ঈদের সকালে আমার জন্য খিচুড়ি আর মাংস পাঠাবেনই। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদের আগের রাতে তিনি ঘুমান না। সবাইকে খুশি রাখতে তার রাত কাটে নির্ঘুম।

আমি দেখেছি ঈদের জামা-জুতো, গরু-খাসি, রান্না বান্না সব কিছুর পিছনেই এই নারীরা। কিন্তু তাদের যেন কোনো চাহিদা নেই, তারা যেন কিছুই চান না। আমার স্ত্রী ঈদের দিন কখন খাবার খেয়েছেন তা আমি জানি না। আদৌ খেয়েছেন কিনা সে খবরও নেই আমার কাছে।

আমার বড় বোন এখন থাকেন মৌলভীবাজারে। তার বড় ছেলে ঢাকায় পড়াশুনা করে। ঈদের আগে আমার বোন অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু তার অসুস্থতা তার কাছে বড় কিছু নয়। তার উদ্বেগ ছিল তার ছেলেটি ঈদের আগে তার কাছে ফিরতে পারবে কী না। ঈদের আগে শেষ পর্যন্ত ফিরতে পেরেছে। আমরা ধারণা আমার বড় বোনের অসুস্থতা অর্ধেক কমে গেছে। আর খোঁজ নিয়ে জেনেছি তাকে কোনোভাবেই আটকে রাখা যায়নি। স্বামী-সন্তানদের জন্য  অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি নিজেই সব আয়োজন করেছেন।