1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এক কাশ্মীরির সঙ্গে

৬ আগস্ট ২০১৯

শামসির হায়দার, একজন কাশ্মীরি৷ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে তাঁর জন্ম৷ এখন থাকেন বন শহরে৷ ডয়চে ভেলে বাংলা নানা বিষয়ে কথা বলেছে তাঁর সঙ্গে৷ তিনি মনে করেন, ভারত যে পথ বেছে নিয়েছে, তা সংঘাত বাড়াবে৷

https://p.dw.com/p/3NPyv
Shamshir Haider DW Mitarbeiter
ছবি: DW/Z. Ahmed

শামসির ডয়চে ভেলের উর্দু বিভাগে কাজ করছেন এখন৷ তাঁর জন্ম ১৯৮১ সালে, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের সীমান্ত এলাকা মিরপুরে৷ ছোটবেলায় পড়াশোনাও করেছেন সেখানে৷ তাঁর বাবা ছিলেন পাকিস্তান মিলিটারিতে৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার তিন বছর আগে ১৯৬৮ সালে তাঁর বাবার পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টিং হয়েছিল৷ তিনি বাংলাদেশে এসে দেখেন বৈষম্যের শিকার বাঙালিরা পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের ঘৃণা করেন৷ তাই তিনি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ করে ফিরে গিয়েছিলেন৷

শামসিরের সঙ্গে কথা হচ্ছিল কাশ্মীর প্রসঙ্গে৷ ভারতের রাজ্যসভায় সংবিধানসম্মত ‘বিশেষ মর্যাদা' তুলে নেবার প্রস্তাব পাশ হওয়ায় আবারো আলোচনায় এই আলোচিত উপত্যকা৷ মোদী সরকারের এই উদ্যোগ কতটা প্রভাব ফেলবে কাশ্মীরে? পাকিস্তান অংশের কাশ্মীরিরা কী ভাবছেন? এসব নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে৷ তাঁর মতে, কাশ্মীরিরা তাদের ভূমিকে পবিত্র মানেন৷ তাই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে কাশ্মীরের ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, যা ভারতপন্থি কাশ্মীরিরাও ভালোভাবে নেননি৷ বাকি কথা শুনুন তাঁর মুখে৷

ডয়চে ভেলে: কাশ্মীর আসলে কী?

সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন দিয়ে শুরু করলেন৷ কাশ্মীরে সবসময় দু'টি দিক বর্তমান৷ এক, এটি অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা৷ কাশ্মীরের সৌন্দর্য বলতে মূলত কাশ্মীর ভ্যালির সৌন্দর্যকে বোঝায়৷ এটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা, ভারতের নিয়ন্ত্রণে৷ সেখানে তাদের অনেক সেনা রয়েছে৷ এছাড়া পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কাশ্মীরের একটি অংশ৷ আমি যখন ছোট ছিলাম, তখনই সেখানে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে৷ মকবুল ভাট (ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা) ছিলেন স্থানীয়দের কাছে নায়ক৷ কাশ্মীরিরা তাদের জাতীয়তাবাদ নিয়ে গর্ব করে এবং এই জাতীয়তাবাদ সেখানকার মুসলিমদের ঘিরেই শুধু নয়, সেখানকার হিন্দু পুরোহিত বা সাধারণ মানুষ, তাদের মধ্যেও আছে৷ সাধারণ কাশ্মীরিরা সে ভারত বা পাকিস্তান যে অংশেই থাকুন, তারা নিজেদের কাশ্মীরি বলতে পছন্দ করেন৷ জওহারলাল নেহরুরও তো কাশ্মিরী রুট আছে৷ যেই সেই ভূমির সঙ্গে জড়িত, তাকেই ‘স্যাকরেড' (পবিত্র) হিসেবে মনে করা হয়৷

তার মানে আপনি বলছেন যে, ধর্ম সেখানে বড় বিষয় নয়?

ঠিক তাই৷ একজন মুসলিম কাশ্মিরীর কাছে অমুসলিম কাশ্মীরিও শুধু কাশ্মীরিই৷ ধর্ম এখানে বিষয় নয়৷ তবে এটা ঠিক যে সেখানে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা আছে এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা আছে৷ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার মানুষদের অধিকাংশেরই পাকিস্তানের প্রতি সহমর্মিতা রয়েছে৷ সুতরাং দুই দেশ যে অংশগুলো দখলে রেখেছে, সেখানেও এর প্রতিফলন রয়েছে৷ তবে ছোটবেলা থেকে যেই কাশ্মীরির সঙ্গেই আমার কথা হয়েছে, আমি প্রশ্ন করেছি যে, আপনি কোন কাশ্মীরের সঙ্গে যেতে চান, পাকিস্তান না ভারত? তারা উত্তরে তৃতীয় আরেকটি অপশন বেছে নিয়েছেন৷ তা হলো স্বাধীন কাশ্মীর৷

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, এটি সাধারণ কাশ্মীরিদের চাওয়া, শুধু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নয়?

অবশ্যই৷ বাইরে থেকে যাদের আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী বলছি, স্থানীয়রা তাদের জাতীয়তাবাদী বলছেন৷ স্থানীয় মত তাদের পক্ষে৷ তারা পাকিস্তানপন্থি বা ভারতপন্থি নন৷ যারা কাশ্মীরের পাকিস্তান অংশে মাইগ্রেট করেছেন, তারাও ব্যক্তিগত পরিসরে এমন কথাই বলেন৷ অবশ্য জনসন্মুখে তারা এমন কথা বলতে পারেন না৷ যাদের আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী বলছি, তাদের পাকিস্তান ও ভারত কেউই পছন্দ করছে না৷ কিন্তু স্থানীয়দের কাছে তারা নায়ক৷

আপনি কতটা সংঘাত দেখেছেন?

আমার প্রথম অভিজ্ঞতা হলো আমরা এক সহপাঠীর ভাই ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে গেলেন যুদ্ধ করতে৷ সেটা ৯৪-৯৫ সালের কথা৷ আমার বয়স তখন ১৩ বছর৷ ১৯৮৯ সালে মকবুল ভাটের উত্থানের পর ভারতীয় কাশ্মীরে সেনা উপস্থিতি বাড়তে লাগল৷ পাকিস্তানি অংশেও সেনা উপস্থিতি বাড়ল৷ পাকিস্তানি অংশের মদদে সেখানে জিহাদি প্রশিক্ষণের ধারণাটি সবসময়ই ছিল৷ সেখানকার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতে যুদ্ধ করতে যেতেন তারা৷ সে যাই হোক, খবর এল ওয়াকার ইয়াসিন, আমার বন্ধুর ভাইটি মারা গেছেন৷ আমরা স্কুলে তখন৷ সবাই তাদের বাড়িতে গেলেন৷ তাদের পরিবারের সদস্যরা খুব গর্ব অনুভব করলেন৷

আসলে এখানে জিহাদি এলিমেন্টের দু'টি দিক আছে৷ নাইন ইলেভেনের আগের জেহাদের ধারণার কথা বলছি, যখন পর্যন্ত জিহাদ ‘আন্তর্জাতিক শব্দ' ছিল না এবং এর অর্থ ‘সন্ত্রাসবাদ' করা হতো না৷ তখন এর অর্থ স্থানীয়ভাবে ‘মুক্তিসংগ্রাম' করা হতো৷

কিন্তু নববইয়ের দশকে জামাতুল দাওয়া ও আরো অনেক ধর্মভিত্তিক সংগঠন ধর্মের নামে কাশ্মীরের ‘মুসলিম ভাই'দের সহযোগিতা করার আহ্বান জানান৷ তখন আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে অনেকে জিহাদে যোগ দিতে আসতে থাকলেন৷ এতে সমস্যা তৈরি হতে লাগল৷ যারা ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে যুদ্ধ করছিলেন, তারাও ক্ষুব্ধ হলে অনেক কারণে৷ এক, প্রথমত তাদের মুক্তির সংগ্রাম দখল হয়ে যাচ্ছিল৷ দুই, এছাড়া খবর আসতে লাগল যে জিহাদিরা স্থানীয় মেয়েদের ধর্ষণ করছে, জোর করে বিয়ে করছে এসব৷

আর পাকিস্তান অংশেও স্থানীয়রা তাদের গ্রহণ করছিলেন না৷ তারা বলছিলেন যে, ‘ধন্যবাদ আপনারা এসেছেন৷ সহযোগিতা করতে চেয়েছেন৷ কিন্তু আমাদের প্রয়োজন নেই৷' পাকিস্তানিরা পাকিস্তান অংশের কাশ্মীরে এসে বসবাস করতে শুরু করবেন -এই ভয় ছিল স্থানীয় কাশ্মীরিদের৷

কিন্তু নাইন ইলেভেনের পর সব বদলে গেল৷ তখন জিহাদ মানে সন্ত্রাস হয়ে গেল৷  জাতীয়তাবাদীরা যারা যুদ্ধ করে মুক্ত দেশ গঠন করতে চেয়েছিলেন তারা রাজনৈতিক পথ বেছে নিলেন, কারণ সংঘাতের পথ ধরে এগুলে তাতে সন্ত্রাসবাদের তকমা লেগে যাচ্ছিল৷ তাতে তাদের লক্ষ্য অর্জিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ছিল৷ এই সুবিধা ভারত নাইন ইলেভেনের পর নিয়েছে৷

আমরা দেখেছি যে, সম্প্রতি ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে৷ পাকিস্তান অংশের কী অবস্থা?

নিরাপত্তার নামে সেখানেও কড়াকড়ি আছে৷ প্রচুর সেনা উপস্থিতি আছে৷ সীমান্ত এলাকায় সম্প্রতি আপনি জানেন গুলিবিনিময়ও হয়েছে৷ তবে পারস্পরিক যোগাযোগের অবস্থা ভারত অংশের চেয়ে পাকিস্তান অংশে ভালো৷ আসলে কাশ্মীরিদের নিয়ন্ত্রণে ভারত ও পাকিস্তানের ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে৷ অবশ্যই পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তান অংশের কাশ্মীরিদের তুলনামূলক সুদৃষ্টির কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে৷ তাই সেখানে সেনা উপস্থিতি থাকলেও তারা ভারতীয় অংশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি স্বাধীনতা উপভোগ করছেন৷

বাংলাদেশিদের প্রতি কাশ্মিরীদের ভাবনা কী?

সাধারণভাবে ইতিবাচক৷ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলিম এবং তারা একসময় পাকিস্তানের অংশ ছিল, সে জায়গা থেকে৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে দু'টি ভাগ আছে৷

একদল কাশ্মিরী মনে করেন, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ডে ভারতের ষড়যন্ত্র ছিল৷ আরেকদল পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করেন৷ তারা মনে করে পাকিস্তানিরা শুধু ১৯৭১ সালেই নয়, তার আগেও বাংলাদেশে পাশবিকতা চালিয়েছে৷ তবে সবাই বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করেন৷ তারা মনে করেন, দু'টি দাপ্তরিক ভাষা থাকতে কোনো সমস্যা নেই৷ তবে যখন পাকিস্তান-বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলে তখন পাকিস্তান অংশের কাশ্মীরিরা পাকিস্তানকেই সমর্থন করেন৷ আর বাংলাদেশ-ভারত খেললে বাংলাদেশ৷

সোমবার ভারতের রাজ্যসভায় নেয়া সিদ্ধান্তে কী প্রভাব পড়েছে কাশ্মীরের সাধারণের মাঝে?

এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়৷ শুধু ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র টেকে না, তার প্রমাণ বাংলাদেশ৷ সেখানকার ভাষা আছে, সংস্কৃতি আছে৷ প্রত্যেক কাশ্মীরি, এমনকি যারা পাকিস্তানবিরোধী ও ভারতপন্থি অথবা স্বাধীনতাকামী, তারা কেউ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি৷ তারা মনে করছে, ভারত চায় কাশ্মীরের ডেমোগ্রাফি বদলে দিতে৷ তাদের ধারণা, ভারত নন-কাশ্মীরিদের এখানে আনতে চাইছে, বিশেষ করে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের এখানে আনতে চাইছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের অজুহাত বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে৷ তারা এখানে আসবে, জমি কিনবে, এখানে থাকা শুরু করবে, কাজ করবে৷ কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাদের কাছে বড় কথা নয়৷ তারা মনে করেন, এভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে না৷ কারণ শান্তি থাকবে না৷ সংঘাত গণহত্যায় রূপ নিতে পারে৷ বিদ্রোহীরা চুপ করে থাকবে না৷ ভারতের মনোভাব হলো, যে করেই হোক এটা বদলাতেই হবে৷ এতে কাশ্মীরিদের মাঝে আত্মপরিচয়ের সংঘাত তৈরি হচ্ছে৷

বিশ্বের অনেক জায়গাতেই আমরা দেখেছি, স্থানীয়দের মধ্যে ‘সেটেলার'দের ঠেলে দিয়ে প্রথমে সংঘাত ও পরে ধীরে ধীরে শান্তির পথ তৈরির একটি প্রক্রিয়া বা ‘থিওরি' বিদ্যমান৷ বাংলাদেশেও এমন ঘটনা ঘটেছে৷ আপনি কি মনে করেন এখানেও তেমনটি হবে?

এটা সত্য শান্তি আসে অনেক অশান্তির পর, যখন দেখা যায়, অশান্তিতে আর কোনো ফায়দা হচ্ছে না৷ সেটা এখানেও হতে পারে৷ কাশ্মীরিরাও বোঝেন যে, আপোষ করতে হবে একটা সময়ে৷ কারণ দেশভাগের পর থেকে শুরু, ৭২ বছরের এই সংঘাত৷ বাজপায়ি ও মোশাররফের সময়ে যে সমাধানসূত্র এসেছিল তার পক্ষে ছিলেন কাশ্মীরিরা৷ সেখানে ছিল যে, যে, তিনটি অংশ হবে৷ লাদাখ ও জম্মু অংশ ভারতের সঙ্গে, কাশ্মীর উপত্যকা হবে স্বাধীন এবং গিলগিত-বালতিস্তান পাকিস্তানের সঙ্গে৷ এই সমাধানটি রাজনৈতিকভাবে সম্ভব ছিল৷ মনে হচ্ছিল, আশা আছে৷ কিন্তু এখন যেটা হলো, তাতে আশা নিভে গেছে সাধারণের৷ ভারতের ভাষ্য, অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানুষকে স্বস্তি এনে দেবে৷ তবে সেটা এত সহজ হবে না৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য