1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘এসএ গেমসের স্বর্ণপদক আমার জন্য যথেষ্ট নয়’

৯ ডিসেম্বর ২০১৯

বাবা বলতেন, ‘‘তোমার জন্য আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারি না৷’’ পাড়ার দোকানদারও জানতে চাইতো, ‘‘এত রাতে মেয়ে কোত্থেকে আসছে?’’

https://p.dw.com/p/3UTVW
ছবি: DW/M. Farid

এসএ গেমসে মেয়েদের অনূর্ধ্ব-৫৫ কেজি ওজনশ্রেণি কারাতে কুমিতে স্বর্ণপদক জিতে সবার মুখেই গর্বের হাসি ফুটিয়েছেন মারজান আক্তার প্রিয়া৷ ডয়চে ভেলের মুখোমুখি হয়ে এই স্বর্ণকন্যা জানিয়েছেন সব কষ্ট আর স্বপ্নের কথা৷

ডয়েচে ভেলে : পড়ালেখার চেয়ে ছবি আঁকা বেশি পছন্দ করেন৷ আবার ফুটবল-ক্রিকেটের চেয়ে বেশি পছন্দ কারাতে৷ প্রচলিত ধারার বাইরে চলা আপনি বোধহয় অন্যরকমই৷ সেসব নিয়ে নিশ্চয়ই কথা বলবো৷ তবে শুরুতে জানতে চাই, এসএ গেমসে স্বর্ণপদক জেতার পর বাবা-মায়ে অনুভূতি কেমন ছিল?

মারজান আক্তার প্রিয়া: প্রথমত, আমার কারাতে খেলায় তাঁরা রাজি ছিলেন না৷ অনুশীলন ক্যাম্প শুরু করার পরও না৷ তবে এসএ গেমসের একেবারে শেষ মুহূর্তগুলোয় অনেক সমর্থন করেছেন৷ স্বর্ণপদক জেতার সঙ্গে সঙ্গে আব্বু-আম্মুকে ফোন দিতে পারিনি; রাতে হোটেলে ফিরে ফোন দিই৷ আমি যে স্বর্ণপদক পেয়েছি, সেটি তাঁরা সে সময় জানতে পারেননি, কারণ, বাসায় টিভি ছিল না৷ সন্ধ্যায় অন্য আত্মীয়ের কাছ থেকে জানেন৷ আব্বুকে যখন ফোন করি, ওনার চোখে পানি চলে এসেছে৷ খুশিতে আমার সঙ্গে কথাই বলতে পারছিলেন না৷ আম্মু বরং অনেক শান্ত৷ উনার প্রথম কথা ছিল, ‘‘সম্মান অর্জন করাটা বড় ব্যাপার নয়, সেটি যেন ধরে রাখতে পারো, সে চেষ্টাই করবে সবসময়৷'' 

কারাতে খেলা নিয়ে পরিবারের কাছ থেকে কোনো সমর্থন পাননি বলছেন...

কোনো সমর্থন পাইনি৷ আমি সবসময় পড়ালেখায় ভালো৷ ক্লাস ফাইভ থেকে শুরু করে ক্লাস টেন পর্যন্ত জিপিএ গোল্ডেন ফাইভ পেয়ে এসেছি৷ এসএসসিতে অল্পের জন্য এ প্লাস মিস হয়৷ পরবর্তীতে জগন্নাথের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই৷ এমন একটি মেয়ে খেলাধূলা বেছে নেবে, তা মেনে নেয়া যে কোনো বাবা-মায়ের জন্যই কঠিন৷ তাঁদের স্বপ্ন ছিল, পড়াশোনায় এত ভালো করছে যে মেয়ে, সে অবশ্যই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে৷

আপনার স্বপ্নটি বদলে গেল কিভাবে? খেলার দিকে গেলেও তো ক্রিকেট-ফুটবলে যান বেশিরভাগ৷ আপনি কারাতেতে এলেন কেন?

এটি ঠিক যে, ফুটবল-ক্রিকেটই সবার ওপরে৷ বিশেষত ক্রিকেট এখন খুব প্রাধান্য পাচ্ছে৷ আমি শখের বশে কারাতে শুরু করি৷ সিনেমায় লেডি ফাইটারদের দেখে খুব ভালো লাগতো৷ নায়িকা যেখানে মারামারি করছে, ছেলেদের মতো নির্ভিকভাবে চলছে৷ এই মনোভাব আমাকে আকৃষ্ট করতো৷ এর পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতেই কারাতের জগতে ঢোকা৷

শুরুটা কিভাবে?

আমি ভিকারুন্নিসা স্কুলে পড়েছি৷ যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন কারাতে শেখানো শুরু হয়৷ আমি তাতে যোগ দিইনি৷ তবে চারতলার উপর থেকে দেখতাম অনুশীলন৷ পাঞ্চ-কিকের সময় জোরে জোরে যে শব্দ করে, তা আকর্ষণ করে৷ তবে নিজে শুরুর সাহস করতে পারছিলাম না৷ বাবা-মায়ের কাছে যতবার শেখার কথা বলি, প্রতিবার তাঁরা মানা করে দেন৷ ক্লাস টেনে উঠে জোর করেই আমি স্কুলে কারাতের অনুশীলনে ঢুকি৷

তারপর?

সেখানে দেখলাম, আমার খুব বেশি উন্নতি হচ্ছে না৷ আব্বুকে বললাম, ‘‘আমাকে আরেকটু ভালো জায়গায় নিয়ে যাও, প্লিজ৷'' আমি এসএসসিতে ভালো ফল করি৷ সঙ্গে আমার জেদ দেখে আব্বু বাধ্য হন৷ উনি তো পুলিশে চাকুরি করেন৷ পুলিশের এক কারাতে কোচের কাছে আমাকে নিয়ে যান৷ দুই-আড়াই মাস শেখার পর দীন ইসলাম নামের একজন আমাকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)-তে নিয়ে যান৷ কারাতের আসল অনুশীলন শুরু সেখানেই৷ এনএসসিতে যাবার এক সপ্তাহের মধ্যেই ফাইনাল খেলি অন্তরার সঙ্গে; এসএ গেমসে এবার যে স্বর্ণপদক পেয়েছে৷ শুরুতে এত ভালো করায় আমি সবার নজরে আসি৷ এর কয়েক মাস পর জাতীয় কারাতেতে অংশ নিয়ে পাই রৌপ্য পদক৷

যখন এনএসসিতে অনুশীলন করছেন, তখনও তো বাসা থেকে খেলতে দিতে চাইতেন না?

ঠিক৷ আমি স্কুল শেষে বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে এনএসসিতে গিয়ে অনুশীলন শুরু করতে করতে বিকেল-সন্ধ্যা৷ বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত৷ এলাকার দোকানদারটা পর্যন্ত তখন জিজ্ঞেস করে, এত রাতে মেয়ে কোত্থেকে আসছে? শুরুর দিকে আম্মু আমার সঙ্গে যেতেন৷ পরে সবার এমন কথা শুনে উনি রাগ করে আমার সঙ্গে যাওয়া-আসা বন্ধ করে দেন, যেন আমিও কারাতের অনুশীলনে না যাই৷ কিন্তু আমি যাওয়া ছাড়িনি৷

অনেক সময় নাকি এমন হতো, অনুশীলন শেষে বাসায় ফেরার পর বাবা-মা অনেকক্ষণ দরজাও খোলেননি?

ঠিক তাই৷ ওনারা রাগ করতেন৷ বাবা-মাকে অনেক কটূক্তি শুনতে হতো৷ ‘‘ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে মেয়ে কোত্থেকে আসছে?'' এমন কথা আমি নিজেও শুনেছি অনেক৷ আমার পরিচিতরাই আমাকে বলেছেন, ‘‘ওহ, মারামারি করিস, তোর সামনে তো দাঁড়াতেই পারবো না৷'' কথাটা প্রশংসা না, টিটকারি করে বলতো৷

এসব কথাবার্তা কি আপনাকে আরো জেদী করে তুলতো?

অনেক বেশি জেদী করতো৷ অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করতো৷ ওই মুহূর্তগুলো জমিয়ে রাখতে রাখতে ভেতরে কিছু একটা জমে গিয়েছিল৷ মনে হয়েছিল, জায়গামতো বড় কিছু করতে হবে৷ 

পর্যটননগরী কক্সবাজারে সার্ফিং

এবার এসএ গেমসে যাবার সময় কি সেই জেদ ছিল যে, এবার সবাইকে দেখিয়ে দেবো?

ভেতরে ভেতরে জেদ ছিল৷ বাবা-মাকে তো আর সেভাবে বলা যায় না৷ তবে অনেক সময় রাগ করে আমিও বলেছি, ‘‘তোমরা আমাকে খেলতে দিচ্ছ না, দেখো আমি পড়াশোনার চেয়ে এখানে বড় কিছু করবো৷'' আব্বু আমাকে প্রায়ই বলতেন, ‘‘তুমি যে খেলায় আছো, আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারি না৷ ক্রিকেট-ফুটবল খেললে বলতে পারতাম, আমার মেয়ে খেলোয়াড়৷ কিন্তু মেয়ে কারাতে খেলে, মারামারি করে৷ এটি কাউকে বলতে পারি না৷ মানুষ ছি ছি করে৷''

এবারের এসএ গেমসে যখন শুধু নিজের বাবা-মা না, সবাইকে নিজের সামর্থ্য দেখিয়ে দিতে পারলেন. তখন সবচেয়ে বেশি কী মনে হচ্ছিলো?

সত্যি বলতে কি, এই অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আমি সব ভুলে যাই৷ কে কী বলেছে না বলেছে, সব ভুলে গেছি৷ শুধু মনে হয়েছে, দেশের জন্য এত বড় সম্মান আমি নিয়ে এসেছি! জানি, সামনে যদি আমি স্বর্ণপদকের জায়গায় রৌপ্য-ব্রোঞ্জপদক পাই কিংবা কোনো পদকই না পাই, তখন আবার এ কথাগুলো উঠবে৷ তবে সেগুলো নিয়ে আর ভাবি না৷

ফুটবল-ক্রিকেট বাদ দিয়ে যেমন কারাতে বেছে নিয়েছেন, ঠিক তেমনি পড়াশোনার ক্ষেত্রে ছবি আঁকা৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় পড়াশোনা করছেন৷ ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ কিভাবে?

ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি করতাম৷ আম্মুর কাছ থেকে শিখেছি৷ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশও নিয়েছি৷ শিল্পকলা একাডেমীতে এক বছরের কোর্স করেছিলাম৷ বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় জাদুঘরে যে ছবি আঁকার আয়োজন হতো, সেখানে নিয়মিত অংশ নিতাম৷ আসলে ছোটবেলা থেকে খেলাধুলার পাশাপাশি ছবি আঁকায় আগ্রহ ছিল৷ সে কারণে জগন্নাথের চারুকলায় ভর্তি হই৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগেও ভর্তির আগ্রহ ছিল৷ কিন্তু সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ফর্ম তুলতে পারিনি৷

কারাতে খেলার জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর বন্ধুদের সমর্থন পেয়েছেন কেমন?

ছয় মাস আগে আমি এসএ গেমসের কারাতে ক্যাম্পে সুযোগ পাই৷ তাতে যোগ দিতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করা যাবে না৷ আমি সে দরখাস্ত নিয়ে স্যারদের কাছে যাই৷ এত বড় জায়গায় সুযোগ পাওয়ায় ওনারা খুশি হন৷ তবে বলেন, ক্লাস না করলেও পরীক্ষা দিলে ভালো হয়৷ আমি বলি, ‘‘স্যার পরীক্ষা দেবার চেষ্টা করবো৷ তবে এখানে খেলা আমার সারা জীবনের স্বপ্ন৷'' স্যাররা বলেন, ‘‘ঠিক আছে, তুমি স্বর্ণপদক জিতে এসো৷ তোমার সব কিছু মাফ করে দেবো৷'' এটি আমার মাথায় সবসময় কাজ করতো৷ মনে হতো, স্যাররা বিশ্বাস করেন যে, আমি স্বর্ণপদক জিততে পারি৷ আর বন্ধুরা মজা করে হলেও অনুপ্রাণিত করতো৷ বলতো, ‘‘ওর সামনে দাঁড়ানো যাবে না৷'' কেউ হয়তো বলতো, ‘‘আমাকে ও হুমকি দিয়েছে, প্রিয়া চল তোকে নিয়ে যাবো৷'' এ ব্যাপারগুলো অনেক উপভোগ করতাম৷

স্বর্ণপদক পাবার পরের দিন আরেক ইভেন্টে অংশ নিতে গিয়ে আপনি আহত হন৷ সে কারণে হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয়৷ তখন কি ভয় পেয়েছিলেন?

না, ভয় পাইনি৷ আমি বরং খেলতে চেয়েছিলাম৷ মেডিকেলি আউট হবার জন্য খেলতে পারিনি৷ তবে তখনো আমি বলছিলাম, ‘‘আই অ্যাম ওকে, আমি ওয়ান্ট টু প্লে৷'' অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর সময়ও তাই বলছিলাম৷

সব মিলিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কী?

আরো বড় আসর থেকে কারাতের স্বর্ণপদক নিয়ে আসা৷ এসএ গেমসের স্বর্ণপদক আমার জন্য যথেষ্ট না, কেননা, এখনো অনেকের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, ওদের ভেতরটায় পরিবর্তন হয়নি৷ লোকজনের সেই ভেতরটা বদলানোর জন্য আমি আরো বড় আসর থেকে স্বর্ণপদক জিততে চাই৷ এসএ গেমসের পর এশিয়ান গেমস, এরপর অলিম্পিক, কারাতের প্রিমিয়ার লিগ, বিশ্ব পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে পদক জিততে চাই৷