1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এ পুজোয় মন ভালো নেই

Sanjiv Burman১৭ অক্টোবর ২০২১

এমন পুজো যেন আর কখনো দেখতে না হয়। এ বড় মন খারাপের পুজো।

https://p.dw.com/p/41iri
পুজো প্যান্ডেল
ছবি: bdnews24.com

দুর্গাপুজো শুরুর দিন তিনেক আগে আতহার ফোন করে যারপরনাই গালিগালাজ করলো। বছরের এই একটা সময় কলকাতায় না ফিরলে বন্ধুরা অসম্ভব রেগে যায়। কারণ, এটাই আড্ডা মারার সেরা সময়। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত থেকে বন্ধুরা এসে জড়ো হয় পাড়ার আড্ডায়। রাত নেই, দিন নেই-- অনর্গল আড্ডা। আতহার সেই আড্ডার অন্যতম আয়োজক। সেই স্কুল জীবন থেকে। ফলে গালিও ওর কাছেই পাওনা ছিল! নবমীর সকালে শেষ কথা হয়েছে ওর সঙ্গে। মন খারাপের ফোন। ''শেষে দুর্গোৎসবেও হিন্দু-মুসলিম আলোচনা করতে হবে ভাই?'' ফেসবুকে কিছু আধা পরিচিত অর্বাচীন ওকে লিখেছে, 'বাংলাদেশে যা হয়েছে, তা নিশ্চয় সমর্থন করেন? একটা লাইনও তো লিখতে দেখলাম না সমাজমাধ্যমে?'

কথাটা আতহারকেই শুনতে হয়েছে। ওর নামের কারণে। আমায় শুনতে হয়নি। অর্বাচীনের দল জানেই না, দুর্গাপুজোর সঙ্গে আতহারের যে সম্পর্ক, আমার সঙ্গে ঈদের তাই।

এবারে মহালয়ার দিনটা গুলিয়ে গেছিল। সুদূর দিল্লিতে কার-ই বা মনে থাকে মহালয়া? ভোরবেলা মহালয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল এশা ইউসুফ। আমার ঢাকার বন্ধু। ফেসবুকে ঢাকার দুর্গাপ্রতিমার ছবি দিয়ে লিখেছিল, 'মা'। ওইদিন সকালে দুর্গাপুজোর ফূর্তি নিয়ে লম্বা আড্ডা হয়েছিল ওর সঙ্গে। জানালো, পুজো উপলক্ষে কলকাতায় এসেছে। নবমী সকালে ওর ফেসবুক প্রোফাইল জানান দিল-- 'মন ভালো নেই'।

মন ভালো নেই আমারও। দিল্লি দাঙ্গার পর জ্বলে যাওয়া মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক যতটা কান্না পেয়েছিল, নবমী সকালে কুমিল্লার ছবি দেখে ঠিক ততটাই মন খারাপ হয়েছে। মন খারাপ হয়েছে, কেবল দুইটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য নয়। এই ঘটনা যে ইতিহাসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের, সে কথা ভেবে। ফেসবুকে আতহারের ট্রোলড হওয়া থেকে সেই ইতিহাসের শুরু। পুলিশি পাহারায় পুজো হওয়া সেই ইতিহাসের চারণভূমি। একসঙ্গে একই আবহাওয়ায় বড় হওয়া বন্ধুদের মধ্যে 'হিন্দু-মুসলিম' আলোচনা ও কূটতর্ক সেই ইতিহাসের ভবিতব্য।

ছোটবেলায় দুর্গাপুজো আমাদের কাছে কেবল একটি পুজো ছিল না। পুজোর আছিলায় গড়ে ওঠা এক সাংস্কৃতিক আবাদভূমি ছিল। পাড়ার স্টেজে নাটক হবে বলে ছেলে-মেয়েরা একমাস ধরে মহড়া দিত। মাঠে মাঠে ছেলে ছোকড়ার দল সদ্য কেনা গিটারে সুর ধরতো আয়ুব বাচ্চু কিংবা সুমনের। 'নাম নেব মহম্মদের' সুর তুলে পাড়ার সান্ধ্য অনুষ্ঠানে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল বন্ধু রাজা। দুর্গাপুজোয় কেন 'মহম্মদে'র নাম এলো, এ প্রশ্ন কেউ কখনো তোলেননি। ইদানীং তোলেন। মধ্য কলকাতায় পুজো প্যান্ডেলে তাজমহল দেখেছি আমরা। থিম-টিমের তখনো কোনো বালাই ছিল না। পুজো ছিল এক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন।

আমি থিমের বিরোধী নই। কলকাতার পুজো এখন এক মস্ত বড় ইন্ডাস্ট্রি। শিল্পক্ষেত্রও বটে। কুমোরটুলির শিল্পী থেকে আর্ট কলেজের ছাত্র-- কলকাতার থিম পুজো এখন বহু মানুষের সারা বছরের রুটিরুজি। গত বছর ঢাক বাজানোর বায়না না পেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন যে ঢাকি, আমি তার প্রতি সহানুভূতিশীল। ঠাকুর বিক্রি না হওয়ায় কুমোরটুলির যে শিল্পী বিপুল দেনার দায়ে জর্জরিত, আমি তার প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু থিম নামক জৌলুস যখন গোটা সংস্কৃতিকে গ্রাস করে নেয়, তখন মন খারাপ হয়। মন খারাপ হয়, যখন দেখি থিম বিক্রি করতে গিয়ে করোনাবিধি শিকেয় তুলে দিয়েছেন স্বয়ং রাজ্যের এক মন্ত্রী। মন খারাপ হয়, যখন দেখি কলকাতার বাঙালি থিমের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে সমাজ মাধ্যমে 'বিলো দ্য বেল্ট' আক্রমণ শানাতে থাকে। মুঘল স্থাপত্যের অনুকরণে তৈরি প্যান্ডেলে কেন হিন্দু দেবীর বোধন হবে, এ প্রশ্নও উঠছে আজকাল। নাহ, এ পুজো আমি চাই না। পুজোর নামে সংকীর্ণ রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা আমি চাই না। নেতাদের নামে পুজোর ব্যানার দেখতে চাই না মোটেই। চাই না, দুর্গাপ্রতিমার আদলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মূর্তি তৈরি হোক। কিংবা আলোকসজ্জা। এই সংস্কৃতি বাংলার সংস্কৃতি নয়। চাই না, পুজোয় সরকারি ডোলের এই অপসংস্কৃতি দেখতে। এও এক সংকীর্ণ রাজনীতির উদাহরণ।

আবার বলছি, আমি থিম বিরোধী নই। এ কথা অনস্বীকার্য, দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল কলকাতার শিল্পবোধকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছে। পুজোর কয়েকটা দিন সত্যি সত্যিই মনে হয়, গোটা কলকাতা জুড়ে হাজার হাজার লাইভ ইনস্টলেশন তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো কাজ বিশ্বমানের। জাদুঘরে রেখে দেওয়ার মতো। শিল্পীর চোখে সাধারণ পুজো এক অনন্য সাধারণ মাত্রায় পৌঁছে যায়। পুজো কেবল আর পুজো থাকে না, উৎকৃষ্ট উৎসবে পরিণত হয়। আবার একথাও ঠিক, ওই বিপুল রোশনাইয়ের পাশে যখন পরিযায়ী শ্রমিকদের মুখগুলো ভেসে ওঠে, কষ্ট হয়। মনে হয়, সরকারি ডোলের টাকা তাদের পাওয়ার কথা ছিল, পুজোর নয়। মুখ্যমন্ত্রীর তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা ছিল, পুজোর নয়।

বছরের এই সময়টায় আরো অনেক বাঙালির মতো, আমারও মন ভালো থাকে। আনন্দ করতে ইচ্ছে হয় সর্বক্ষণ। সম্ভবত এই প্রথম পুজোর মরসুমে মন ভালো নেই। পুজো ঘিরে যে ছেঁড়া ছেঁড়া ছবিগুলো তৈরি হলো, তা বড়ই বেদনাদায়ক। এই ছেঁড়া ছেঁড়া ছবিগুলো আতহার বা এশার জীবনে যে প্রতিঘাত নিয়ে পৌঁছালো, তা আরো বেশি মন খারাপের। এর দায় আমাদের সকলের।