1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

করোনা চেনালো নতুন ব্রডকাস্টারদের

গৌতম হোড়
৩১ জুলাই ২০২০

সব খারাপের মধ্যেও নাকি একটা ভালো থাকে৷ করোনার সময়ও এটা আবার টের পাওয়া গেল৷ নাহলে মাত্র মাস তিনেকের মধ্যে এই আমূল পরিবর্তনের কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না৷

https://p.dw.com/p/3gDJY
Indien "I For India" Konzert - Online-Spendenaktion
ছবি: AFP/P. Singh

করোনার ফলে দেশজুড়ে লকডাউন ঘরের বাইরে পা রাখা নিষেধ৷ এমনকী পাশের বাড়ি বা ফ্ল্যাটেও নয়৷ কোন ছিদ্র দিয়ে করোনা ঢুকে পড়ে কে জানে৷ করোনা-জুজুতেঅফিস-কাছারি, স্কুল-কলেজ, জিম-সিনেমা হল, নাটক-গানের অনুষ্ঠান সব বন্ধ৷ ভয়ের চোটে কাগজও বন্ধ করে দিয়েছেন অনেকে৷ এমনকী টিভিতে সিরিয়ালের নতুন পর্ব পর্যন্ত নেই৷ আড্ডা নেই, খেলা নেই, কোথাও যাওয়া নেই, আছে শুধু চার দেওয়ালের ভিতর থেকে সেলফোন বা ল্যাপটপের দুনিয়ায় ডুবে যাওয়া৷ সামাজিক মাধ্যমটাকেই নিজের জগৎ বানিয়ে নেওয়া৷

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ডিজিটাল ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া বলে ছয় বছরের বেশি এগোতে পারেননি৷ করোনা কিন্তু তিন মাসের মধ্যেই ইন্ডিয়াকে ডিজিটাল করে দিল৷ নেট দুনিয়াই এখন ভরসা৷ অনলাইনে খাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অর্ডার, বাড়িতে বসে কাজ, গান-বাজনা-আবৃত্তি, নতুন সিনেমা, সেলিব্রিটিদের কথা শোনা, তাঁরা কী কাজ করছেন তা দেখা থেকে শুরু করে ভার্চুয়াল গেম-প্রেম সবকিছুই এখন ডিজিটাল৷

এই প্রথম ২৫শে বৈশাখ পশ্চিমবঙ্গের কোথাও ম্যারাপ বেঁধে, স্টেজ করে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া হয়নি৷ কিন্তু প্রায় সব শিল্পী ওই দিন বা পুরো রবীন্দ্রপক্ষে গেয়েছেন, কবিতা আবৃত্তি করেছেন, নেচেছেন৷ সবটাই অনলাইনে৷ প্রায় প্রতিটি সংগঠন রবি ঠাকুরকে স্মরণ করার প্রথা বজায় রেখেছে৷ লাইভ অনুষ্ঠান হয়েছে৷ ঐতিহ্যে ছেদ পড়েনি৷ লোকে দেখেছেন৷ তবে ওই সেলফোনে৷

করোনার এই সময়ে প্রাপ্তি হচ্ছে পাবলিক ব্রডকাস্টাররা৷ শুটিং, অনুষ্ঠান, খেলা, জিম, সিনেমা হল-- সবকিছু বন্ধ৷ সেলিব্রিটিরা কোথায় যাবেন? কী করে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখবেন? ব্যস, শুরু হয়ে গেল সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের গতিবিধি৷ কেউ রান্না শেখাচ্ছেন৷ কেউ দেখাচ্ছেন, কী করে নিজেকে ফিট রাখতে হয়৷ ক্রিকেটাররা দেখাচ্ছেন শরীর ঠিক রাখার কায়দাকানুন৷ আর কিছু না হলে নিখাদ আড্ডা৷ ভারতের ক্রিকেট ক্যাপ্টেন বিরাট কোহলিকেই ধরুন৷ বাংলাদেশের ক্রিকেটার তামিম ইকবালের সঙ্গে ফেসবুক লাইভে আড্ডা দিলেন৷ তারপর বিসিসিআই টিভি-তে নিজের সহ খেলোয়াড় মায়াঙ্ক আগরওয়ালের সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে মন খুলে কথা বললেন৷ তাছাড়া ইনস্টাগ্রামে বিরাট সমানে ছবি, ভিডিও আপলোড করতে থাকেন৷ দেখান নিজের জীবনযাপনের, শারীরিক কলাকৌশলের টুকরো ছবি৷

তার আগে মায়াঙ্ককে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, কেমন করে তিনি শচিন তেন্ডুলকরকে মাঝে মধ্যে ইনিংসের প্রথম বল খেলতে বাধ্য করতেন৷ টি২০ বা একদিনের ক্রিকেটে শচিন প্রথম বল খেলতে চাইতেন না৷ সেটা সব সময় পড়ত সৌরভের ঘাড়ে৷ সৌরভ মাঝে মধ্যে দ্রুত নন স্ট্রাইকিং এন্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন৷ টিভি ক্যামেরা একবার সেই ছবি ধরে ফেললে তখন শচিনের প্রথম বল খেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকত না৷ এই সব মুখরোচক গল্প লোকে গিলছেন৷

শাহরুখ খান একবার একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যেদিন সকালে উঠে বাড়ির বারান্দায় দাঁড়াব, দেখব কোনো ফ্যান নেই, হইচই করছেন না, তখন বুঝব সব শেষ৷ এই জনপ্রিয়তা ধরে রাখার তাগিদ থেকে না কি, ডিজিটাল দুনিয়ায় পা রাখার আকর্ষণে অথবা বাড়তি রোজগারের হাতছানিতে সেলিব্রিটিরা এভাবে ঢুকে পড়লেন নেটদুনিয়ায়, শো শুরু করে দিলেন তা বলতে পারব না৷ শিল্পা শেট্টি ইউটিউব চ্যানেলে স্বাস্থ্যকর রান্না শেখান৷ আলিয়া ভাটও একই রকমভাবে ইউ টিউব চ্যানেলে রান্না করেন, কখনও নিজের রুটিন বলেন৷ ঋত্বিক রোশন, পি ভি সিন্ধু, মন্দিরা বেদী, মেরি কমরা শরীর ফিট রাখার ব্যায়াম শেখান৷ একটা ইউ টিউব ট্যানেল এর মধ্যে সব সেলিব্রিটির খাওয়া, ব্যায়াম, পছন্দ-অপছন্দ সবকিছু নিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করে দিয়েছে৷

শ্রেয়া ঘোষাল প্রায়ই নিজের গান ফেসবুকে দিচ্ছেন৷ বাংলার গায়করাও একই কাজ করছেন৷ নচিকেতা তাঁর ফেসবুকে নিজের গান, সাক্ষাৎকার আপলোড করছেন৷ গায়ক অর্জুন কানুনগো নিজের মোবাইলে পুরো গান শুট করে এডিট করে নতুন গান নেটদুনিয়ায় ছেড়ে দিয়েছেন৷ অমিতাভ বচ্চন সহ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নিজের বাড়িতে বসে শুট করে করোনা নিয়ে ছোট ভিডিও তৈরি করে আপলোড করেছেন৷ টালিগঞ্জের অভিনেতারাও একই কাজ করেছেন৷

এটা তো গেল সেলিব্রিটিদের কথা৷ তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নেটদুনিয়ায়৷ যাঁরা সেলিব্রিটি নন, সাধারণ লোক, হয়তো কিছুটা গান গাইতে পারেন, বাজাতে পারেন, বলতে পারেন অথবা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত, তাঁরাও নেমে পড়েছেন এই বাজারে৷ নিজেরা ফেসবুক লাইভ করছেন, ইউ টিউব চ্যানেল করছেন৷ সেখানে গাইছেন, নাচছেন, বাজনা বাজাচ্ছেন, কোনো ব্যক্তিত্বকে নিয়ে নিজেদের কথা বলছেন৷ এই বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন পেশাদাররাও৷ করোনার সময়ে প্রথমবার প্রচুর  চিকিৎসক নিজে থেকে লাইভ করে বলেছেন, কী করবেন, কী করবেন না, কেমনভাবে চলবেন৷ সাংবাদিকরা প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে নিজ উদ্যোগে শুরু করেছেন লাইভ৷ চীনের সঙ্গে সংঘাত থেকে তৃণমূলের একুশে জুলাইয়ের জনসভা পর্যন্ত কিছুই বাদ নেই সেখানে৷ অনেকে আবার অন্যদের সঙ্গে নিয়ে আড্ডার আসর বসিয়েছেন৷ কবিদের অনলাইনে কবিতা পড়া, গল্পপাঠ চলছে৷ সেমিনারের মতো অনলাইনে ওয়েবনারও শুরু হয়ে গেছে৷ বলা যায়, নেটদুনিয়ায় বাকি নেই কিছু৷ আর ক্রমশ সেখানে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়ছে৷

করোনা না হলে, এভাবে বাড়িতে বসে থাকতে না হলে, এঁদের অনেকেই হয়ত নিজেদের প্রকাশ করার সুযোগ পেতেন না৷ অথবা প্রতিদিনের অফিস, বাড়ি, টিভি, আড্ডার মধ্যেই সময় কাটাতেন৷ করোনা তাঁদের দেখিয়ে দিল, মঞ্চ তৈরি৷ লোকের হাতে সময় আছে৷ সকলে দিনের অনেকটা সময় নেটদুনিয়ায় কাটাচ্ছেন, ফলে এই সুযোগটা নিয়ে নিজেকে পরিচিত করার চেষ্টা করতে অসুবিধা কোথায়৷ জড়তা একবার কেটে গেলে, তখন এর একটা দুর্নিবার আকর্ষণ আছে৷ নিজেকে দেখার, নিজেকে দেখানোর আকর্ষণ৷

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

জনপ্রিয়তা ও উৎসাহের জোয়ার দেখে টিকিট কেটে অনলাইন অনুষ্ঠানও শুরু হয়ে গেছে৷ নচিকেতা করেছেন৷ অগাস্টে গানের ব্যান্ড ক্যাকটাস করবে, সেখানে থাকবেন সিধু, অনিন্দ্য৷ কোথাও টিকিটের দাম দুইশ, কোথাও তিনশ টাকা৷ সেই টিকিট ভালো বিক্রি হচ্ছে৷ ফলে এই পাবলিক ব্রডকাস্টারদের আকর্ষণ আরো বেড়েছে৷

সব জায়গায় মান ঠিক থাকছে কি? এককথায় জবাব, থাকছে না, থাকা সম্ভব নয়৷ এ তো পেশাদারদের উৎকর্ষ দেখানোর মঞ্চ নয়, এ হলো আত্মপ্রকাশের মঞ্চ৷ তার মধ্যে বেনোজল থাকবে৷ কিছু লোকের লাইভে কোনো দলের দিকে টেনে কথা বলার প্রবণতা থাকবে, গাইতে গিয়ে সুরে ভুলচুক হয়ে যেতে পারে৷ তাতে কী আসে যায়৷ বিনি পয়সার এই ভুরিভোজে খাবারের অভাব নেই৷ এত সম্ভার চারিদিকে৷ তার মধ্যে থেকে বেছে নেওয়ার অপশন তো থাকছে৷ তবে যাঁরা নিজেকে প্রকাশ করতে মরিয়া, তাঁদের উৎসাহ দিতে একটু না হয় চোখ রাখলেন পাবলিক ব্রডকাস্টারদের শিল্পকলায়৷ না হলে আপনি যখন এই ভূমিকায় নামবেন, তখন অন্যরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন যে৷ কে বলতে পারে, আপনার মধ্যেও তো সেলিব্রিটি হওয়ার মালমশলা আছে৷ একবার নজরে পড়ে গেলে তখন স্কাই ইজ দ্য লিমিট৷

তাই বলছিলাম, অতি খারাপ করোনা একটা ভালো করল, আমাদের এই পাবলিক ব্রডকাস্টারদের সামনে এনে দিল৷