কলকাতায় হয়ে গেল ‘ফুড হ্যাকাথন’
১২ এপ্রিল ২০১৯খুব সহজেই যেটা হতে পারত খেলার ছলে তৈরি করা কিছু কম্পিউটার প্রোগ্রাম এবং ওয়েবসাইট, সেটাই হয়ে গেল সামাজিক সচেতনতা এবং দায়িত্ববোধের নিদর্শন৷ কলকাতার জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গোয়েটে ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে তিনদিনের এই কর্মশালার নাম দেওয়া হয়েছিল Vernetzte Welten - Food hacking, অর্থাৎ নেটওয়ার্কে সংযুক্ত পৃথিবী, যেখানে প্রযুক্তি কাজে লাগানো হবে খাবারের ক্ষেত্রে৷ সেটা রান্নার কৌশল ধারণের জন্যেও হতে পারে, আবার হতে পারে খাদ্য সমস্যার নানা দিক চিহ্নিত করে, তার সমাধানের চেষ্টার মধ্যে৷ পাঁচজন করে প্রতিযোগীর এক একটি দল অংশ নিয়েছিল তিনদিনের এই ফুড হ্যাকাথনে৷ শ্রীলঙ্কার কলম্বো, নতুন দিল্লি এবং কলকাতা - এই তিন শহরে৷ স্থানীয় গ্যোয়েটে ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে স্কুলপড়ুয়া অংশগ্রহণকারীদের বেছে নেওয়া হয়েছিল তিনটি শহর থেকেই৷ তাদের সঙ্গে ছিল জার্মানির বিভিন্ন শহরের স্কুল থেকে আসা পাঁচজন ছাত্র-ছাত্রী৷
জার্মানির গ্যোয়টিঙেন শহর থেকে যেমন এসেছিল জিমিয়ন কেসকার৷ সে জানাল এক রন্ধন প্রযুক্তির কথা, যা মানুষের মতই ভাবনা-চিন্তা করে রান্না করতে পারবে৷ এই ‘রেসিপি জেনারেটর'ই ছিল কলকাতায় ওদের দলের প্রকল্প, এই ফুড হ্যাকাথনে৷ ব্যাপারটা শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, ততটা যদিও নয়৷ কারণ আদতে মানব মস্তিষ্ক যেভাবে ভাবে, সেটাকেই নকল করার চেষ্টা করেছে জিমিয়নদের তৈরি রেসিপি জেনারেটর৷ কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব? যে-কোনো যন্ত্র-মস্তিষ্কের মতোই ওদের এই প্রোগ্রামকেও ছোট বাচ্চাকে শেখানোর মতো প্রথমে বিভিন্ন রান্নার কলা-কৌশল শেখাতে হয়েছে৷ সেই তথ্য রক্ষিত হয়েছে যন্ত্র-মস্তিষ্কে৷ এভাবেই একটু একটু করে নানা দেশের নানা ধরনের রান্না শেখানো হবে তাকে৷ তারপর সব শেখা হয়ে গেলে, যে-কোনো সময় যে-কোনো রান্না নিখুঁতভাবে রেঁধে ফেলতে পারবে৷
কলকাতার একটি দলের সদস্য যুক্তা রাজ অবাঙালি, কিন্তু কলকাতার মেয়ে হওয়ার সুবাদে বাংলা বলার চেষ্টা করল ডয়চে ভেলের সঙ্গে৷ যুক্তা জানাল, ‘ইয়ুগেন্ড হ্যাক্ড একটা জার্মান কোডিং সংস্থা৷ ওদের মূলমন্ত্র, এক উন্নততর বিশ্বের জন্য কোডিং তৈরি করা৷ আমরা খাবার এবং কোডিং মিলিয়ে কিছু বানাতে চেয়েছিলাম৷ তিনদিন আগেও আমরা জানতাম না, এটা একসঙ্গে কী করে হবে৷ কিন্তু ওরা বলল, আমাদের সমাজে, ভারতে যে খাদ্য সমস্যা আছে, ওটার সমাধানে আমরা হ্যাকিং আর কোডিংকে কাজে লাগাব, যাতে খাদ্য সমস্যার একটা ভাল সমাধান পাব৷''
যুক্তাদের দল শুরু করেছিল একসঙ্গে রান্না করার মধ্যে দিয়ে, যাতে নিজেদের মধ্যে প্রথমে একটা বন্ধুত্ব, সংযোগ গড়ে ওঠে৷ তার পর শুরু হয় মূল প্রকল্পের কাজ৷ মাথা ঘামানো শুরু হয় সমস্যার চিহ্নিতকরণ এবং কীভাবে তার সমাধান সম্ভব, সেই নিয়ে৷ ওরা লক্ষ্য বেছে নিয়েছিল খাদ্য সংকট এবং খাবার নষ্ট হওয়ার সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার৷ উপযুক্ত হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যারের মেলবন্ধনে এমন এক যন্ত্র ওরা শেষপর্যন্ত বানিয়েছে, যাতে নিজের খাদ্যসামগ্রী নিজেই ফলানো যায়৷ এতে একদিকে যেমন ফলনের খরচ কমবে, তেমন অরগ্যানিক ফলন, অর্থাৎ রাসায়নিকের বিষমুক্ত প্রাকৃতিক ফসল ফলানো যাবে, যা বৃহত্তর স্বাস্থ্যরক্ষা সুনিশ্চিত করবে৷
কলকাতার গ্যোয়েটে ইন্সটিটিউটের তিনদিনের এই ফুড হ্যাকাথনের এই দিকটিই সবথেকে বেশি নজরকাড়া, যে প্রযুক্তিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, খাদ্যসমস্যা সমাধানের মতো বাস্তব ইস্যুগুলির সঙ্গে৷ কিছুটা খেলার ছলেই চিহ্নিত করা হয়েছে ভারতে ফসলের উপযুক্ত দাম না পাওয়ার কারণে ঋণভারে জর্জরিত কৃষকের আত্মহননের মতো গুরুতর বিষয়কেও৷ দিল্লির একটি দল বানিয়েছে এমন এক ওয়েবসাইট, যেখানে মাঝখানের ফড়ে বা দালালদের এড়িয়ে সরাসরি বাজারের সঙ্গে কৃষকের সংযোগ গড়ে তোলার সফটওয়্যার বানানো হয়েছে৷ যেহেতু অনেক কৃষকই নিরক্ষর, এই ওয়েবসাইটটিতে লেখার বদলে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে ছবি, যা সহজে বোঝা যায়৷ ছবির ওপর ক্লিক করে অনায়াসেই কৃষকেরা নিজের ফসলের ওজন, দাম ঠিক করে নিতে পারবেন৷ ফলে নিছকই প্রযুক্তির উৎকর্ষ নয়, মানবকল্যাণে তার ব্যবহারেরও রাস্তা দেখিয়েছে গোয়েটে ইন্সটিটিউটের এই ফুড হ্যাকাথন৷
এই কর্মসূচির আরও একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য বিশ্বজুড়ে উদ্ভাবন প্রতিভার বিকাশের এক সাধারণ প্রযুক্তিক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া নবীন প্রজন্মের জন্য, যা বিকাশমুখী প্রযুক্তি তৈরির সহায়ক হয়ে উঠবে৷