1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কুড়িগ্রামে করোনাকালে বাল্যবিয়ের হিড়িক

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

করোনা মহামারির সময় কিছু ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হতে পারে- এমন শঙ্কা থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুলগুলোতে কয়েকদফা চিঠি পাঠিয়ে এমন বিয়ে রোধের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছিল৷ কিন্তু তারপরও যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর৷

https://p.dw.com/p/40ScS
Kinderehe Kinderbräute Braut und Bräutigam Hochzeit Kinderhochzeit
ছবি: Getty Images/A. Joyce

কুড়িগ্রামের জেলা শিক্ষা অফিসার শামসুল আলম ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে তিনি যে খোঁজ-খবর পেয়েছেন তাতে ১০টি স্কুলের ২০০ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে৷ এখন বিভিন্ন কমিটি করে এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আগে থেকেই কুড়িগ্রামে বাল্যবিয়ের প্রবণতা ছিল৷ এ কারণে এই জেলাকে কখনোই বাল্যবিয়েমুক্ত ঘোষণা করা যায়নি৷''

কুড়িগ্রামের ধরলা নদী সংলগ্ন সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেনিতে পড়া ৯ জন ছাত্রীর ৮ জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে৷ এখন স্কুলে আসছে শুধু নার্গিস নাহার৷ আর দশম শ্রেনীতে চারজন ছাত্রী ছিল৷ তিনজনের বিয়ের পর এখন আছে শুধুমাত্র জেসমিন আক্তার৷ শুধু তাই নয়, ওই স্কুলের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২২৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৭৯ জন৷ কিন্তু তাদের মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির একজন, সপ্তম শ্রেণির দুই জন, অষ্টম শ্রেণির চারজন, নবম শ্রেণির আটজন ও দশম শ্রেণির তিনজনকে গোপনে বিয়ে দিয়েছে পরিবার৷ সব মিলিয়ে করোনার মধ্যে শুধু এই স্কুলেই ১৮ জন ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে৷ তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ এই তথ্য এখন স্বীকার করছে না৷

‘‘অস্বচ্ছলতা ও দারিদ্রের কারণে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে না বাবা-মা’’: শামসুল আলম

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ফয়জার রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এত ছাত্রীর বিয়ের তথ্য ঠিক নয়৷ আমরা খোঁজ-খবর নিচ্ছি, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে৷'' করোনার মধ্যে ছাত্রীদের খোঁজ রেখেছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সরাসরি ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা হয়নি, কিন্তু অভিভাবকদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত কথা বলেছি৷ তাদের কাছ থেকে খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে৷''

স্কুলটির শিক্ষক ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা পারভীন ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘আমরা এখনও নিশ্চিত নই কতজনের বিয়ে হয়েছে৷ তবে যাদের বিয়ে হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, তাদের চারজনের বাড়িতে আমরা গিয়েছিলাম৷ শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পাওয়া যায়নি৷ কিন্তু পরিবার বিয়ে দিয়েছে বলে স্বীকারও করেনি৷ কেউ বলেছে, আত্মীয়ের বাড়ি গেছে, কেউ বলেছে, রাজশাহীতে ভাইয়ের বাসায় গেছে৷ এখন আমরা পুরো তথ্য জানার চেষ্টা করছি৷''

‘‘পরিবারের মানুষ আমাদের চেয়েও চালাক’’: বাহিনূর মিয়া

এলাকায় এত বাল্যবিয়ের কারণ চাইলে সুলতানা পারভীন বলেন, ‘‘অধিকাংশই চর এলাকা৷ চরের অভিভাবকরা মেয়ে একটু বড় হলেই ‘আপদ' মনে করে দ্রুত বিয়ে দেন৷ অনেক বুঝিয়েও কাজ হচ্ছে না৷ করোনাকালে ঠিকমতো খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি৷ এই সুযোগে ব্যাপক হারে বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেই আমার ধারণা৷''

ওই এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে রিপোর্ট করেছেন কালের কন্ঠের স্থানীয় প্রতিনিধি আব্দুল খালেক ফারুক৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আজও আমি এই এলাকায় রয়েছি৷ যাদের বিয়ে হয়েছে, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কথা বলেছি৷ পরিবার তো স্বীকার করবে না৷ কিন্তু প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে আমি নিশ্চিত হয়েই রিপোর্ট করেছি৷ বাল্যবিয়ের এই ঘটনায় রিপোর্ট ছাপা হওয়ায় স্কুল কর্তৃপক্ষ চাপে পড়ে এখন অস্বীকার করার চেষ্টা করছে৷'' জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে তদন্ত কমিটি করেছে, সেখানেও বাস্তব চিত্রটি উঠে আসবে বলে মনে করেন তিনি৷

তার এলাকার একটা গ্রামের এতগুলো ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়ে গেল কী করে জানতে চাইলে হলোখানা ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের (সারডোব গ্রাম) ইউপি সদস্য বাহিনুর মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অভিভাবকরা তো আর আমাদের সঙ্গে আলাপ করে মেয়েদের বিয়ে দেয় না৷ বরং আমরা জানলে বিয়ে আটকে দেই- এ কারণে তারা খুব গোপনে এই বিয়ে দেন৷'' একটা-দু'টো বিয়ে হওয়ার পরও কি অন্যগুলো আটকানো যেতো না? জবাবে তিনি বলেন, ‘‘ওরা আমাদের চেয়েও বেশি চালাক৷ আমি হয়ত এমন কোনো খবর পেয়ে কারো বাড়ি রাত ১০ টা থেকে ১২টা পর্যন্ত বসে থাকলাম, এরপর বাড়ি এসে ঘুমালাম৷ সকালে উঠে শুনি রাত ২-৩টার সময় বিয়ে হয়ে গেছে৷ এভাবে কেউ মেয়ের বিয়ে দিলে আমরা কীভাবে আটকাবো? বাল্যবিয়ে বন্ধের ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো, এক ইউনিয়নের কাজী অন্য ইউনিয়নের কারো বিয়ে পড়াতে পারবে না৷ এটা করলেই বাল্যবিয়ে অনেকটা বন্ধ হবে৷ আমার এখানের অনেক মেয়েকে পাশের উপজেলায় নিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ সেখানে গিয়ে কি আমি সেই বিয়ে আটকাতে পারবো?''

করোনা মহামারির সময় ব্যাপক হারে বাল্য বিয়ের খবর প্রসঙ্গে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরে তাসনিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘করোনার মধ্যে আমরা স্কুলগুলোর প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি৷ শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখতে বলেছি৷ এখন মিডিয়াতে যে খবরগুলো আসছে তার প্রেক্ষিতে আমরা তদন্ত কমিটি করেছি৷ কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷''

কুড়িগ্রামের জেলা শিক্ষা অফিসার শামসুল আলম বলেন, ‘‘সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে আমরা দেখি, ওই এলাকায় বাল্যবিয়ের হার খুব বেশি৷ এরপর ১০টি বিদ্যালয়ে জরিপ করতে গিয়ে দেখি, আনুমানিক ২০০ বাচ্চা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে৷ এই কারণে পুরো জেলায় জরিপ করা হচ্ছে৷ আসলে এই এলাকার মানুষের অস্বচ্ছলতা ও দারিদ্রের কারণে তারা দ্রুতই মেয়েদের বিয়ে দেন৷ তারা মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেন না৷ কয়েকজন অভিভাবক তো বললেন, আমার মেয়েটা ডিগ্রি পাশ করলে তার বিয়ে দেওয়ার জন্য একটা ডিগ্রি পাশ ছেলে লাগবে৷ তখন তো তার বিয়ে দিতে অনেক টাকা খরচ হবে, সেই টাকা কে দেবে? আপনি দেবেন? এমন প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয় প্রধান শিক্ষকদের৷''

‘‘পরিবার বিয়ে দিয়েছে বলে স্বীকারও করেনি’’: সুলতানা পারভীন

সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির একমাত্র ছাত্রী এখন নার্গিস নাহার৷ তার বাবা মো. আব্দুল খালেক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার তিন মেয়ে৷ এর মধ্যে এইচএসসি পাশ করিয়ে বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি৷ ছোট মেয়েটা আরো একটু বেশি পড়তে চায়৷ ওর ইচ্ছে ডিগ্রি পর্যন্ত পড়বে৷ এটা ও ওর মায়ের কাছে বলেছে৷ ওর মা আমাকে জানানোর পর বলেছি, দুই মেয়ের তো বিয়ে হয়ে গেছে, নার্গিস ছোট৷ ওর যেহতু ইচ্ছে ডিগ্রি পর্যন্ত পড়বে, তাই আমি সেটা করবো৷ ডিগ্রি পাশ করার আগে ওকে বিয়ে দেবো না৷'' এই এলাকায় এত বাল্যবিয়ের কারণ সম্পর্কে তার বক্তব্য, ‘‘এটা নদী ভাঙন এলাকা৷ অধিকাংশ মানুষের বাড়িঘর ধরলা নদীতে ভেঙে গেছে৷ ফলে তারা নিজেরাই খেতে পারে না, মেয়েকে পড়াকে কীভাবে৷ এই কারণে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারলে ঝামেলা মুক্ত হলো বলে তারা মনে করেন৷ আমি নিজেও একটা প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামে গ্রামে গরুর চিকিৎসা করি৷ তা দিয়ে যা রোজগার হয়, কোনোভাবে চলি৷ আগে আমার অনেক জমি ছিল, সেগুলো ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে৷ এখানকার মানুষের আর্থিক অবস্থা আসলে ভালো না৷''