1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কেন মাদক গডফাদাররা ধরা পড়ছে না

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৩ জুন ২০১৮

বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার৷ কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন প্রায় দেড়শ' ব্যক্তি৷ কিন্তু এখনো মাদকের কোনো গডফাদার আটক বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায়নি৷

https://p.dw.com/p/2yrl7
Bangladesch - Zahlreiche Todesvolle durch Razzien gegen Drogenhandel
ছবি: bdnews24

কক্সবাজারের টেকনাফে মৌলভীপাড়া ও জালিয়াপাড়া বলে দু'টি এলাকা আছে৷ ঐ দু'টি এলাকায় ৭-৮ বছর আগেও কোনো পাকা বাড়ি ছিল না৷ কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে সেখানে এখন তাক লাগানোর মত কয়েকশ' বিলাসবহুল বাড়ি৷ অভিযোগ আছে, ইয়াবা ব্যবসা করে ওই জনপদের অধিকাশ মানুষ এখন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক৷

আগে তারা কেউ দিনমজুর, কেউ জেলে আবার কেউবা পরিবহণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন৷ অভিযান শুরুর পর ওই দুই এলাকা বলতে গেলে পুরুষ শূন্য৷ আবার কোনো বাড়ি পুরোপুরি তালাবদ্ধ৷ টেকনাফ পুলিশ শুক্র ও শনিবার দুই দফায় ওই এলাকায় নিস্ফল অভিযান চালিয়েছে৷ কোনো মাদক ব্যবসায়ীকে পায়নি৷ প্রশ্ন উঠেছে যে, এরা তো বছরের পর বছর মাদক ব্যবসা করে আসছেন, তাহলে পুলিশ তাদের আগে কেন গ্রেপ্তার বা গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেনি?

এই প্রশ্নের জবাবে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রনজিত কুমার বিশ্বাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর আগেও আমরা অভিযান চালিয়েছি৷ তবে তারা বাড়ি থাকেনা তাই আটক করতে পারিনি৷ এখন তারা বাড়িতে তালা মেরে পালিয়েছে৷ তাদের বাড়িগুলো রাজপ্রাসাদের মত৷''

‘তারা বাড়ি থাকেনা তাই আটক করতে পারিনি’

তিনি বলেন, ‘‘ওই দু'টি এলাকা সীমান্তবর্তী৷ তাই মাদক ও ইয়াবা পাচারের বড় রুট৷ আপাতত ওই রুট আমরা বন্ধ করে দিয়েছি৷ আর বেশ কিছু ইয়াবা ব্যবসায়ীকে আটক ও ইয়াবা উদ্ধার করেছি৷''

দেশের বিভিন্ন থানা এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে যারা মাদক ব্যবসায়ী বলে পরিচিত, তারা এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে৷ যাদের আটক করা হচ্ছে, তারা মাদকসেবী ও সাধারণ খুচরা বিক্রেতা৷

যারা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন বা মূল পাচারকারী তারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন না৷ তাদের কেউ এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে, আবার কেউ রাজনৈকিতভাবে প্রভাশালী হওয়ায় এলাকাতেই আছেন৷ আর মাদক আইনের ফাঁকের কারণে তাদের ধরাও যাচ্ছেনা বলে পুলিশ জানায়৷

মাদক ব্যবসার সঙ্গে কোনো কোনো এলাকার পুলিশ সদস্যদের যোগসাজশ থাকায় অভিযান দেখানোর জন্য সাধারণ মানুষকে হয়রানির অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে অনেক৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল একাধিকবার বলেছেন, গডফাদারসহ কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না৷ হয়রানি করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ কিন্তু তাঁর এই ঘোষণার মধ্যেই টেকনাফের মাদকের গডফাদার বলে পরিচিত সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আমানুর রহমান বদি তাঁর দুই সহযোগীকে নিয়ে সৌদি আরবে ওমরাহ করতে চলে গেছেন৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা হল যে, বদির বিরুদ্ধে মাদকের অভিযোগ আছে, তবে প্রমাণ নেই৷

বাংলাদেশে মাদকের সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা , আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত বলে অভিযোগ আছে৷ তাদের একাংশ মাদক চোরাচালান করেই এখন সিআইপি ব্যবসায়ী হয়েছেন৷

Bangladesch - Zahlreiche Todesvolle durch Razzien gegen Drogenhandel
সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদিছবি: bdnews24

এ রকম ১৪১ জন মাদক ব্যবসায়ীর তালিকাও করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ কিন্তু তারা ধরা পড়ছেন না, বা তাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছেনা৷ এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার তৎপরতা ছাড়াও আইনের ফাঁক ফোঁকর কাজ করছে বলে অভিযোগ আছে

বাংলাদেশে প্রচলিত মাদক আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থাকলেও কারোর দখলে বা অবস্থানে মাদক পাওয়া না গেলে তাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব নয়৷ যারা এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন বা গডফাদার তারা মাদক পরিবহণ বা নিজেদের কাছে রাখেন না৷ ফলে তারা মূল অপরাধী হলেও পার পেয়ে যান৷

যারা খুচরা বিক্রয় করেন বা সেবন করেন তারাই ধরা পড়েন৷ আর আইনে মাদক সেবনকারী, বিক্রেতা, পাচারকারী ও নিয়ন্ত্রক আলাদাভাবে নেই৷ ফলে যার কাছে মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়, তাকেই মামলায় আসামি করা হয়৷

আর আইনের এই দুর্বলতার কারণে মাদক মামলায় শাস্তিও হয় খুব কম৷ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, এই আইনে ২০১৭ সালে সারাদেশে মোট মামলা হয়েছে এক লাখেরও বেশি৷ এই মামলগুলো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ডের অভিযোগ, আটক এবং মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ভিত্তিতে করা হয়েছে৷ আর এটা ২০১৬ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন৷ আর ২০১৭ সালে অন্যান্য মাদকের সঙ্গে আলোচিত মাদক ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে চার কোটি ৮০ হাজার পিস৷ এই বছরে মাদক মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ জনকে৷

কিন্তু ২০১৭ সালে মাত্র আড়াই হাজার মামলা আদালতে নিস্পত্তি হয়েছে৷ আর এসব মামলায় ২ হাজার ৬শ' ৮০ জন আসামির বেশিরভাগই খালাস পেয়েছেন৷

‘তারা নিজেদের কাছে মাদকদ্রব্য রাখেন না’

বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মাদক আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে মোট ১১ হাজার ৬শ' ১২টি৷ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সে বছর শাস্তি পেয়েছেন ১ হাজার ৬৫ জন৷ আর খালাস পেয়েছেন ১ হাজার ৬শ' ১৫জন৷

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মাদকসহ হাতেনাতে ধরতে না পারলে তাকে আইনের আওতায় আনা যায় না৷ ফলে গডফাদাররা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে৷ কারণ তারাতো নিজেদের কাছে মাদকদ্রব্য রাখেন না৷ আমরা তাদের সম্পর্কে তথ্য পেলেও মাদক আইনে কিছু করতে পারি না৷''

তবে মানিলন্ডারিং, দুর্নীতি দমন ও আয়কর আইনে গডফাদারদের ধরার সুযোগ আছে বলে জানান এই কর্মকর্তা৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা আটকদের জবানবন্দির ভিত্তিতে কিছু মামলা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছি মানি লন্ডারিং আইনে আনার জন্য৷''

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রনজিত কুমার জানান, ‘‘আমরা কিছু মামলা করেছি মানি লন্ডাংরিং আইনে৷ তবে কাজটি বড় আকারে করার জন্য সরকারের কয়েকটি সংস্থা এখন টেকনাফ-কক্সবাজার এলাকায় কাজ করছে৷''

এদিকে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, তারা মাদকের গডফাদারদের একটি তালিকা করে দুদকে দিয়েছে৷ তাদের সাধারণ মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে ধরা যাচ্ছে না৷ তাই তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে মানিলন্ডারিং আইনে যাতে মামলা করা যায়৷ দুদক ওই তালিকা ধরে কাজও শুরু করেছে বলে জানা যায়৷

২০১৪ সালে দুদক ইয়াবার গডফাদার বলে পরিচিত শাসক দলের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল৷ নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুসারে, ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হওয়ার পর বদির আয় বাড়ে ৩৫১ গুণ৷ আর নিট সম্পদ বাড়ে ১৯ গুণের বেশি৷ টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও টেকনাফে জ্বালানি তেলের ব্যবসা করে ২০০৯ থেকে ২০১৪ এই পাঁচ বছরে বদি ৩৬ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪০ টাকা আয় করেন বলে হলফনামায় জানান৷ এর আগে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জমা দেয়া হলফনামায় বদির বার্ষিক আয় ছিল দুই লাখ ১০ হাজার ৪৮০ টাকা৷ আর ব্যয় ছিল দুই লাখ ১৮ হাজার ৭২৮ টাকা৷

এ বিষয়ে আপনার মতামত লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য