1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গরীব দেশের ঘোড়ারোগ!

১১ মার্চ ২০২২

ভারতীয় কাঁচা মরিচের দামের ঝাল আর ঝাঁজ কতটা ভয়াবহ তা ইউরোপের শহরগুলোতে বুঝা যায়৷ আমি বুঝেছিলাম অস্ট্রিয়ার শহর ক্যারেমসে থাকার সময়৷

https://p.dw.com/p/48MqR
ছবি: imago/Levine-Roberts

ইরাসমাস মুন্ডাস প্রোগামে মাস্টার্স করার সময় ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালে ছয়টি মাস আমার কেটেছিল এই শহরে৷ একদিকে দানুব নদী আরেক দিকে পাহাড় --  অস্ট্রিয়ার পঞ্চম বৃহত্তম শহর ক্যারেমসকে দিয়েছে অদ্ভুত এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য৷ গ্রীষ্মে সারি সারি আঙুর ক্ষেত শহরের সৌন্দর্য্য আরো বাড়িয়ে দেয়৷ কিন্তু মাত্র বিশ হাজার অধিবাসীর এই শহরের মানুষের কাছে দামী একটা জিনিস হলো ছোট ছোট তীব্র ঝালের কাঁচা লঙ্কা৷ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অস্থায়ী কৃষি মার্কেটগুলোতে ভারতীয় কাঁচা মরিচ পাওয়া যায়৷ শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত পণ্য এসব মার্কেটে গিয়ে বিক্রি করেন৷ কিন্তু এসব মার্কেটে ভারতীয় কাঁচা লঙ্কার দাম শুনে চক্ষু চড়ক গাছ হওয়ার মতো অবস্থা হবে৷ দশটি কাঁচা লঙ্কার দাম এক-দুই ইউরো! আমার মতো বাঙালি ভোজন রসিক যাদের পক্ষে বেশ ঝালওয়ালা কাঁচা লঙ্কা ছাড়া রান্না করার কথা ভাবাই অসম্ভব তাদের কাছে ইউরোপের এই জীবনের চেয়ে বাংলাদেশের জীবন মনে হবে ঢের ভাল৷ অনেকে তাই দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর জন্য ইউরোপীয় ঢাউস ঢাউস সাইজের লাল লঙ্কাগুলো দিয়ে রান্না করে থাকে৷ এসব লঙ্কার সাধ আমার কাছে মিষ্টি আলুর মতো মনে হয়৷ 

পড়ালেখা আর গবেষণার কাজে ইউরোপের পাঁচটি শহরে লম্বা সময় ধরে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ এসব শহরে থাকার সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ে বেশ কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ যেমন ২০১২ সালে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে থাকার সময় খাবার পানির চেয়ে কোকাকোলার দাম এত কম ছিল যে আমরা শিক্ষার্থীরা পানির পরিবর্তে কোকাকোলা কিনতাম৷ এই শহরে চিংড়ি মাছের দাম এত বেশি ছিল যে আমরা গুনে গুনে চিংড়ি মাছ কিনতাম৷ আর এখন লন্ডনে যখন ঢ্যাঁড়স, লাউ ও চিচিঙ্গার মতো আমাদের দেশীয় সবজিগুলো কিনতে যায় তখন ‘গরীবরে ঘোড়া রোগে'র অবস্থা হয়৷ এক কেজি ঢ্যাঁড়স কিনতে গিয়ে এখানে একজন লোককে তার এক ঘন্টার পারিশ্রমিক খরচ করতে হয়, বাংলাদেশি টাকায় এক হাজার টাকা৷

তবে ইউরোপের বাজারগুলোতে এ চিত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে খাটে না৷ ইউরোপের এই শহরগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেমন হুটহাট বাড়ে না তেমনি বেশিরভাগ মানুষের কাছে চাহিদা আছে বা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় এমন জিনিসপত্রের দাম স্থানীয় জনগণের আওতার বাইরে না৷ পোলান্ডের গরীব শহর উজ থেকে শুরু করে ডেনমার্কের ধনী শহর কোপেনহেগেন সবখানে আমার একই অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ যেমন, তেল, লবণ, চিনি, আটা, ময়দা এসব পণ্যের দাম সুপার শপ থেকে শুরু করে রাস্তার পাশের স্ট্রিট মার্কেটে প্রায়ই একই দামে বিক্রি হয়৷ এখানে নানা উপলক্ষে বা ছুঁতোয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্কট দেখা দেয় না, বাড়ে না এসব পণ্যের দাম৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দামের ওপর ইউরোপের দেশগুলোর সরকারের বা সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কড়া নজরদারি আর নিয়ন্ত্রণ থাকে৷ কিন্তু বাংলাদেশে বছরে অন্তত তিন থেকে চারবার গণমাধ্যমের লাগাতার এজেন্ডা থাকে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি৷ বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের দৃশ্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই৷ চাল, তেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম যখন-তখন বেড়ে যায়৷ কিছু পণ্য আছে সরবরাহে ঘাটতি না থাকার পরও দাম বেড়ে যায়৷ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম দামে একটি ফুলকপি লন্ডনের ভ্রাম্যমাণ কৃষি মার্কেটগুলোতে পাওয়া যায়৷ লন্ডনের সুপারশপগুলোতে আটা, ময়দাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম এখন হয় ঢাকার বাজারের চেয়ে কম না হয় কাছাকাছি৷   

বাংলাদেশে যখনই বাজারে পণ্যের দাম বাড়ে, তখন ব্যবসায়ীরা দুটি যুক্তি দেখান৷ এক. আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং দুই. ডলারের দাম বৃদ্ধি৷ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বিশ্বের আর কোন দেশ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে না এবং কিনলেও ডলার দিয়ে কিনে না৷ বাংলাদেশে এখন ৫ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৯০০ টাকা আর লন্ডনে দাম ৫০০-৬০০ টাকা৷ বাংলাদেশে যে সিদ্ধ চালের দাম কেজি প্রতি ৬০-১০০ টাকা, লন্ডনে এর দাম ৬০ টাকা (অবশ্য লন্ডনে বেশিরভাগ মানুষ বাসমতী চাল খায়)৷ বাংলাদেশে বিদেশি চিনির দাম কেজি প্রতি যেখানে প্রায় ৯০-১০০ টাকা সেখানে লন্ডনে চিনির দাম ৫০ টাকা৷ আর বৃটেনে যেসব পণ্য উৎপাদিত হয় সেগুলোর দাম আরো কম৷ অথচ বাংলাদেশে আমরা কি দেখি? নিজ ভূখণ্ডে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাংলাদেশের ভেতরেই বেশি৷ লন্ডনের বাজারে যেখানে ৫০০ টাকা দিয়ে এক কেজি গরুর মাংস পাওয়া যায় সেখানে ঢাকার বাজারে এ কথা কল্পনাই করা যায় না৷ সরকারী বিপণন সংস্থা (টিসিবি) প্রতিদিন যে বাজারদরের তালিকা প্রকাশ করে সেটিতে দেখা যাচ্ছে গত কয়েক মাসে ২০টি পণ্যের মধ্যে ১৮টিরই দাম বেড়েছে৷

বাংলাদেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ও খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে যাওয়ার এই প্রবণতা নতুন কিছু নয়৷ যে কোন উৎসবের আগে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া, পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের একটি অতি প্রচলিত ধরন৷ অথচ ইউরোপের যে কোনো দেশে ক্রিসমাস, ব্ল্যাক ফ্রাইডে এমনকি ব্যাঙ্ক হলিডেগুলোতে পণ্যের দামে ছাড় দেয়ার হিড়িক পড়ে যায়৷ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ঢামাঢোলে ইউরোপের কোনো বাজারেই পণ্যের দাম বাড়েনি, অথচ বাংলাদেশের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এই যুদ্ধকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন৷ বাংলাদেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে যতটা না আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে, তার চাইতে বেশি ঘটানো হয়েছে দেশীয় একচেটিয়া আমদানিকারক, কারবারি, মজুতদার, মধ্যস্বত্বভোগী খুচরা বিক্রেতাসহ সব গোষ্ঠী নানা অজুহাতে আমদানিকৃত এবং দেশীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করার মানসিকতার প্রকাশ৷

মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক, গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক, গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ছবি: bdnews24.com

প্রশ্ন হলো ইউরোপের ধনী-দরিদ্র সব দেশ কিভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখে? বাংলাদেশ কেন পারে না? ইউরোপের সরকারগুলো নিয়মিত বাজার মনিটরিং করে, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা ও যোগান নিয়ে গবেষণা করে আগাম ব্যবস্থা নেয়৷ উৎপাদনের উৎস থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত অনেক স্তর থাকে৷ বাংলাদেশে কৃষক বা উৎপাদনকারী পণ্যের ন্যায্য মূল পায় না, কিন্তু ভোক্তাকে অনেক বেশি দামে কিনতে হয়৷ এর কারণ রাজনৈতিক সুবিধাভোগী মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী চক্র৷ ইউরোপে কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারে তার ব্যবস্থা করে সরকার৷ এখানে সরকারই মধ্যস্বস্ত্বভোগী, অন্য কেউ বাজারে ফায়দা লুটতে পারে না৷ তাছাড়া পচনশীল পণ্যগুলো যাতে দূর-দূরান্ত থেকে এসে কৃষক সরাসরি বিক্রি করতে পারে সেজন্য শহরের প্রাণকেন্দ্রগুলোতে কৃষি মার্কেটের ব্যবস্থা করে৷

প্রতি মৌসুমেই যখন দাম বাড়ে তখন বাংলাদেশে সরকারের বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনেক তোড়জোড় আমরা দেখি৷ কিন্তু এর সবকটিই রিঅ্যাকটিভ৷ কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর কোন পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত নিতে দেখা যায়নি৷ ফলে জীবনযাত্রার মান অনেক নিচে হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে৷ পরিণামে মূল্যস্ফীতির চাপ সাধারণ মানুষের জীবনে বেড়েই চলেছে৷ এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে একসময় বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের ভাগ্যে আলু সেদ্ধ ছাড়া আর কিছুই জুটবে বলে মনে হয় না৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো তখন এতটাই তাদের আওতার বাইরে চলে যাবে যে সবটাই গরীব দেশের মানুষের ঘোড়ারোগ মনে হবে৷ তখন সাধ থাকবে, সাধ্য আর সাধনা কোনটাই থাকবে না৷