1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গরু উৎপাদন: ভারতের নিষেধাজ্ঞা যেভাবে আশীর্বাদ হলো

সুলাইমান নিলয় ঢাকা
১৭ জুলাই ২০২১

২০১৫ সালের পহেলা এপ্রিল ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের এক নির্দেশনার পর সেই দেশ থেকে বাংলাদেশে গবাদি পশু রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়৷

https://p.dw.com/p/3wbb8
Bangladesch Viehwirtschaft Samarai
ছবি: BDNEWS24

নিষেধাজ্ঞার বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় কোটি গবাদি পশু আসতো, যার মূল্য প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার৷

এত বড় মার্কেটে হঠাৎ নিষেধাজ্ঞায় নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরাও৷ এর আগেই মাংসের বাজারে আগুন লেগেছিল৷

এরপর বাংলাদেশে গবাদি পশু, বিশেষ করে গরুর মাংসের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা জেগেছিল৷

তবে সে আশঙ্কা সত্যি হওয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশ মাংসের গরু উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে গেছে বলে দাবি করছে সরকার এবং খামারিরা৷

এমনকি ২০১৫ সালের সেই নিষেধাজ্ঞার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. শেখ আজিজুর রহমান ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপে ভারত সরকারকে বরং ধন্যবাদই দিয়েছেন৷

ডা. শেখ আজিজুর রহমান

তার মতে, ২০১৫ সালে ভারত সেই সিদ্ধান্ত না নিলে বাংলাদেশ মাংসের জোগানে স্বনির্ভর হতে পারতো না৷

তিনি বলেন, মোদী সরকার নিষেধাজ্ঞা না দিলে আমরা বুঝতে পারতাম না, আমাদের মধ্যে কতটা উদ্ভাবনী ক্ষমতা লুকিয়ে আছে৷ আমাদের খামারিরা, কৃষকরা দিনরাত পরিশ্রম করে সেই ঘাটতিটা পুষিয়ে দিয়েছেন৷

তিনি বলেন, আমরা প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম গরুর মাংসের কেজি এক হাজার টাকা হয়ে যাবে৷ তা কিন্তু হয়নি৷ (গরুর মাংসের দামে) আমরা এখন মোটামুটি সহনীয় মাত্রায় আছি৷ (পশুর) খাবারের দামটা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে আরো সহনীয় মাত্রায় যেতে পারতাম৷

ডাচ ডেইরির গল্প

২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মুন্সীগঞ্জের ডাচ ডেইরি লিমিটেড বাংলাদেশের সর্বাধুনিক খামারগুলোর একটি৷ এখন এই খামারে গরু ছাড়াও ভেড়া এবং ছাগল রয়েছে৷ এবার প্রায় ৩০০টি গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়৷ তবে মনে রাখতে হবে, ডাচ ডেইরি মূলত দুধের খামার৷

এই খামার কর্তৃপক্ষ বলছে,তারা দুই ধরনের গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেন৷ প্রথমত, খামারে জন্ম নেয়া ষাঁড়, বাছুরগুলো বড় করে কোরবানির সময়ে বিক্রি করেন৷ দ্বিতীয়ত, দেশি বাজার থেকেও কিছু গরু সংগ্রহ করে তারা লালনপালন করে থাকেন৷ 

Bangladesch | Dutch Dairy Farm in Munshiganj
মুন্সীগঞ্জের ডাচ ডেইরি লিমিটেড বাংলাদেশের সর্বাধুনিক খামারগুলোর একটিছবি: Dutch Dairy

বাংলাদেশে কি আসলেই গবাদি উৎপাদনে বিপ্লব হয়ে গেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে এই খামারের সিইও গিয়াস আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যদি মাংসের চাহিদা পূরণের দিক থেকে দেখেন, তাহলে বিপ্লব হয়েছে বলা যাবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সারা বছর যত পশু জবাই হয়, প্রায় সমান সংখ্যক পশু জবাই হয় কোরবানির সময়ে৷ এক সময় কোরবানির বাজারসহ সারা বছরের বাজারের বড় একটা অংশ ভারত থেকে আসতো৷’’

তার মতে, এখন কোরবানির সময় ভারত থেকে গরু আসে না বললেই চলে৷ সারা বছর যা আসে, তার পরিমাণও খুবই কম৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমরা নিজেদের পশু দিয়েই চাহিদা মেটাতে পারছি৷ এই দিক থেকে ভাবলে অবশ্যই বিপ্লব হয়েছে৷’’

তবে গিয়াস আহমেদের মতে, দুধের উৎপাদনের দিকে তাকালে কিন্তু সেটা মনে হবে না৷ সেখানে পরিস্থিতি পাল্টাতে উন্নত জাতের গাভী প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি৷

তার মতে, উন্নত জাত এবং সঠিক ব্যবস্থাপনাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হলে বাংলাদেশে বর্তমানে যে সংখ্যক গাভী রয়েছে, সেই সংখ্যার গাভী দিয়েই ৮-৯গুণ বেশি দুধ উৎপাদন সম্ভব৷ মাংসের গরুর ক্ষেত্রে একই পদক্ষেপ নিলে মাংস উৎপাদন বাড়বে ২-৩গুণ৷

২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে গাভী এনে যাত্রা শুরু করেছিল ডাচ ডেইরি৷ তিনি জানান, ব্রাজিল থেকে গাভী আনার জন্যও সরকার থেকে অনুমোদন নিয়ে রেখেছেন তারা৷ করোনা না থাকলে এতদিনে সেই গাভী চলে আসতো৷

তিন বলেন, ‘‘এখনো কাজ করার মতো অনেক জায়গা রয়েছে৷ তবে সরকারকে পলিসি পরিবর্তন করতে হবে এবং আরো নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে৷’’

এখনো কাজ করার মতো অনেক জায়গা রয়েছে

শহরের বুকে সম্রাট ডেইরি

ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে সম্রাট ডেইরি ফার্ম গড়ে তুলেছেন এক সময়কার প্রবাসী জাকির হোসেন৷ চার কাঠার উপরে নির্মিত চারতলা একটি ভবনে তিনি গড়ে তুলেছেন গরুর খামার৷ বহুতল ভবনে খামার নির্মাণের এই ঘটনা চমক সৃষ্টি করে৷ অনেকেই এই খামার দেখতেও যান৷

কিছুদিন আগেও তার খামারে আড়াইশ’ গরু ছিল৷ বিক্রি করে দেয়ার পর এখন ৪৫টি দুধের গরু রয়েছে৷

তিনি বলেন, ‘‘সিঙ্গাপুর থাকার সময় দেখেছি, বহুতল ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে গাড়ি পার্কিং হয়, ছাদের উপরে বাগান হয়৷ এসব দেখে আমার মনে হয়েছে, খামার কেন হবে না? দেশে ফিরে তাই আমি এই খামারটি করেছি৷’’

তিনি বলেন, ‘‘প্রতিটি ফ্লোরে গরু আনার পূর্বে বালু দিয়েছি৷ সেটার উপর আরেকটা ঢালাই দিয়েছি৷ এমন ব্যবস্থা করেছি, যাতে কোনোভাবেই পানি ছাদ স্পর্শ না করে৷’’

যেভাবে ভারত থেকে গরু আসতো

ভারত থেকে বাংলাদেশে বৈধ পণ্যের মতো গরু আনার সুযোগ কখনোই ছিল না৷ গরু আসতো অনানুষ্ঠানিকভাবে৷

সিপিডির করা ‘বাংলাদেশ'শ ফরমাল অ্যান্ড ইনফর্মাল এগ্রিকালচারাল ট্রেড উইথ সার্ক কান্ট্রিজ' শীর্ষক এক পেপারে বলা হয়, অনেকের মতে, বাংলাদেশ ভারতের অনানুষ্ঠানিক এই বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার৷

 ভারত থেকে গরু বাংলাদেশে ঢোকার পর দেখানো হতো, গরুগুলো মালিকানাহীনভাবে সীমান্ত এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল৷ এরপরের ধাপে সীমান্তরক্ষীরা গরুগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে আসতো৷ সেখান থেকে ৫০০ টাকা ফি দিয়ে গরুর প্রকৃত মালিকরাই গিয়ে মালিকানা দাবি করতো এবং গরু নিয়ে আসতো৷ এই পদ্ধতিটিই মোটামুটি সবচেয়ে স্বীকৃত ছিল৷

এর বাইরে বাঁশ-রশি দিয়ে একটা যন্ত্র তৈরি করতো চোরাকারবারিরা৷ সেটির সাহায্যে এক পাশ থেকে অন্যপাশে কাঁটাতারের বেড়ার উপর দিয়ে গরু নিয়ে যেতো তারা৷ তাছাড়া নদী-জঙ্গলে ঢাকা এলাকায় সবার চোখ এড়িয়েও গরু আসতো বাংলদেশে৷

মেহেরপুরের সাংবাদিক তুহিন আরণ্য বলেন, ‘‘এক সময় ভারত থেকে গরু আনাই ছিল সীমান্ত এলাকার বড় ব্যবসা৷ সীমান্তের অনেক মানুষ সারাদিন এই কাজে ব্যস্ত থাকতো৷’’

প্রতিদিন অন্তত এক হাজার গরু আসতো বলে মনে করেন তিনি৷

তার মতে, এখন গরু আসা মোটামুটি বন্ধই বলা চলে৷ কিছু কিছু জায়গা দিয়ে যেখানে কাঁটাতারের বেড়া নেই, সেখানে খুবই ঝুঁকি নিয়ে কেউ কেউ গরু নিয়ে আসে৷ কিন্তু এর সংখ্যা এতটাই কম যে, তা ধরার মতো নয়৷

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ এমরানের মতে, ভারত থেকে গরু একেবারে যে আসে না-তা না, তবে সংখ্যাটা খুবই কম৷

ডাচ ডেইরির সিইও গিয়াস আহমেদ বলেন, ‘‘কোরবানির সময় আসে না৷ তবে সারা বছর কিছু কিছু আসে৷’’

সাংবাদিক তুহিন আরণ্যের মতে, আগে গরু আসতো, কারণ, ভারতের পাশ থেকেও গরু আনতে বিএসএফ সহায়তা করতো৷ এখন সেই সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে৷ তাই ভারতের গরু আসছে না৷

মো. শাহ এমরান

এই খাতে উন্নয়ন

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. শেখ আজিজুর রহমানের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৬ লক্ষাধিক খামার আছে৷ ২০১৫ সালের আগে এটা ২ লাখের কম ছিল৷

তিনি বলেন, ‘‘আরেকভাবে এটাকে তুলনা করা যেতে পারে, ২০০৯-১০ সালে যেখানে আমরা ১২ দশমিক ৬০ লাখ মেট্রিক টন মাংস উৎপাদন করতাম৷ ২০১৯-২০ সালেই সেটা পৌঁছে যায় ৭৬ দশমিক ৭৪ লাখ মেট্রিক টনে৷’’

ভারত রপ্তানি বন্ধের পর কীভাবে বাংলাদেশ এত বিশাল ঘাটতি পূরণ করেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করে, কীভাবে খুব সহজে একটা গরুকে হৃষ্টপুষ্ট করা যায়-সেটি মানুষকে শেখানে শুরু করে৷ পরে আমরা একটা প্রকল্পও তৈরি করি৷ সারা দেশব্যাপী আমরা প্রশিক্ষণ ছড়িয়ে দেই৷’’

তিনি বলেন, ‘‘বিদেশ থেকে প্রচুর ছেলে দেশে ফিরে বেকার হয়ে যায়৷ তাদের হাতে প্রচুর টাকা ছিল৷ তাদের অনেককে আমরা এই খাতে নিয়ে আসি৷’’

এমনকি এ খাতে বিপথে যাওয়া অনেককেও পুনর্বাসন করা হয়েছে বলে জানান তিনি৷

তিনি বলেন, ‘‘মাস্তান অনেক ছেলেকে আমরা এই পথে নিয়ে এসেছি৷ অনেক নামকরা মাস্তানকেও আমরা খামারে নিয়ে এসেছি৷ তাদেরকে বুঝিয়েছি, তোমরা যে কাজ করছো, সেটা ভালো না৷ দেশের জন্য কাজ করো৷ মানুষকে প্রোটিন, ডিম দুধ সরবরাহ করো৷’’

তবে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ এমরান গবাদিপশু মোটাতাজা করার প্রশিক্ষণ ছড়িয়ে দেয়ার কৃতিত্ব সরকারকে দিতে নারাজ৷

কৃতিত্ব নিতে হলে সরকারের খাদ্যের দাম কমানোর জন্য কাজ করার আহ্বান জানান তিনি৷

তিনি বলেন, ‘‘গবাদিপশুর খাদ্য আমদানির কাজটি মাত্র তিন ব্যক্তির হাতে বন্দি৷ তারা প্রতি কোরবানিতে খাদ্যের দাম বাড়ায়৷ সেটা আর কমায় না৷ পরে সারা বছর ওই দামেই বিক্রি করে৷’’

ডাচ ডেইরির উদ্যোক্তা গিয়াস আহমেদ বলেন, ‘‘কোনো কোনো আমদানি শুল্ক ১০০ শতাংশের বেশি৷ সরকার ডেইরি আর মাংসের গরু মিক্স হয়ে যাবে মনে করে, উন্নত জাতের গরু আমদানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছে৷’’

এসব প্রত্যাহার করা উচিত বলে মনে করেন তিনি৷

গবাদিপশুর খাদ্যের দাম কমানোর আহ্বান জানান তিনিও৷

খাদ্যের অতিরিক্ত দামের বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রাণিসম্পদের মহাপরিচালকও৷ তবে তিনি বলেন, ‘‘যাদের হাতে মার্কেটটা রয়েছে, সব সময় তাদের উপর কঠোর হওয়া যায় না৷ কারণ, তিন মাস ব্যবসা না করলেও তাদের হবে৷ কিন্তু আমাদের পশু তো তিন মাস না খেয়ে থাকতে পারবে না৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান