1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘ঘরের ছেলে’র বিদায়ে শোক

সনৎ বাবলা
২৭ নভেম্বর ২০২০

‘কালো মানিক’-এর অধ্যায় চুকিয়ে বাঙালি আশির দশকের মাঝামাঝিতে মন-প্রাণ শপে দিয়েছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনায়৷ আকণ্ঠ ফুটবল-সুধা পান শেষে ‘ফুটবল ঈশ্বর'-এর মহা প্রয়ান পর্বে তারা শোকাচ্ছন্ন৷

https://p.dw.com/p/3luUP
বুয়েনস আইরেসে ম্যারাডোনাকে শেষ বিদায় জানাতে ভক্তদের ভিড়
বুয়েনস আইরেসে ম্যারাডোনাকে শেষ বিদায় জানাতে ভক্তদের ভিড়ছবি: Tomas Cuesta/Getty Images

এদেশের মানুষ যে সামনা-সামনি ঈশ্বর দর্শনের প্রত্যাশায় ছিল, কিন্তু তার আগেই সারা বিশ্বকে কাঁদিয়ে মর্ত্যলোকের মায়া ছেড়ে তিনি স্বর্গে আরোহন করেছেন৷

মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে সফল অস্ত্রোপচার হয়েছিল তার মস্তিষ্কে, এরপর হাসি-খুশি চেহারায় তিনি হাসপাতাল ছেড়ে গেছেন৷ তাই ডিয়েগোর মৃত্যু যেন বজ্রাঘাত হয়ে ফিরেছে ফুটবলানুরাগীদের কাছে৷ অথচ এ বছর তাকে বাংলাদেশে আনার জন্য তোড়জোড় হয়েছিল৷ ফুটবল কিংবদন্তীকে এনে বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ রাঙিয়ে তোলার পরিকল্পনা হয়েছিল গত বছর৷ শেষপর্যন্ত নানা কারণে পিছিয়ে গিয়েছিল সেই উদ্যোগ৷ অন্যতম উদ্যোক্তা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র সহ সভাপতি সালাম মুর্শেদীর আক্ষেপ সঙ্গী হয়ে গেছে সারা জীবনের মত, ''তার এজেন্টের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা কিছুটা এগোলেও শেষমেষ নানা সীমাবদ্ধতায় সেটা আটকে যায়৷ এরপর করোনা মহামারী শুরু হয়ে গেছে, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও হয়তো ম্যারাডোনাকে আনতে পারতাম না আমরা৷ এখন তিনি ওঠে গেছেন সবকিছুর উর্ধ্বে, এখাকার মানুষের ভক্তি-ভালবাসার চূড়ান্ত রূপটা দেখা হলো না এই ফুটবল কিংবদন্তির৷’’

এদেশের মানুষের মনে একসময় ফুটবলের ‘কালো মানিক' হয়ে ঢুকে পড়েছিলেন পেলে৷ আশির দশকে ম্যারাডোনা-ম্যাজিক দেখার পর তাদের মনোজগতে শুরু হয় নতুন লড়াই৷ পেলে বনাম ম্যারাডোনা ! পুরোপুরি না হলেও অনেক ক্ষেত্রে ব্রাজিলিয়ানের একাধিপত্য হটিয়ে আর্জেন্টাইন তারকায় নতুন ফুটবল-আসক্তি তৈরি হয়৷ যেমন এখনকার বাংলাদেশ ফুটবল দলে তার প্রভাব ব্যাপক৷ ডিফেন্ডার তপু বর্মন বড় হয়েছেন মেসি-ম্যারাডোনার হাত ধরে, ''ম্যারাডোনার খেলা আমি দেখিনি, তাকে দেখি ইউ-টিউবে আর মেসিকে বাস্তবে৷ দুজনের খেলায় মাঝে মাঝে অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই, আবার কখনো একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন৷ তবে বিশ্বকাপ জয় আর মাঠে সদর্প উপস্থিতিতি দিয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকবে ম্যারাডোনা৷ সারা বিশ্বে যে তার অবিশ্বাস্য প্রভাব, সেটার তুলনা হয় না৷'' ম্যারাডোনার অমন প্রভাবের মধ্যেও দেশের আরেক ফুটবল তারকা আশরাফউদ্দিন চুন্নু এখনো ব্রাজিলপন্থী৷ সেটার পেছনে পেলে থাকলেও সাবেক তারকা মনে করেন, ''পেলে-ম্যারাডোনায় তুলনা হয় না, দু'জন দুই সময়ের নায়ক৷ ম্যারাডোনার পায়ে শুরু হয়েছে ফুটবলের আধুনিকতা৷ তার আলোড়ন তোলা '৮৬ বিশ্বকাপের পর কোনো আসর ওরকম একক কৃতিত্বে উজ্জ্বল হতে দেখিনি৷'' ঠিক তাই৷ ডিয়েগো ম্যারাডোনার মেক্সিকো বিশ্বকাপের পর গত ৩৪ বছরে বিশ্বকাপে কেউ অমন জাদুকরী দেখাতে পারেননি৷ বিশ্বকাপে একক নৈপুণ্যের পরম্পরার ধারায় শেষ ব্যক্তি হয়ত আর্জেন্টিনার জাদুকরই৷

বুয়েনস আইরেসে ম্যারাডোনাকে শেষ বিদায় জানাতে ভক্তদের ভিড়
বুয়েনস আইরেসে ম্যারাডোনাকে শেষ বিদায় জানাতে ভক্তদের ভিড়ছবি: Martin Villar/Reuters

তাই ডিয়েগো ম্যারাডোনার শেষ যাত্রায় শরিক পুরো ফুটবল বিশ্ব৷ সবাই কিংবদন্তিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানালেও পিটার শিলটন ৩৪ বছর পরও ক্ষমা করতে পারেননি আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বরকে৷ ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ^কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে সেই বিতর্কিত গোলের দুঃস্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ইংলিশ গোলরক্ষককে৷ ইংলিশদের সেই স্মৃতিতে যেন ধুলো জমার নয়৷ তাই বাংলাদেশ দলের ইংলিশ কোচ জেমি ডে-ও স্মৃতির সরণীতে ফিরে খুঁজে পেয়েছেন সেই হ্যান্ডবল,''ম্যারাডোনার স্মৃতি মানে ইংল্যান্ডের জালে সেই হাতে দেওয়া গোল !'' তার বয়স তখন মাত্র ৯ বছর, টিভি পর্দায় দেখেছিলেন ইংল্যান্ডকে শেষ করে দেওয়া ম্যারাডোনার গোল দুটি৷ রেফারির চোখ ফাঁকি দিয়ে সেই ‘হ্যান্ড অব গড' এর গোল, তার ঠিক চার মিনিট বাদে হয়েছে শতাব্দীর সেরা গোলের জন্ম৷ পায়ের জাদুকরীতে এই আর্জেন্টাইন তারকা একে একে পাঁচজনকে পেছনে ফেলে অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ইংল্যান্ডের জালে বল পাঠিয়ে নতুন ফুটবল রোমাঞ্চ উপহার দিয়েছিলেন৷ আগের গোলের জন্য কুখ্যাত হলে পরের গোলের জন্য তিনি ‘দেবদূত'৷ জেমির চোখে, ''তার সেই গোল এখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপের সেরা৷ আসলে মাঠের খেলায় ম্যারাডোনা অন্যতম সেরাদের একাজন আর মাঠের বাইরে তার জীবন এক বর্ণাঢ্য মোড়কে বাঁধা৷’’

মাঠের বাইরে তিনি এক অন্য চরিত্র৷ কখনো মনে হবে মানবদরদী এক সমাজ-সংস্কারক৷ বস্তির দুর্বিপাক ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে বেড়ে ওঠা মানুষটি বলেছেন সাম্যের কথা, ‘দুনিয়ার সর্বত্র যদি সাম্য অবস্থা বিরাজ করতো কী ভাল না হতো৷ যাদের বেশি আছে, তারা একটু কম থাকতো আর যাদের কম আছে তাদের যদি বেশি থাকতো৷' সমাজ-দর্শনের মৌলিক জায়গায় ঐক্যের কারণেই কিউবার প্রয়াত রাস্ট্র-নায়ক ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে ছিল ম্যারাডোনার পরম বন্ধুত্ব৷ তাই যা বিশ্বাস করতেন তা বলতে পারতেন অকপটে৷ বিশ্ব ফুটবলের বড়-কর্তাদের অনিয়মের বিরুদ্ধে সোজাসাপ্টা মন্তব্য করে বসতেন৷ সমাজের নানা সমীকরণে অন্য তারকারা যখন চুপ মেরে থাকেন তখন ম্যারাডোনা দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে সোচ্চার থাকতেন৷ এই সত্য ভাষণই তাকে আলাদা করেছে৷ তাই তো বাঙালী হৃদয়ের গহীনে বিশেষ আসন পেতে রেখেছিল তার জন্য৷ আমজনতা যে কথাগুলো গলা ফাটিয়ে বলতে চায় ম্যারাডোনা যেন তাদের প্রতিনিধি হয়েই বলে দিচ্ছেন৷

সাবেক তারকা গোলাম সারোয়ার টিপু তাই এদেশের মানুষের ওপর ম্যারাডোনার বহুমুখী প্রভাব দেখেন, ''ফুটবলার হিসাবে তার বিশালতা ছোঁয়া যাবে না৷ স্রষ্টা নিজের হাতে ফুটবলের সব ম্যাজিক দিয়ে তাকে পাঠিয়েছিলেন৷ সঙ্গে অকপট থাকার ক্ষমতা তাকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে সাধারণ মানুষের কাছে৷ তাই তার কান্না আমাদের ছুঁয়ে গেছে, তার আনন্দে আমরা উদ্বেলিত হয়েছি৷ শুধু পুরুষ কেন, সমাজের নারীমহলেও তার জনপ্রিয়তা কম নয়৷'' সেই আশির দশকে এক ভিনদেশি ফুটবলারের এই বঙ্গের নারীর অন্তঃপুর জয় বিশাল ঘটনা বটে৷ অনেকে বলেন, ১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির কাছে শিরোপা হারানোর কান্নার সৌজন্যে এটা হয়েছে৷ সাবেক ফুটবলার ও কোচ শফিকুল ইসলাম মানিকের ব্যাখ্যা হলো, ''আগে এদেশের ফুটবলে আন্তর্জাতিক ফুটবল মানেই ছিল বিশ্বকাপ৷ ১৯৮৬ সাল থেকে টিভিতে খেলা দেখা শুরু হয়েছে, সুবাদে '৯৪ বিশ্বকাপ পর্যন্ত ম্যারাডোনা ঘুরে-ফিরে ছিলেন আমাদের ঘরে-বাইরের আলোচনায়৷ এই আলোচনার সুবাদে তিনি একসময় ঘরের ছেলে হয়ে গেছেন, বাবা-ছেলের মুখে নামটি শুনতে শুনতে মা-বোনরাও তাকে নিজেদের কাছের মানুষ করে নিয়েছেন৷''

মায়ের জাত কখনো ছেলের মন্দ দেখে না৷ ছেলের বয়স বাড়লেও সে খোকাই থাকে, আর খোকার অপরাধ যে কখনো দুষ্টুমির উর্ধ্বে ওঠতে পারে না! ম্যারাডোনার মাদকাসক্তিও কখনো সেরকম অপরাধের চোখে দেখা হয়নি এখানে৷ বরং ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ডোপ টেস্টে তিনি আর্জেন্টিনা দল থেকে বাদ পড়ার পর এখানকার মানুষ খুঁজেছে পেছনের ষড়যন্ত্র৷ সেটা না পেয়ে তারা সস্নেহ প্রশ্রয়ে ঘরের ছেলের পক্ষ নেয়, ‘ওরকম এক-আধটু বদভ্যাস সবার থাকে৷' এ-এক অপূর্ব মায়জালের বাঁধন৷ অতিমানবীয় ফুটবলের পাশাপাশি, তার ‘দুষ্টুমি' ও ক্ষেপাটে চরিত্র দিয়েই ডিয়েগো ম্যারাডোনা এই বঙ্গের মানুষের অন্তঃপুর জিতে নিয়েছিলেন৷ তাই কিংবদন্তীর বিদায় তাদের জন্যও প্রিয়জন হারানোর শোক৷