1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঘরে ফিরেও মার খেতে হচ্ছে শ্রমিকদের

গৌতম হোড়
২৭ মার্চ ২০২০

অভুক্ত অবস্থায় মাইলের পর মাইল হেঁটে, পুলিশের মার খেয়ে কোনওক্রমে গ্রামে পৌঁছবার পরেও বিপদ কাটছে না ভিন রাজ্য থেকে ফেরা শ্রমিকদের। গ্রামবাসীদের রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের।

https://p.dw.com/p/3a7vW
ছবি: DW/A. Ansari

কেউ ৮০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন। কেউ হাঁটছেন ২০০ কিলোমিটার। এমনকী, পাঁচশো কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। তাঁরা সবাই শ্রমিক। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন। নিজের রাজ্য ছেড়ে, গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ভিন রাজ্যে থাকেন। কেউ সপরিবার, কেউ বা একা। করোনার ফলে লকডাউন হয়ে যাওয়া ভারতে তাঁদের দুর্গতির শেষ নেই। একে তো খাবার নেই, থাকার জায়গা নেই, হেঁটে অভুক্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। মাঝে মধ্যেই পুলিশের লাঠির বাড়ি খেতে হচ্ছে। বাড়ি ফিরেও নিস্তার নেই। গ্রামের লোক তাঁদের ঘরে যেতে দিচ্ছেন না। মারধর পর্যন্ত করছেন। হৃদয়হীন শহর তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি। নিজের গ্রামও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাঁদের ঠাঁই দিচ্ছে না।  অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।

করোনার ভয় বা আতঙ্কে লোক দিশেহারা। তাই প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে ঘরে ফেরা শ্রমিকদের সঙ্গে। ঝাড়খণ্ডে গ্রামে ফেরার পর এরকমই এক শ্রমিককে ধরে মারা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে একজন গ্রামবাসী ফেরার পর তাঁকে ঢুকতে না দিয়ে মেরেধরে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বর্ধমান জেলার কাটোয়ার অভিজ্ঞতা তো আরও খারাপ। তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''পশ্চিমবঙ্গের অনেক কাগজেই খবর বেরিয়েছে, কাটোয়া পুরসভা উদ্যোগ নিয়ে বিহার থেকে আসা শ্রমিকদের তাদের রাজ্যে ফেরাতে যায়। তাঁদের বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বিহার পুলিশ ও প্রশাসন তাঁদের ঢুকতেই দেয়নি। তাঁরা আবার কাটোয়ায় ফিরে এসেছেন। পুরসভা এখন তাঁদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। বিভিন্ন রাজ্যে হাজার হাজার শ্রমিক আটকে পড়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশে আটকে থাকা ভারতীয়দের চার্টার্ড বিমানে করে নিয়ে আসতে পারেন, অথচ, এই শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করতে পারেন না। আর দুই দিন ট্রেন চালালে কী ক্ষতি হত? অভিজ্ঞতা বলছে, বড়লোকরাই বিদেশ থেকে এই সংক্রমণ নিয়ে ফিরছেন। গরিবরাপরে তাঁদের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হচ্ছেন।''

ঠিকই, লকডাউনের সময় সম্ভবত ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের কথা মাথায় রাখা হয়নি বা রাখা যায়নি। সংক্রমণ যাতে না ছড়ায়, তাই তড়িঘড়ি কেন্দ্রকে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। ফলে এই শ্রমিকরা অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে পড়েছেন। কোনওক্রমে পায়ে হেঁটে যদি বা গ্রামে পৌঁছচ্ছেন, বাড়ি ঢুকতে পারছেন না। বাঁকুড়ায় একটি গ্রামের বাইরে 'প্রবেশ নিষেধ' নোটিশ সেঁটে দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। তাঁরা গ্রামে আর কাউকে ঢুকতে দেবেন না। ভয়, যদি বাইরে থেকে আসা লোকেরা করোনার জীবাণু নিয়ে আসেন। আর যারা ভিন রাজ্যে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তারাও করোনার বিপদ নিয়ে বাঁচছেন। খাবার পেতে গেলে তাঁদের পক্ষে সোস্যাল ডিসট্যান্সিং মানা সম্ভব হচ্ছে না।

এই পরিস্থিতি দেখে অনেক জায়গায় জনপ্রতিনিধিরা সক্রিয় হয়ে ভিন রাজ্য থেকে আসা শ্রমিকদের ঘরে ফেরাচ্ছেন। তাঁরা যেন বাইরে যত্রতত্র না ঘুরে বেড়ান, তা দেখছেন। তৃণমূলের সাংসদ মানস ভুঁইঞা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ে ভিন রাজ্য থেকে  ১ হাজার  ৯৩ জন এবং  পিংলায় ৬৬২ জন ফিরেছেন। এখনও মুম্বই, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, কেরালা, গোয়া, হরিদ্বারে মোট ৩৫০ জন সবংয়ের শ্রমিক আটকে পড়েছেন। চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়ে আমি গ্রামবাসীদের বুঝিয়েছি। যাঁরা ফিরেছেন, তাঁদেরও ঘরবন্দি হয়ে থাকতে বলেছি।'' এখানে না হয় মানসবাবু নিজে পেশায় চিকিৎসক ও দীর্ঘদিনের জনপ্রতিনিধি এবং তিনি সক্রিয় বলে অসুবিধা হচ্ছে না, কিন্তু অন্যত্র?

ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাড়ি ফিরছেন এই শ্রমিকের দল। তেলেঙ্গানা থেকে রাজস্থান যাচ্ছিল দুটি বড় কনটেইনার ট্রাক। মহারাষ্ট্রের পুলিশ তাদের রুটিন পরীক্ষার জন্য থামায়। দেখা যায়, কনটেইনারে কোনও অত্যাবশ্যকীয় জিনিস নেই, গাদাগাদি করে আছেন ৩০০ শ্রমিক, এ ভাবেই তাঁরা রাজস্থানে নিজেদের বাড়ি ফিরছিলেন। ট্রাকের চালকদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কিন্তু শ্রমিকদের নিয়ে কী করা হবে, তা এখনও স্থির করা যায়নি।

কতটা মরিয়া হলে তাঁরা এইভাবে ঘরে ফেরার চেষ্টা করেন তা সহজবোধ্য। নিজেদের পুঁজির টাকা সব ট্রাকচালককে দিয়ে ঝুঁকি নিয়েও ফিরছেন তাঁরা।  যাঁরা মনে করছেন হাঁটতে পারবেন, তাঁরা হেঁটেই ফিরছেন। তাঁদেরও হেনস্থার শেষ নেই। গোয়ালিয়র থেকে উত্তরপ্রদেশের গ্রামে ফিরছিলেন কয়েকজন শ্রমিক। বদায়ুঁতে পুলিশের কনস্টেবল তাঁদের প্রথমে হামাগুড়ি দিতে বলে। তারপর ব্যাঙের মতো লাফাতে বলে। সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে সেই ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় কনস্টেবলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

আবার ব্যতিক্রমও যে নেই তা নয়। গাজিয়াবাদ থেকে উত্তরপ্রদেশেই গ্রামে ফিরছিলেন রাজেশ কুমার সহ কয়েকজন। কিন্তু রাস্তায় লোকে সাহায্য করেনি এই ভেবে যে, গাজিয়াবাদ থেকে তাঁরা নিশ্চয়ই করোনা ভাইরাস নিয়ে ফিরছেন। লখিমপুর খিরি পৌঁছলে পুলিশ তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। তারপর খেতে দেয়। আবার মেদিনীপুরের একটি গ্রামে ভিন রাজ্য থেকে শ্রমিকরা বাড়ি ফেরার পর রীতিমতো মাইক বাজিয়ে নাচাগানা করে পার্টিও করেছেন গ্রামবাসীরা। করোনার সময়ে এটাও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ।