1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জাতীয় সংগীতের অবমাননা: বাস্তব ও গুজব

৯ আগস্ট ২০১৯

জাতীয় সংগীতের অসম্মান নিয়ে বর্তমানে দুই বাংলার সঙ্গীত জগত সরগরম৷ এই বিতর্কে কতটুকু তথ্য আর কতটুকু নিপাট গুজব?

https://p.dw.com/p/3NcpB
ছবি: DW/M. Mamun

জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা নিয়ে বর্তমানে দুই বাংলার সঙ্গীত জগত সরগরম৷ শুধু সঙ্গীত জগৎ বললে ভুল বলা হবে, কারণ সাম্প্রতিক একটি বিতর্কের আঁচ এখন জায়গা করে নিয়েছে বাঙালির দৈনন্দিন আলোচনায়৷ পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-তর্কে সোশাল মিডিয়া রীতিমত জর্জরিত৷

কিন্তু কোথা থেকে ঘটনার সূত্রপাত?

ভারতের জনপ্রিয় রিয়ালিটি শো জি বাংলা চ্যানেলের ‘সা রে গা মা পা'৷ সেখানে প্রতি বছরই অংশগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গ  বাংলাদেশসহ অন্য অঞ্চল থেকে আসা বাংলাভাষী উঠতি গায়ক-গায়িকা৷ এই অনুষ্ঠানের হাত ধরেই বাঙালি সঙ্গীতপ্রেমীদের নজরে আসেন বাংলাদেশের তরুণ কন্ঠশিল্পী মইনুল আহসান নোবেল৷ দুই বাংলাতেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি৷ প্রতিযোগিতা শেষে নোবেল পান তৃতীয় স্থান এবং তার কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে করে বসেন বেফাঁস মন্তব্য৷ 

একটি সাক্ষাৎকার চলাকালীন নোবেল প্রিন্স মাহমুদের ‘আমি মিশ্রিত লগ্ন মাধুরীর জলে ভেজা' গানটি করেন৷ সেই গান বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘প্রিন্স মাহমুদ স্যারের গানটা নিয়ে আমি একটা কথা বলবো। তা নিয়ে হয়তো অনেকে অনেক কিছু বলতে পারে। হয়তো খারাপ মনে করতে পারে। তবে এটা আমার ব্যক্তিগত মত একদমই। আমি মনে করি যে, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা' আমাদের দেশটাকে যতটা বুঝিয়ে উঠতে পারে, তার থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশি সফলভাবে সেটা করে প্রিন্স মাহমুদ স্যারের এই গানটা। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত যেটা আছে সেটা হয়তো রূপক অর্থে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু এটা একদম সোজাসুজিভাবে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আবেগের জায়গাটি তুলে ধরে৷''

এই সাক্ষাৎকারের ভিডিওটি ভাইরাল আকার ধারন করলে শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীতের সম্মানহানি বিষয়ে বিতর্ক

কী বলছে দুই দেশের বাঙালি?

নোবেলের বক্তব্যকে দুই বাংলার অনেকেই মনে করেন ‘আমার সোনার বাংলা'র রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সরাসরি অপমান হিসাবে৷ ভারতের জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী কন্ঠশিল্পী ইমন চক্রবর্তী এবিষয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ফেসবুকে লেখেন, ‘‘বলতে খারাপ লাগছে, এনাকে সামনে পেলে চাবকাতাম৷''

ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ ২৪-এ প্রকাশিত হয় মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফের একটি মতামত৷ সেখানে প্রত্যক্ষভাবে নোবেলের মন্তব্যের কথা তিনি না তুললেও বিস্তারিত বর্ণনা করে তুলে ধরেন কেন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ‘আমার সোনার বাংলা' গানটি অতুলনীয়৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রেম ভালবাসার অসাধারণ সাবলাইম-টি এই গানটিকে পৃথিবীর অন্য সব দেশের জাতীয় সঙ্গীত থেকে আলাদা করেছে। এটি তুলনাহীন একটি জাতীয় সঙ্গীত। এই গানটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সত্যিকার স্পিরিট ধারণ করে।''

এখানে লক্ষণীয়, দুই দেশে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ার মূলে দু'টি ভিন্ন আবেগ৷ একদিকে রয়েছে নোবেলের বক্তব্যে নিপাট রবীন্দ্রনাথ-বিরোধিতা খুঁজে পাওয়া৷ অন্যদিকে রয়েছে একটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি অশ্রদ্ধার উদাহরণ৷ এই চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে দুই জায়গার সংবাদমাধ্যমে বিষয়টির উপস্থাপনের ধারাও৷

পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্র ‘এই সময়' এই বিতর্ক ঘিরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘রবীন্দ্রনাথকে চূড়ান্ত অপমান, নোবেলের ঔদ্ধত্যে চাবকাতে চান ইমন!' আনন্দবাজার পত্রিকায় সহজ শিরোনাম ‘বিতর্কে নোবেল', অন্যদিকে নিউজ১৮ এর শিরোনাম, ‘বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে অপমান'৷

বাংলাদেশের সংবাদপত্র যুগান্তর খবরটি প্রকাশ করে ‘জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে মন্তব্য করে নতুন বিতর্কে নোবেল' শিরোনামে৷ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেও দেখা যায় এই ধারা৷ 

কিন্তু দুই দেশের সাধারণ জনতার সোশাল মিডিয়ার আচরণ খেয়াল করলে দেখা যাবে একই ধারা৷ রবীন্দ্রনাথ না জাতীয় সঙ্গীত- কার অপমান কাকে বেশি আহত করেছে, তর্কে মেতেছেন তারা৷

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ফেসবুক মন্তব্যের বক্তব্যও বিভক্ত৷ কেউ কেউ নোবেলের বক্তব্যের প্রতি সহমত পোষণ করে দাবি জানান জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করার৷ অন্যদিকে, ‘আমার সোনার বাংলা' গানটিকে বাংলাদেশের জাতিসত্ত্বার অবিভেদ্য অঙ্গ মনে করেন বেশ কিছু তরুণ৷

আইন কী বলছে?

নোবেল ও জাতীয় সঙ্গীত বিষয়ে তাঁর মন্তব্য ঘিরে পক্ষ-বিপক্ষ সব রকম মতামতই উঠে আসছে৷ কিন্তু কোথাও আলোচিত হচ্ছে না জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা আসলে কী, এবং কোনো ব্যক্তি এই দায়ে অভিযুক্ত হলে ঠিক কী করণীয় রাষ্ট্র বা একজন সাধারণ নাগরিকের৷ কেউ আলোচনা করছেন না, আসলেই কোনো নাগরিকের বা রাষ্ট্রের অধিকার আছে কি না অপমানকারীকে ‘চাবকানোর', বা জাতীয় সঙ্গীতকে অসম্মান করার দায়ে অভিযুক্ত করার৷

বাংলাদেশের সংবিধানের ‘জাতীয় সঙ্গীত নিয়মাবলী, ১৯৭৮' অনুচ্ছেদে এবিষয়ে বিস্তারিত বলা রয়েছে৷ জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননাকে সংবিধানে দেখা হয় শুধু তা গাওয়ার সময়ে মানুষের ব্যবহারের বিচারে৷ যখন তা গাওয়া হচ্ছে না, তখন পরোক্ষভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননার দায়ে কাউকে অভিযুক্ত করতে পারেন কি না, তা নিয়ে কিছু বলা নেই৷ জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনেরও কোনো বিধান সেখানে নেই৷ ভারতের সংবিধানেও রয়েছে একই নিয়মাবলী৷

তাই এটা পরিষ্কার যে, ভারতের জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ বা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা'র অবমাননার ব্যাপ্তিকে আইনের নিক্তিতে মাপা যাবেনা৷ ফলে, গোটা বিষয়টাই বর্তমানে সোশাল মিডিয়ায় মতামতের লড়াইতেই রয়েছে সীমাবদ্ধ, যাকে গণমাধ্যমের ভাষায় অনেকে বলেন ‘মিডিয়া ট্রায়াল' বা গণমাধ্যমে বিচার হিসাবে৷

নানা রকমের গুজব, ‘মিম' ইত্যাদিতে সোশাল মিডিয়া থেকে সংবাদমাধ্যম ছেয়ে গেলেও পুরো আলোচনা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে দুই বাংলাতেই জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় কবিকে অপমান করার আইনি বিধানের অভাবের প্রাসঙ্গিকতা৷

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলতে চান? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷