জার্মানিতে আরও বিদেশি বংশোদ্ভুত সরকারি কর্মচারী প্রয়োজন
৩১ মার্চ ২০১০সরকারি দপ্তরে যাওয়ার কথা শুনলে কার না গায়ে জ্বর আসে৷ দীর্ঘ অপেক্ষা, এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে চক্কর খাওয়ার ঝক্কি – এমন কত আশঙ্কাই মনে জাগে, তাই না? জার্মানিতে সরকারি দপ্তরের কাজকর্ম মোটামুটি নির্বিঘ্নে সারা গেলেও এদেশের মানুষও কিন্তু সহজে সরকারি দপ্তরে পা মাড়ান না৷ তার উপর বিদেশি হলে তো কথাই নেই৷ তাদের সুবিধার জন্য এবার সরকারি দপ্তরে বিদেশি বংশোদ্ভূত কর্মীর সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে৷
প্রেক্ষাপট
জার্মানিতে বিদেশির সংখ্যা কম নয়৷ প্রতি ৫ জনের মধ্যে একজন বিদেশি বা বিদেশি বংশোদ্ভূত – সংখ্যার বিচারে যা প্রায় দেড় কোটি৷ তাদের মধ্যে আবার ৪০ লক্ষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী৷ কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বিদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা যায়৷ এই পরিস্থিতি বদলানোর জন্য নানা মহল থেকে চাপ আসছে৷ বিদেশিদের সমাজে মূল স্রোতে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে যে জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, তাতেই এই লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল৷ বলা হয়েছিল, ভিন দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে এই সব কর্মীদের বিশেষ জ্ঞান থাকায় সরকারি কাজকর্মে সুবিধা হবে৷ বিদেশিদের অনেক সংগঠনও বহুকাল ধরেই এমন দাবি জানিয়ে আসছিল৷ এদেরই একজন বন শহরের এক বিদেশি সংগঠনের প্রতিনিধি, হালুক ইলদিজ৷ তিনি বললেন, ‘‘এটা আসলে ন্যায়বিচারের প্রশ্ন৷ সরকারি দপ্তরেও সমাজের বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন ঘটানো উচিত৷ যেখানে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ বিদেশি বংশোদ্ভূত, সেখানে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যেও আনুপাতিক হারে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকা প্রয়োজন৷ এই মুহূর্তে কিন্তু তেমনটা দেখা যাচ্ছে না৷''
গেলজেনকিয়ের্শেন শহরে তুর্কি-জার্মান মৈত্রী সমিতির সভাপতি মুস্তাফা চেতিনকায়া মনে করেন, নানা উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জার্মান সমাজে বিদেশিদের সম্পৃক্ত করার কাজ সম্পূর্ণ করতে আরও দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে৷ তিনি বললেন, ‘‘বিদেশিদের সমাজে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে অবশ্যই অনেক সাফল্যের দৃষ্টান্ত রয়েছে৷ যেখানেই সমাজের সব অংশের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ রয়েছে, সেখানেই বাধা দূর হয়েছে৷ কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আরও অনেক কাজ বাকি রয়েছে৷
বিদেশি কর্ম থাকার সুবিধা
সরকারি কর্মীদের মধ্যে আনুপাতিক হারে বিদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা বাড়ালে বিদেশিদের সম্পৃক্ত করার প্রক্রিয়াও সামগ্রিকভাবে তরান্বিত হবে বলে মনে করেন হালুক ইলদিজ৷ বিদেশিরা সরকারি দপ্তরের কাউন্টারে গিয়ে যদি নিজেদের মতই আরও মানুষ দেখতে পান, তখন তাঁরা নিজেদের সমাজের অংশ হিসেবে মনে করবেন৷ এই চেতনা আরও বাড়বে৷
এই সুবিধাগুলি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ছে এবং ইতিমধ্যে একেবারে তৃণমূল স্তরের সরকারি দপ্তরগুলিতে বিদেশি বংশোদ্ভূত কর্মীদের সংখ্যা বাড়ানোর প্রচেষ্টাও জোরদার করা হয়েছে৷ বন'এর মত শহরে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষই অভিবাসি৷ শহরের যে দপ্তর কর্মী নিয়োগ করে, তার প্রধান কার্লহাইনৎস টোমাস জানালেন, বন শহরে প্রায় ২০ শতাংশ সরকারি কর্মী বিদেশি বংশোদ্ভূত৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের নাগরিক পরিষেবার স্বার্থে বিদেশি বংশোদ্ভূত কর্মী থাকা জরুরি৷ তাঁরা নানা ভাষা জানেন, বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে জানেন৷ তাঁরা নিজেরা যখন জার্মানিতে এসেছিলেন, তখন তাঁদের যেসব সমস্যা হয়েছিল, সেসব তাঁরা ভোলেন নি৷ ফলে আজ তাঁরা অনেক সহজেই বিদেশিদের সমস্যা বুঝতে পারেন৷ এই বিশেষ দক্ষতাকে আমরা আরও বেশী করে কাজে লাগাতে চাই৷
লক্ষ্য পূরণের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক
মোটকথা, সরকারি দপ্তরে বিদেশি বংশোদ্ভূত কর্মীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রশ্নে ইতিমধ্যে ঐক্যমত তৈরি হয়ে গেলেও কীভাবে এই লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব, সেবিষয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে৷ কোটা বা সংরক্ষণ ব্যবস্থার দাবি শোনা যাচ্ছে, যার অন্যতম প্রবক্তা জার্মানিতে তুর্কি সমাজের সভাপতি কেনান কোলাত৷ তিনি মনে করেন, ‘‘আমার মনে হয়, এবিষয়ে আলোচনার সময় এসে গেছে৷ বিষয়টিকে আর আলোচনার উর্দ্ধে রাখলে চলবে না৷ যখন নারীদের জন্য সংরক্ষণের প্রশ্ন উঠেছিল, তখনও ঠিক এমনটাই ঘটেছিল৷ তখন সংরক্ষণ-বিরোধীরা একই যুক্তি দেখিয়েছিল৷ সরকারি দপ্তরে অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়াতে যদি অন্য কোন পদ্ধতি সফল হয়, তখন অবশ্য সংরক্ষণের প্রয়োজন হবে না৷ কিন্তু প্রশ্ন হল, এবিষয়ে যথেষ্ট সদিচ্ছা আছে কি?''
হালুক ইলদিজের কাছে মূল বিষয় হল সমাজে বিদেশিদের সম্পৃক্ত করার সার্বিক প্রয়াস৷ তবে এই লক্ষ্যে সংরক্ষণ কতটা ফলপ্রসূ হবে, সেবিষয়ে তাঁর মনে সন্দেহ রয়েছে৷ তাঁর মতে, ‘‘খুব একটা লাভ হবে না৷ সংরক্ষণ চালু করলে মানের অবনতি ঘটে৷ তবে আদৌ সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনার যে প্রয়োজন এসে পড়ছে, তার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যে সমাজে বিদেশিদের সম্পৃক্ত করার প্রক্রিয়া সফল হয় নি৷ কোটা ব্যবস্থা দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়৷''
বন শহর কর্তৃপক্ষ এই দু'টি মতবাদের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করছে৷ একদিকে অভিবাসিদের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে পরিষেবার মানের যাতে অবনতি না হয়, সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে৷ বিশেষ করে সরকারি কর্মী হওয়ার জন্য তরুণ প্রজন্মকে আকর্ষণ করার চেষ্টা চলছে৷ হাতেনাতে এর ফলও পাওয়া যাচ্ছে৷ এই মুহূর্তে প্রায় ৭০টি দেশ থেকে আসা বিদেশিরা শহরের নানা দপ্তরে কর্মরত৷ প্রশ্ন হলো, এই সাফল্য কি একদিন দেশের বাকি অংশেও ছড়িয়ে পড়বে?
প্রতিবেদক : সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা : দেবারতি গুহ