1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পুনরেকত্রীকরণ দিবস

২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

দুই জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের ২৯ বছর পরেও বিভাজনের বিষয়টি দূর হয়ে যায়নি৷ এর জন্য এএফডি দলও দায়ী৷ সেসব বিষয় আসলে কী? রাজনীতি জগতের প্রতিক্রিয়াই বা কী হওয়া উচিত?

https://p.dw.com/p/35uCO
দুই জার্মানির পুনরেকত্রীকরমের মুহূর্ত
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Kumm

নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মানির পূর্বাঞ্চলে একটা ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল৷ তখনো পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নতির এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলছিল৷ মনে হচ্ছিল, জার্মানির দুই অংশের মধ্যে বিভাজন যেন দ্রুত দূর হচ্ছে৷ তবে বাস্তব ঘটনা হলো, মানুষের ‘মাথার মধ্যে প্রাচীর' অত সহজে দূর হবার নয়৷ জার্মানির পূর্ব ও পশ্চিমের অনেক মানুষ এখনো দেশের অন্য প্রান্তে পা রাখেননি৷ পুনরেকত্রীকরণ প্রক্রিয়ার সময় ঠাট্টা করে পশ্চিমের মানুষদের ‘ভেসি' ও পূর্বের মানুষদের ‘অসি' বলা হতো৷ আজও সেই সংজ্ঞা লোকমুখে থেকে গেছে৷ এমনকি টুইটারেও জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগ হিসেবে এই শব্দগুলি ব্যবহার করা হচ্ছে৷

অতীতের দিকে ফিরে তাকালে মানতে হবে যে; ২০১৫ ও ২০১৬ সালের শরণার্থী সংকট জার্মানির দুই অংশের মধ্যে ভঙ্গুর মিলের জায়গায় আঘাত করেছে৷ রাজনৈতিক ও সামাজিক বিতর্কের ক্ষেত্রে জার্মানির পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মধ্যে আবছা পার্থক্য আবার প্রকট করে তুলেছে৷ লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আগমনের ফলে পূর্বাঞ্চলের মানুষের মনে আবার স্থিতিশীলতা হারানোর ভয় এবং পুরানো ক্ষত জেগে উঠেছিল৷

এই মুহূর্তে ঠিক সেই ভীতিরই ফায়দা তুলছে চরম দক্ষিণপন্থি পপুলিস্ট শিবির৷ এএফডি, অর্থাৎ ‘জার্মানির জন্য বিকল্প' রাজনৈতিক দল এবং পেগিডা'র মতো আন্দোলন জার্মানির দুই অংশের মধ্যে পার্থক্য আবার তুলে ধরছে৷ সাম্প্রতিক জনমত সমীক্ষা অনুযায়ী, এএফডি জার্মানির পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছে৷ এমনকি ‘পুনরেকত্রীকরণের চ্যান্সেলর' হিসেবে পরিচিত হেলমুট কোল ও জার্মানির পূর্বাঞ্চলের চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী সিডিইউ দল ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও সেখানে পিছিয়ে পড়েছে৷ 

হেলমুট কোল ও আঙ্গেলা ম্যার্কেল
হেলমুট কোল ও আঙ্গেলা ম্যার্কেলছবি: picture-alliance/dpa/A. Altwein

ব়্যাডিকাল পরিবর্তন: আঙ্গেলা ম্যার্কেল

এমন এক প্রেক্ষাপটে এ বছর ৩রা অক্টোবর ‘জার্মান ঐক্য দিবসে' যে পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল সম্পর্কে অন্য ধরনের বিতর্ক দেখা যাচ্ছে, তাতে বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই৷ অতীত বছরগুলিতে দুই অংশের বেতন, বিষয়-সম্পত্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা সংক্রান্ত পরিসংখ্যান নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা হতো৷ নাগরিকদের অবস্থা ছিল অপেক্ষাকৃত নগণ্য বিষয়৷ আজও পূবের মানুষ পশ্চিমের জীবনযাত্রার মানের সবে ৭৩ শতাংশ ছুঁতে পেরেছে৷ পূবের হাতে গোনা কয়েকটি অঞ্চলের সাফল্য গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের সার্বিক মানের হ্রাস ও শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের অভাব পূরণ করতে পারেনি৷

বর্তমানে সেই আলোচনায় আরো আবেগ যোগ হয়েছে৷ বিভিন্ন দলের রাজনীতিক, এমনকি খোদ চ্যান্সেলর ম্যার্কেলও তাতে সুর মিলিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, দুই জার্মানির পুনরেকত্রীকরণ ‘ব়্যাডিকাল পরিবর্তন' ঘটিয়েছে৷ ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে যা ঘটেছে, তার অনেক অংশ আবার মানুষের সামনে ফিরে আসছে৷ ম্যার্কেল বলেন, ‘‘সে ছিল এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা৷ অনেকে সে সময়ে চাকরি হারিয়েছিলেন, একেবারে নতুন করে তাঁদের জীবন শুরু করতে হয়েছিল৷ স্বাস্থ্য পরিষেবা, অবসর ভাতার কাঠামোসহ সবকিছু বদলে গিয়েছিল৷'' তবে এমন পরিবর্তন সত্ত্বেও ঘৃণা ও হিংসার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না বলে ম্যার্কেল মনে করেন৷ তবে তাঁর মতে, পূবের মানুষের জীবনের প্রবাহ বুঝতে এই প্রেক্ষাপট সাহায্য করতে পারে৷

জার্মান সরকারের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্রিস্টিয়ান হিয়র্টেও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন৷ জার্মান ঐক্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর বাৎসরিক রিপোর্ট অনুযায়ী পূবের অনেক মানুষ এখনো নিজেদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক' মনে করেন৷ তাঁদের মতে, পূবের মানুষের কথায় যথেষ্ট কান দেওয়া হয় না৷ এএফডি দলের প্রতি পূবের মানুষের সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, এত মানুষ রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রতি আস্থা হারালে বিষয়টি সম্পর্কে উদাসীন থাকলে চলবে না৷

কী ভুল হয়েছে?

অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা আরো গভীরভাবে এই বিভাজনের কারণ অনুসন্ধান করছেন৷ বিশেষ করে পুনরেকত্রীকরণের ঠিক পরে ‘ত্রয়হান্ড' নামের যে কর্তৃপক্ষ পূর্ব জার্মানির সরকারি মালিকানার কল-কারখানা বেসরকারি হাতে তুলে দেবার দায়িত্ব পেয়েছিল, তার ভূমিকা নিয়ে জোরালো তর্ক-বিতর্ক চলছে৷ প্রায় ৮,০০০ প্রতিষ্ঠান ও সেখানে কর্মরত প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎ স্থির করার দায়িত্ব ছিল এই কর্তৃপক্ষের হাতে৷ হয় প্রতিষ্ঠানগুলির বেসরকারীকরণ, অথবা তা সম্ভব না হলে সেগুলি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল কর্মকর্তাদের৷ এর পরিণাম দাঁড়ালো ব্যাপক হারে বেকারত্ব৷ ঐতিহাসিক মারকুস ব্যোইক বলেন, ‘‘জার্মানির পূর্বাংশের অনেক মানুষ মনে করেন যে, সেই অঞ্চলকে ছারখার করে দিতেই ত্রয়হান্ড সৃষ্টি করা হয়েছিল৷'' অনেক মানুষের সারা জীবনের পেশাগত অর্জন আচমকা মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল৷ ব্যোইক আরো মনে করেন, তার উপর এ নিয়ে কখনো খোলামেলা আলোচনা না হওয়ায় বিষয়টি আরো জটিল হয়ে উঠেছে৷ পশ্চিমে এই অবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট সহানুভূতি দেখা যায়নি৷

বার্লিনে ত্রয়হান্ড সংস্থার দফতর
বার্লিনে ত্রয়হান্ড সংস্থার দফতরছবি: picture-alliance/dpa/K. Franke

অন্য আরেকটি বিষয় নিয়েও ক্ষোভ দূর হয়নি৷ পুনরেকত্রীকরণের পর জার্মানির পশ্চিমাঞ্চল থেকে হাজার হাজার সরকারি কর্মীকে পূবে পাঠানো হয়েছিল৷ ২৯ বছর পরেও অনেক মানুষ সেই সিদ্ধান্ত হজম করতে পারেননি৷ উচ্চ পদে পশ্চিমের মানুষের আধিপত্যকে ‘সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ হিসেবে গণ্য করেন পূবের মানুষ৷ এমন অবস্থা অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ৷ এমনকি পশ্চিমের মানুষ শুধু ‘স্বজনদের' চাকরি দেন বলে অভিযোগ রয়েছে৷

জার্মান সরকারের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্রিস্টিয়ান হিয়র্টে
জার্মান সরকারের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্রিস্টিয়ান হিয়র্টেছবি: picture-alliance/dpa/M. Skolimowska

পূর্ব জার্মানি সম্পর্কে নতুন নীতি?

এত বিশ্লেষণ সত্ত্বেও জার্মানির পূর্বাঞ্চল সংক্রান্ত বিশেষ সরকারি নীতির ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না৷ কয়েকজন সংসদ সদস্য ত্রয়হান্ডের কার্যকলাপ তদন্ত করার দাবি তুলেছেন, অন্য কয়েকজন এক ‘রিকনসিলিয়েশন কমিশন' গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছেন৷ ৩রা অক্টোবর উদযাপনের পর সেই সব প্রস্তাব কতটা কার্যকর করা হবে, তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে৷ তার চেয়ে বরং বর্তমানে বহুল চর্চিত জার্মান শব্দ ‘হাইমাট', অর্থাৎ স্বভূমির পরিচয় বিকল্প হয়ে উঠতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷ ফেডারেল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম বদলেও ‘স্বভূমি মন্ত্রণালয়' করা হয়েছে৷ ফলে আঞ্চলিক নীতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটবে বলে দাবি করা হচ্ছে৷ এর আওতায় শহরকেন্দ্রিক বিশাল জনপদগুলি থেকে মনোযোগ সরিয়ে গ্রামাঞ্চলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে, যেখানে এখনো জার্মানির বেশিরভাগ মানুষ বসবাস করেন৷ কয়েকদিন আগে এই বিভাজন ঘোঁচানোর লক্ষ্যে এক কমিশন কাজ শুরু করেছে৷ অবকাঠামোর উন্নয়ন ও ঋণভার কমানোর বিষয় থেকে শুরু করে জমির ব্যবহার সংক্রান্ত নীতির আমূল পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে৷ মোটকথা, কোনো অঞ্চলের উন্নয়নের দায় শুধু সেই অঞ্চলের হাতে না রেখে রাষ্ট্রও নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তা চালনা করবে৷ ‘সমাজে পারস্পরিক ঐক্য' মজবুত করাই এই উদ্যোগের লক্ষ্য৷ কৃষিমন্ত্রী ইয়ুলিয়া ক্ল্যোকনার বলেছেন, কোনো মানুষই যাতে নিজেকে অবহেলিত মনে না করেন, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে৷

অর্থাৎ জার্মানির পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মধ্যে দ্বন্দ্বের বদলে সবার জন্য স্বভূমি? এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সাম্যকে আর তেমন গুরুত্ব দেওয়া হবে না বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে৷ বেতন অথবা বড় বড় বাণিজ্যিক সংস্থার সদর দপ্তরের ক্ষেত্রে পূব ও পশ্চিমের মধ্যে বৈষম্য দ্রুত অথবা আদৌ দূর করা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন জার্মান সরকারের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্রিস্টিয়ান হিয়র্টে৷

কাই-আলেক্সান্ডার শলৎস/এসবি