1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

টিকটক আর ইন্সটার যুগে কালচারের উঁচু নিচু

৭ আগস্ট ২০২০

সংস্কৃতি প্রবাহমান৷ অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন স্তরে সংস্কৃতিতে আলাদা করা যায় না৷ মার্কিন-ব্রিটিশ কবি টি এস এলিয়টের মতে, সমাজের জন্য ‘হাই কালচার' এবং ‘পপুলার কালচার' দুটোরই প্রয়োজন আছে৷

https://p.dw.com/p/3gbSR
Symbolfoto Social-Media auf einem Smartphone
ছবি: picture-alliance/Ostalb Network

আমাদের দেশে এখন পপুলার কালচার কি বলুনতো? ঠিক ধরেছেন৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সহজে জনপ্রিয়তা পাওয়া৷

অফু৷ না সত্যজিত রায়ের পথের পাঁচালীর অপুর নাম ভুল উচ্চারণে বলছি না৷ বলছি হালের টিকটকে জনপ্রিয় অফু ভাইয়ের কথা৷ অফুর মত বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি তরুণ টিকটক নামের একটি সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের মজার ভিডিও শেয়ার করে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন৷ লাখ লাখ দর্শক, ফলোয়ার আর ভক্ত তাদের৷

নানা রঙের বাহারি চুল, অদ্ভুত হাসি আর নানান ভঙ্গিমার ভিডিও যেমন তাদের জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে, তেমনি তাদের সমালোচনা বা বাকা মন্তব্য করার লোকেরও অভাব নেই৷ অনেকেই এই সংস্কৃতিকে তীর্যক ভাবে দেখছেন, বলছেন এটি লো কালচার বা নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতি৷ সোজা ভাষায় ছোটলোকের সংস্কৃতি৷

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ঢাকা শহরে প্রথম আসি ২০০০ সালে৷ সে সময় মৌসুমি ভৌমিকের প্রথম অ্যালবাম বের হয়৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে তখন বাজতো ‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি'...৷ এখন বলুনতো এই গান কি চায়ের দোকান বা গ্রামে গঞ্জে শোনা যেতো? অবশ্যই না৷ ফলে ধরে নিন এটি হাই কালচারের গান৷

ঢাকায় আসার আগ পর্যন্ত রবীন্দ্র, নজরুল, গণ সংগীত, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং পুরানো বাংলা-হিন্দি গান ছিলো আমার শোনার তালিকায়৷ বাসায় ব্যান্ড সংগীত বা ইংরেজি গান শোনার সুযোগ হয়নি তার আগে৷ অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন নির্দিষ্ট একটা ঘেরাটোপে বাধা ছিলো আমার সংগীত জগত৷ সেটা ভাঙলো ঢাকায় এসে৷ আমাদের ছাত্রাবস্থায় ‘বাংলা ব্যান্ড' ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় তাদের প্রথম অ্যালবাম বের করে৷ ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়' নামের সেই অ্যালবামে মূলতঃ ছিলো লালন, বাউল গান আর কয়েকটা নতুন গান ব্যান্ডের নিজস্ব৷ কিন্তু আনুশেহ জনপ্রিয়তা পান ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি' গানটির মধ্য দিয়ে৷ এর মাধ্যমে লালন পৌঁছে যান উচ্চবিত্ত তরুণ প্রজন্মের অন্তরে

এমনকি একই সময়ে ‘লালন' নামে একটি ব্যান্ডও গড়ে ওঠে৷ তারপর ধরুন মমতাজ বেগমের কথা৷ বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্যাসেট বিক্রি হয়েছে তাঁর গানের৷ কিন্তু তারেক মাসুদের মাটির ময়না চলচ্চিত্রে ‘যদি বেহেস্ত পাইতে চাও গো অন্তরে রাইখো আল্লাহর ডর' গাওয়ার আগে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত সমাজ তাঁর কণ্ঠের কদর বুঝতো! এখন ফোক ফেস্টিভেলে মমতাজের গান শুনতেই আর্মি স্টেডিয়ামে সবচেয়ে ভিড় হয়৷ এমনকি বিত্তবানদের বিয়ের অনুষ্ঠানেও ‘বন্ধু তুই লোকাল বাস' এর সঙ্গে নাচেন সবাই৷

এই যে হাই কালচার আর লো কালচারের বিভাজন, তা কিন্তু আজকের নয়৷ তার রয়েছে বেশ পুরানো ইতিহাস৷ যুগযুগ ধরেই ছোটলোকের সংস্কৃতি বলে অনেকেই নাক সিঁটকান, নিজেদেরকে হাই কালচার্ড বা উচ্চবর্গীয় সংস্কৃতিবান মনে করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন৷ মজার বিষয় হচ্ছে লো কালচার বলে যেসব কালচারকে দূরে ঠেলে দেয়া হয় কালের বিবর্তনে তারাই কিন্তু একসময় মেইনস্ট্রিম বা মূল ধারার সংস্কৃতিতে জায়গা করে নেয়৷

যেমন ধরুন জ্যাজ সংগীতের কথা৷ যখন আফ্রিকান দাস'রা অ্যামেরিকার তুলা বাগানে অমানুষিক পরিশ্রমের ফাঁকে খাবারের বিরতি পেতেন, তাদের শক্ত রুটি আর পানি খাওয়ার পরে নিজেদের থাল- গ্লাস বাজিয়ে গান ধরতেন৷ তাদের কষ্ট, রক্ত, ঘামের ইতিহাস নিজেদের দরাজ কণ্ঠে জানিয়ে দিতেন৷ দাসদের এই গান দীর্ঘকাল ধরে গরীব আর ছোটলোকের সংস্কৃতি হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে৷ কিন্তু আজ অ্যামেরিকার মূলধারার সংস্কৃতির অন্যতম ধারক জ্যাজ আর ব্লুজ সংগীত৷

এক সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে কম কটু কথা শুনতে হয়েছে তাঁর সহজ বাংলা লেখনীর জন্য! সে সময় বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষাকে উচ্চমার্গের মানা হত আর রবীন্দ্র রচনাকে চাষাভুষোর ভাষা বলে অনেকেই তাচ্ছিল্য করেছিলেন৷ অথচ গত একশ বছর ধরে রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা, সাহিত্য ‘হাই কালচারের' অংশ

বাংলাদেশের মাটির আর নদীর গন্ধভরা ভাটিয়ালি আর ভাওয়াইয়া গানের কথা ধরুন৷ অথবা লালন সংগীতের কথা৷ অসংখ্য মরমী, দরদী, বাউল জীবনঘনিষ্ঠ সংস্কৃতির কথা৷ এসবই কিন্তু তথাকথিত গরীবের সংস্কৃতি৷ কিন্তু এসব সংস্কৃতির উপরেই বাংলা ভাষা আর দেশের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত৷

কে ঠিক করে সংস্কৃতির উঁচু নিচু এই বিভেদ? পুরো পৃথিবীতে হাই কালচারে একটি বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে ফরাসি সংস্কৃতির৷ পোশাক, খাবার, আচরণ আর রীতিনীতির হাই কালচারে গত কয়েক শতক ধরেই প্রভাব বিস্তার করে আসছে ফ্রান্স৷ তারও আগে রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের সময় ইতালির ধনী পরিবারগুলো, যেমন মেদেচি পরিবার, ইউরোপের আর্ট ও কালচারের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন৷ তার মানে ইউরোপের উচ্চ বর্গীয় সংস্কৃতির পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস ও নামি দামি শিল্পীদের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না৷

দুঃখের বিষয় হচ্ছে বাংলার হাই কালচারে বাংলাদেশের জ্ঞানীগুণীদের চিন্তা ও প্রতিভার চাইতে পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু সত্যিকারের হাই কালচার নির্মার্ণের জন্য চেষ্টা, অর্থ বিনিয়োগ ও শিল্পী সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা কোনটাই করা হয়নি৷ শুধু শিক্ষিত সমাজ, যাদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত, সংস্কৃতি যাচাই বাছাইয়ের এক ধরনের মালিকানা পেয়ে গেছে৷ আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয় নির্দিষ্ট কিছু গান শুনবে, সিনেমা দেখবে, বই পড়বে এর বাইরে গেলেই ছেলে-মেয়ে বখে গেছে৷ অর্থাৎ ভালো লাগুক না লাগুক নিজেদের সুশীল হিসেবে গড়ে তোলার মানসিকতাটা বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত আর উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যে দেখা যায়৷

অমৃতা পারভেজ, ডয়চে ভেলে
অমৃতা পারভেজ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

আমাদের আগের প্রজন্মের কথাই ভাবুন৷ গানের ক্ষেত্রে তাদের কাছে হাই কালচার ছিলো শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, তিন কবির গান এসব৷ আর আজ হাই কালচার হলো ইংরেজি গান শোনা৷ কেবল ক্ল্যাসিকেল মিউজিক ফেস্টিভালে যাওয়া মানেই তারা যে সবাই শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুরাগী এ ধারণা ভুল৷ অর্থাৎ বাংলাদেশে সংস্কৃতি বদলে গেছে গত কয়েক দশকে৷ এর কারণ অবশ্য আমাদের শিল্প, সাহিত্যে অগ্রগতির অভাব৷ আর সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে ভারতীয় ও পশ্চিমা সংস্কৃতি৷

অপ্রিয় হলেও সত্য, বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে পশ্চিম বাংলার চেয়ে ‘লো কালচার' হিসেবে বিবেচনা করার প্রবণতা অনেকের রয়েছে৷ কিন্তু তারা ভুলে যান, কলকাতার রাস্তায় হাঁটলে আপনি বাংলায় কথা কমই শুনতে পাবেন৷ বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির যদি কোন ভবিষ্যত থাকে, তা ঢাকায়ই নির্ধারিত হবে, তা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত সাহিত্যিকও বারবার বলে গেছেন৷ 

আসলে সংস্কৃতি তো একটি বয়ে চলা নদীর মত৷ তা ভাঙবে-গড়বে, নিজের আনন্দে৷ কিন্তু তাতে বাঁধ দিয়ে গতিপথ পরিবর্তন করতে গেলেই বিপদ৷ তাই সংস্কৃতির উপর মোড়লগিরি চলে না৷ এই নদী নিয়মের বালির বাঁধে আটকায় না৷ আটকানোর চেষ্টা কিন্তু চলে৷ যেমন ধরুন, হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকে সস্তা জনপ্রিয় বলে অনেকে বাতিল করে দিতে চেয়েছেন৷ লো কালচারের সাহিত্যিক বলে ছোট করার চেষ্টা করেছেন৷ কিন্তু তাতে কি হুমায়ূনের সাহিত্যের প্রতি মানুষের ভালবাসার কমতি হয়েছে?

শুরু করেছিলাম টিকটক দিয়ে৷ বিশ্বায়নের এই যুগে কাকে আমরা মাটির কাছাকাছি, নিজস্ব সংস্কৃতি বলবো তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক৷ একজন অফু ভাই অথবা হিরো আলম এই সময়ের সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করেন, সে বিষয়ে কোন দ্বিধা নেই৷ এই প্রতিনিধিত্বে যদি কারো আপত্তি থাকে, তবে তাদেরকেও নিজেদের হাই কালচর্ড কনটেন্ট নিয়ে হাজির হতে হবে৷ দর্শক ঠিক করবে কোনটা তারা বেছে নিবে৷ আর সময়ই নির্ধারণ করবে কোনটা হাই, কোনটা লো আর কোনটা আমাদের নিজস্ব কালচার৷

আর বর্তমান যুগে মানুষের হাতের মুঠোয় বিনোদনের এত উপকরণ যে স্বল্প সময়ে যা দেখা যায় তাই হয়ে ওঠে ‘পপুলার কালচার' যেমন টিকটক৷ অর্থাৎ বেশিরভাগ মানুষ এখন স্বল্প সময়ে নিজেকে বিনোদিত করার উপকরণ খোঁজে৷

অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় একবার ঈদে প্রখ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনের বাসায় গিয়েছি৷ মামুন কাকু জিজ্ঞেস করলেন কি গান শুনছো আজকাল? বললাম লোপামূদ্রার কথা৷ উনি বললেন, শোনো সবধরনের গান শুনতে হয়৷ ক্লাসিকেল,ব্যান্ড, ধুম ধারাক্কা, যখন যা চলছে সব শুনবে৷ এভাবে শুনতে শুনতে কানে একটা ফিল্টার তৈরি হবে৷ তখন ভালো-মন্দের তফাতটা বুঝতে পারবে৷