1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

টেলিগ্রামের মৃত্যু সংবাদ

শীর্ষ বন্দোপাধ্যায়, কলকাতা১৯ জুন ২০১৩

১৫ জুলাই থেকে টেলিগ্রাম পাঠানোর ব্যবস্থা তুলে দিচ্ছে ভারতীয় ডাক ও তার বিভাগ৷ প্রায় ১৬০ বছর নিরলস কর্তব্যপালনের পর এই বাধ্যতামূলক অবসরের সংবাদ দুঃখিত করেছে অনেককেই৷

https://p.dw.com/p/18sbp
ছবি: Museum für Kommunikation Frankfurt

বহু সংবাদ একসময় সে নিজেই বয়ে নিয়ে গিয়েছে জীবনের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে৷ তার আগমনবার্তা একসময়ের সাদাসিধা, ঢিলেঢালা, নিস্তরঙ্গ বয়ে চলা জীবনে ক্ষণিকের জন্যে হলেও আমদানি করত শ্বাসরুদ্ধ উত্তেজনা৷ কী খবর বয়ে এনেছে টেলিগ্রাম, সেই ভাবনায় মুহূর্তের জন্যে হলেও যেন থমকে যেত ই-মেল আর মোবাইল টেক্সট মেসেজের আকস্মিকতামুক্ত সেই আটপৌরে পৃথিবী৷

বঙ্গজীবনে টেলিগ্রামের গুরুত্ব বোঝা যায় বাংলা চলচ্চিত্রে টেলিগ্রামের অপরিসীম ভূমিকা থেকে৷ ফাদার কিংবা মাদার ক্রিটিকাল, কাম শার্প – ছবির একেবারে মোক্ষম মুহূর্তে এই টেলিগ্রামখানি এনে না ফেলতে পারলে চিত্রনাট্যের মোড় কীভাবে ঘোরাবেন, ভেবে কুল পেতেন না ওস্তাদ ছবি করিয়েরাও৷ সিনেমাতে বহু সিরিয়াস, ট্র্যাজিক এবং কমিক দৃশ্যের অবতারণা করেছে একটিমাত্র টেলিগ্রাম৷ অথবা মহাগুরুত্বপূর্ণ টেলিগ্রামের যথাসময়ে না আসাটাই গল্পের শেষ পর্বে অসামান্য নাটকীয় মোচড়ের সুযোগ করে দিয়ে, সেই মূল্যবান টেলিগ্রাম নিজে নতমুখে অপ্রকাশিত থেকেছে৷

Lettlandisch Telegraf
এরকম টেলিগ্রাফ আপনিও পেয়েছেন নিশ্চয়ই!ছবি: Latvian State Archives

বলা বাহুল্য, শুধু দুঃসংবাদ নয়, অনেক সুসংবাদেরও বাহক ছিল টেলিগ্রাম৷ শুধু পিতা মাতার অসুস্থতা বা প্রয়াণের খবর কেন, গেরস্থের ঘরে খোকা হওয়া, মেজকুমারের বিলাত হইতে প্রত্যাবর্তন কিংবা ছোটখোকার সায়েবি আপিসে চাকরি হওয়ার সুসংবাদও উড়তে উড়তে নিয়ে গিয়েছে টেলিগ্রাম৷ বাড়ির সদর দরজায় হাসি হাসি মুখে অপেক্ষায় থেকেছেন বখশিস এবং মিষ্টান্ন প্রত্যাশী, গ্রামের বহু পুরাতন ডাকপিওন কাকা৷ দীর্ঘ এক সময় জুড়ে হাতে লেখা চিঠি এবং মাসকাবারি মানি অর্ডারের মতোই সামাজিক জীবনের শরিক থেকেছে টেলিগ্রাম৷ কখনও যদিও বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই এসেছে সে৷ সন্তান প্রসবকালে বড়খুকির মারা যাওয়া, অথবা পুরনো মামলায় হার হয়ে বসতবাড়িটুকু বৈরী শরিকের হস্তগত হওয়ার দুঃসংবাদ এনেছে৷

১৬৩ বছর ধরে এভাবেই মানুষের সুখে-দুঃখে সঙ্গী থেকেছে টেলিগ্রাম৷ সরাসরি যদি জীবনে তার অনুপ্রবেশের কোনও সুযোগ নাও ঘটে থাকে, ট্রেনের জানলা দিয়ে দ্রুত সরে যাওয়া টেলিগ্রাফের খুঁটি আর সেই ছুটন্ত ট্রেনের সঙ্গে সমান্তরাল চলতে থাকা টেলিগ্রাফের তারে ল্যাজ ঝুলিয়ে বসে থাকা ফিঙে পাখির ঝাঁক ভারতের গ্রামজীবনের ছবি হয়ে থেকেছে৷ শৈশবের খুশি চিরন্তন হয়ে গিয়েছে টেলিগ্রাফের থামে কান ঠেকিয়ে শুনতে পাওয়া শোঁ শোঁ শব্দে৷ হয়ত অনেকের স্মৃতিতে এই ছবিগুলো এর পরেও থেকে যাবে, কিন্তু থাকবে না আর টেলিগ্রাম৷

ভারতীয় ডাক ও তার বিভাগে সম্প্রতি ‘সার্কুলার' জারি হয়েছে, ১৫ জুলাই থেকে অবসরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে টেলিগ্রাম সার্ভিসকে৷ কারণ, কোনও লোক এখন আর টেলিগ্রাম পাঠায় না৷ প্রথমে ভারতে টেলিকম যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক উন্নতি এবং এখন ঘরে ঘরে, হাতে হাতে মোবাইল ফোন চলে যাওয়ার কারণে বেশ কয়েক বছর ধরেই টেলিগ্রাম বাতিলের দলে চলে গিয়েছে৷ অন্যদিকে বড় শহরগুলোর মধ্যে সমান্তরাল যোগাযোগ গড়ে তুলেছে ইন্টারনেট৷ অনেক কম খরচে এখন দেশের দুই প্রান্তের দু'জন লোক দিনে ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহের সাত দিন নিজেদের মধ্যে সংযোগ বজায় রাখতে পারেন৷ ফলে যে আপৎকালীন পরিষেবার জন্য একসময় টেলিগ্রামের গুরুত্ব ছিল, তাই এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে৷

আধুনিক সময়ে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে টেলিগ্রাফ বা টেলিগ্রাম ব্যবস্থার এই অবলুপ্তি নেহাতই স্বাভাবিক ছিল৷ তবু ভারতীয় ডাক ও তার বিভাগের এই সিদ্ধান্ত সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে৷ সুদূর ইংল্যান্ডের কাগজেও লেখালেখি হয়েছে ভারতে অবশেষে টেলিগ্রাম পরিষেবা বন্ধের এই খবর নিয়ে, যেহেতু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের প্রশাসনিক এবং বাণিজ্যিক প্রয়োজনেই ভারতে টেলিগ্রাম সার্ভিস চালু করেছিল, প্রথমে অবিভক্ত বাংলায় এবং তারপর বিহার ও দেশের অন্যত্র৷

পাশাপাশি টেলিগ্রাম বিয়োগের এই দুঃসংবাদে মনখারাপ বহু মানুষের, বিশেষত সেইসব বর্ষীয়ানদের, যাঁরা একসময় এই টেলিগ্রাম পরিষেবা নিজেরা ব্যবহার করেছেন৷ ই-মেল বা এসএমএস তাঁদের অবাক করেছে, একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু পুরনো অভ্যাসের কারণেই সম্ভবত, টেলিগ্রামের উপরেই যেন তাঁদের ভরসা ছিল বেশি৷ ১৫ জুলাইয়ের পর থেকে সেসবই তামাদি হয়ে যাবে৷ ইতিহাস হয়ে যাবে টেলিগ্রাম৷ জাদুঘরে জায়গা পাবে টেলিগ্রাফের টরে টক্কা যন্ত্র৷ দেশজুড়ে এই দুঃসংবাদ এখন ছড়িয়ে পড়ছে৷ না, টেলিগ্রাফ মারফৎ নয়৷ ই-মেলে আর মোবাইল ফোনের এসএমএস-এ৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য