1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘ডাব, ডাব....ডাইল’

হাবিব ইমরান
১৮ জুন ২০১৮

নেশাগ্রস্তদের সবসময়ই এটাওটা হারাবে, সময়ের গড়বড় হবে, মেজাজ খিটখিটে থাকবে৷ তাদের বাড়ি থেকে চুরি হবে, বন্ধুদের সাথে কলহ ও দূরত্ব তৈরি হবে – এটাই স্বাভাবিক৷

https://p.dw.com/p/2zlvn
ছবি: bdnews24.com

বাংলাদেশে গত শতাব্দীর শেষ দশকটা ছিল নেশাদ্রব্য ফেন্সিডিলের দখলে৷ ফেন্সিডিলের রাজ্যের মধ্যে বেড়ে ওঠার সে সময়টা আসলে অদ্ভুত৷ সম্ভাবনাময় অনেক বন্ধু ও পরিচিতজনকে ঝরে পড়তে দেখেছি৷ আমার খুব কাছের বন্ধুদের মধ্যে যারা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল তাদের অনেককেই দেখেছি ফেনসিডিল বা ‘ডাইলের’ নেশায় মত্ত হয়ে অন্যপথে পা বাড়াতে৷

ছেলেবেলা এবং শৈশব কৈশোরের বড় অংশ কেটেছে মতিঝিল এজিবি কলোনিতে৷ পাশেই ছিল কমলাপুরের নাসিরের ডাইলের স্পট! কে এই নাসির আমি জানতাম না৷ বন্ধুবান্ধবকে প্রায়ই দেখতাম রিকশা নিয়ে চলে যেতে৷ আর রিকশাতে বসেই ‘ডাইল মেরে’ দিতে৷ একবার পড়াশোনার কী এক কাজে আরেক বন্ধুর সাথে মুগদাপাড়া এলাকায় গিয়েছি, ফেরার সময় পথে পড়েছিল নাসিরের ফেনসিডিল বিক্রির স্পট৷

আমার বন্ধু আমাকে রিকশায় বসিয়ে রেখেই ভেতরে ঢুকে যায়৷ একটুপর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে পুলিশের তাড়া খেয়ে৷ আমি অবশ্য প্রথম থেকেই ভয় পাচ্ছিলাম৷ কারণ নাসিরের স্পট যেখানে তার বাইরেই পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল, তাহলে ঢোকার সময়ই আটকালো না কেন?

বন্ধু রিকশায় ওঠার পরই রিকশাওয়ালাকে জোরে রিকশা ছাড়তে বললো৷ আমি কিছুদূর এগোনোর পর জিজ্ঞাসা করলাম, পুলিশ কি জানে না কোথায় বিক্রি হয়!

বন্ধু জবাব দিল, ‘‘আরে ব্যাটা জানে ঠিকই বের হওয়ার সময় ধরলে পয়সা বেশি পায়৷ দু'পক্ষ থেকেই টাকা পাওয়া যায়৷’’

নাসির লোকটা খুবই শক্তিশালী কেউ কি ছিল? কেননা, সেনাবাহিনীর অপারেশন ক্লিনহার্ট চলার সময়ও শুনেছি নাসিরের স্পট চালু ছিল!

আমার ওই বন্ধুর বাবার বিস্তর টাকা ছিল, তাছাড়া সে নিজেও মেধাবী ছিল বলে রাস্তায় ছিনতাই করতে নামেনি৷

পরে শুনেছি ফেনসিডিল ছেড়েছে এবং এখন দেশের বাইরে খুব ভালো আছে৷ অথচ দেশে থাকতে এমন কোনো দিন ছিল না, থানা হাজতে কারো না কারো জন্য ছুটে যেতে হয়নি; কখনো কখনো নিজেও ধরা পড়ে পুলিশের কাছে কিছু জরিমানা দিয়ে ছাড়া পেয়েছে৷

মাদক হিসেবে ফেনসিডিলের বিস্তার ছিল সবচেয়ে বিধ্বংসী৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আখাউড়ায় ভারতীয় সীমান্তের এক গ্রামে একবারে ঘুরতে গেলাম৷ আমার এক মেয়েবন্ধুর বাড়ি৷ আমার বন্ধুর বাড়ির কেবল তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে৷ আর তাদের মূল কাজ চাষবাস৷ আর ওই গ্রামের প্রায় প্রত্যেকেই সীমান্তের ওপার থেকে এপারে ফেনসিডিল চোরাচালানে যুক্ত৷ মেয়ে বন্ধুর ভাইয়ের সাথে গ্রামে ঘুরতে বের হই৷ যে বাড়িতেই যাই বলে, ‘‘ভাই কী খায়! দিবো?’’

অর্থাৎ চায়ের বদলে ফেনসিডিল দিয়ে আপ্যায়ন যেন এক রীতি৷ সীমান্তরক্ষী বাহিনী ধরে না? – এ প্রশ্ন যাকেই করি, তিনিই হেসে ফেলেন, উত্তর দেন না৷ ফেরার সময় আরও অভিনব এক পরিস্থিতিতে পরলাম৷ ট্রেনে উঠেছি৷ হঠাৎ ফেরিওয়ালাকে ডাকতে শুনলাম- ‘ডাব, ডাব...ডাইল৷’ প্রথম দু'টি শব্দ জোরে পরেরটা আস্তে৷

ইয়াবা প্রথম দেখি ২০০৩ বা ২০০৪ সালে৷ আমার স্কুল পড়ুয়া এক সহপাঠী রোজ এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশে বসে থাকে৷ তার সাথে আমার কোনো কাজ নেই৷ তাহলে সে কেন আসে! আমি তখন একটি বামপন্থি দলের সক্রিয় কর্মী৷ সে পাশে এসে বসে থাকে, কোনো গল্প নেই৷ কেমন অস্বস্তি হয়৷ চেহারায় একটা চোর চোর ভাব৷ একদিন জিজ্ঞেস করি, আসলে তোর সমস্যা কী খুলে বল!

সে আমাকে যা জানালো, তাতে আমার প্রচণ্ড রাগ উঠলো৷ সে নাকি ‘মেয়ে মানুষের’ ব্যবসায় নেমেছে! আমার খুব রাগ হলো, যখন বললো সে আসলে আমার কাছে আসে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে তার ব্যবসাটা খুব জমে৷

আমি তাকে অপমান করলাম খুব৷ কিন্তু সে আবার এলো৷ একদিন মনে হল এত পুঁচকে একটা মানুষ স্রেফ মিথ্যা বলে ভাব নিচ্ছে৷ আমার সন্দেহ হয়, সে মনে হয় এসবের সাথে জড়িত না৷ পরখ করে দেখতে ইচ্ছে হওয়ায় একদিন খুব উৎসাহী হওয়ার ভান করে বললাম, ‘‘চল একদিন তোর ব্যবসার জায়গাটা দেখে আসি৷’’

নির্দিষ্ট দিনে সে আমাকে ঢাকার শাহজাহানপুরে তার ভাড়া করায় বাসায় নিয়ে গেল৷ সেখানে তখন একটি মেয়ে ছিল; মেয়েটির খুব জ্বর৷ বাকি মেয়েরা নাকি কাজে গেছে! সেদিনই তার ওয়ার্ড্রোবের ড্রয়ার থেকে একটি প্যাকেট বের করে কিছু গোলাপি রঙের ছোট ছোট ট্যাবলেট দেখাল৷

Habib Imran
হাবিব ইমরান, ডয়চে ভেলেছবি: DW/S. Burman

বন্ধু আমাকে বলেছিল – এটা কী চিনিস!

আমি দু'পাশে মাথা নাড়িয়ে না চিনতে পারার ভঙ্গি করার পর সে ফিসফিস করে বলেছিল, এটা ইয়াবা!

সেই ছোট ইয়াবা এখন সবচেয়ে বিধ্বংসী ড্রাগ হিসেবে আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিয়েছে৷

কাছের এক বন্ধুকে নিয়ে একসাথে রাজনীতি করতে শুরু করেছিলাম৷ এত অসাধারণ স্লোগান টানতো, এত চমৎকার করে মানুষের সাথে মিশতো, আর এত অসাধারণ তার কমিউনিকেশন স্কিল ছিল – হয়ত রাজনীতিতে সে বড় কিছুই হতে পারতো৷ বন্ধুকে সবসময় সামনের দিনের বাংলাদেশ কাঁপানো নেতা হিসেবেই ভাবতাম৷ সে ছাত্র হিসেবেও ছিল অসাধারণ৷

হঠাৎ করেই আমার সে বন্ধু পরলো নেশার কবলে৷ রাজনীতি তো দূরে থাক শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনটাই তার হয়ে গেল নেশাতুর, টালমাটাল৷ ক্যারিয়ার খুঁইয়ে এখন শুনেছি গ্রামের বাড়িতে থাকে৷ সারাক্ষণ বাড়িতেই থাকে৷ কিছুই করে না৷ স্কুল বা কলেজের বন্ধুবান্ধবরা যখন একসাথে হই, তখন এমন কেউ নেই যে ওকে নিয়ে আক্ষেপ আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে না৷ ও কী জানে, ওকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলার প্রচুর মানুষ আছে! মাদকসেবীরা কি বোঝেন তাঁরাও অন্যের দীর্ঘশ্বাস!

প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...