1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তালেবান রাজ্যে নারী: পরিস্থিতি কি আদৌ বদলাচ্ছে? 

শাহনাজ মুন্নী
২০ আগস্ট ২০২১

যে কোন দুর্যোগেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় নারী৷ নারীর বিপদ বাড়ে, দুর্ভোগ বাড়ে৷ বিপন্ন হয় তার অবস্থান ও অস্তিত্ব৷

https://p.dw.com/p/3zHX7
ছবি: Wakil Kohsar/AFP

আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুত্থান প্রচলিত অর্থে হয়তো দুর্যোগ নয় কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে তাদের শাসন আমলে দুর্যোগের মতই ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়েছিল আফগান নারীরা৷ তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল ৷ পোশাকের অজুহাতে নারীকে খুন করা, মেয়েদের স্কুল কলেজে যেতে বাধা দেওয়া, কর্মস্থল থেকে সরিয়ে দেওয়া,  জোর করে কমবয়সী নারীদের তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়াসহ হেন অকর্ম নেই যা তারা সেই কালো সময়ে করেনি৷ এমনকি গত বছরও তালেবান জঙ্গিরা পুলিশ হওয়ার অপরাধে এক নারীকে অন্ধ করে দিয়েছিল৷ নারী বঞ্চিত হয়েছিল আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা থেকেও৷     

অথচ ষাট, সত্তর বা আশির দশকে তোলা সাদা কালো ছবিতে আফগান নারীদের দেখা যায় মুক্তভাবে বিচরণ করছেন রাস্তায়৷ যাচ্ছেন শিক্ষা ক্ষেত্রে, পড়ছেন মেডিক্যাল কলেজে৷ তারা আছেন কমপিউটর প্রশিক্ষণের ক্লাসে, শিক্ষকতায়, ব্যাংকে, চাকুরিক্ষেত্রে৷

নব্বই দশকের বছরগুলোতে দ্রুত নারীদের সেই উজ্জ্বল উচ্ছল চিত্র বদলে যেতে শুরু করে৷ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ তালেবান শাসনামলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন আফগান নারীরা৷ মেয়ে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার উপর  নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়৷ নারীরা শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সুযোগ হারান৷ বন্দি হন ঘরের চার দেয়ালে৷ সেই সময় নারীদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করা হয়৷ নিষিদ্ধ করা হয় পুরুষ সঙ্গী ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া৷ এসব নিয়ম না মানলে পাথর নিক্ষেপ, বেত্রাঘাত ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার মতো কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়৷ এসময়ে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয় নারীর মৌলিক মানবাধিকার৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্ম-সংস্থান, ক্ষমতায়নসহ সকল ক্ষেত্রেই নারীরা পিছিয়ে গড়ে৷ ২০০১ সালে তালেবানেরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত ২০ বছরে আবার একটু একটু করে নারীদের অবস্থান পরিবর্তিত হতে থাকে৷ স্কুল কলেজে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের উপস্থিত থাকতে দেখা যায়৷ ইউনেস্কোর তথ্য অনুসারে ২০১৮ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১২৪ জন ছেলের বিপরীতে ৮৩জন মেয়ে ভর্তি হয়৷ উচ্চশিক্ষাতেও ১৪ জন পুরুষ শিক্ষার্থীর বিপরীতে নারী শিক্ষার্থী ছিল ৫ জন৷ নারীরা রাজনীতিতে অংশ নিয়ে মেয়র, সংসদ সদস্য ও ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন৷ প্রায় দেড়শত নারী সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দক্ষতার সাথে কাজ করেন৷ সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা, সমাজকর্মী ও ব্যাংকিং পেশায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে৷ খোলা মাঠে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলায় অংশ নেন আফগান নারীরা৷ অনেক নারী পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং নারী অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হন৷       

এরকম একটি অবস্থায় ২০ বছর পর সেই তালেবানেরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসায় স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও শঙ্কায় ভুগছেন সে দেশের সাধারণ জনগণ বিশেষ করে নারীরা৷ তারা ভাবছেন, আবার হয়তো সেই অন্ধকার সময় ফিরে এসেছে৷ ফিরে এসেছে নারীর উপর জোর-জুলুম ও জবরদস্তি করার দুঃসময়৷ এর মধ্যেই গণমাধ্যমে নানা রকম খবর পাওয়া যাচ্ছে৷ শোনা গেছে, বিভিন্ন প্রদেশে পেশাজীবী কয়েকজন নারীকে হত্যা করা হয়েছে৷ জুলাই মাসেই তালেবানদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অফিসে গিয়ে নারী কর্মীদের অফিস ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ জোর করে অবিবাহিত ও বিধবা নারীদের সঙ্গে তালেবান যোদ্ধাদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ বোরকা কিনতে দোকানে ভিড় করছেন নারীরা৷ দেয়াল থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে বিজ্ঞাপনের নারী মুখ৷ ভীত আতংকিত বহু নারী দেশ ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাহায্য চাইছেন৷ তারা বলছেন, আফগান নারী, শিশু, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাহায্য ও সমর্থন দরকার৷ নইলে গত ২০ বছরের অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে পড়বে৷ তালেবানরা নারী অধিকারকে চুলোয় পাঠাবে, নারীদের আবারো ঠেলে দেবে ঘরে৷  

এই ভয় এবং আশংকার মধ্যেই তালেবানদের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিষয়ক মুখপাত্র এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন, শরীয়া আইন অনুযায়ী শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণসহ নারীদের সব ধরনের অধিকার রক্ষায় তালেবান বদ্ধপরিকর৷ এরই মধ্যে তাদের সরকারে নারীদের যোগ দিতেও আহ্বান জানানো হয়েছে তালেবানদের পক্ষ থেকে৷ তালেবানের সাংস্কৃতিক কমিশনের একজন সদস্য বলছেন, তালেবান প্রশাসনের অধীনে নারীরা চাকরি করতে পারবেন৷ তিনি বলেছেন, ইসলামিক আমিরাত চায়না যে নারীরা নির্যাতনের শিকার হোক৷ কিছুদিন আগে, কাবুলে তালেবান যোদ্ধাদের প্রবেশের সংবাদে  টেলিভিশনের পর্দা থেকে যে নারীরা উধাও হয়ে গিয়েছিলেন তাদেরকেও আবার সংবাদ উপস্থাপনায় ফিরতে দেখা গেছে৷ এমনকি তালেবানের এক মুখপাত্র একটি বেসরকারি টেলিভিশনে একজন নারী সাংবাদিককে সাক্ষাতকারও দিয়েছেন৷ 

এসব দেখে অনেকেই প্রশ্ন করছেন, তাহলে কি তালেবানরা তাদের কট্টর নারীবিরোধী অবস্থান থেকে কিছুটা  সরে এসেছে? গত ২০ বছরে বদলে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারাও কি নিজেদের আদর্শ পাল্টেছে? এবার কি তারা নারীদের প্রতি সহনশীল মনোভাব দেখাবে? নারী শিক্ষা এবং নারীর অগ্রগতিকে উৎসাহিত করবে?

শাহনাজ মুন্নী, সাংবাদিক
শাহনাজ মুন্নী, সাংবাদিকছবি: privat

দূর্ভাগ্যজনকভাবে তালেবানের অতীতের কর্মকাণ্ড বিবেচনায় বেশির ভাগ মানুষই এক্ষেত্রে আশাবাদি হতে পারছেন না৷ অনেকেই মনে করছেন, তালেবানরা ইসলামের নামে যে উগ্রবাদি রক্ষণশীল মতবাদের চর্চা করে সেখানে নারী স্বাধীনতা ও নারী অধিকারের স্বীকৃতি নেই৷ ফলে তারা নিজেদের অবস্থান পাল্টেছে কি না তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ আছে৷ কারণ অতীতে কখনোই তাদের কার্যক্রমে এ ধরনের নজির দেখা যায়নি৷ তালেবানেরা কথা দিয়ে কথা রাখে না৷ মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, নারীর শিক্ষা ও ঘরের বাইরে কাজ করার অধিকারে তাদের বিশ্বাস নেই৷

এদিকে তালেবানেরা আন্তর্জাতিক মহল ও আফগান নারীদের আশ্বস্ত করতে চাইছে এই বলে যে, এবারে তালেবান শাসনামলে মেয়েরা প্রাথমিক থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে৷ অর্থাৎ নারীদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ থাকবে৷

তালেবানের মুখপাত্র এও বলেছেন যে, তাদের সরকার পরিচালিত হবে ইসলামিক মূল্যবোধে৷ কিন্তু এবার আর নারীদের পুরো শরীর ঢাকা বোরকা বাধ্যতামূলক করা হবে না৷ তবে বাইরে বের হওয়া নারীরা মাথায় হিজাব পরেছেন কিনা সেটা পর্যবেক্ষণ করা হবে৷

তালেবানরা বার বার বলতে চাইছে, ২০ বছর আগের তালেবান আর এখনকার তালেবানরা এক নয়৷ তারা আর সংঘাতে যেতে চায় না৷ নারীদের পড়াশোনা ও কাজের সুযোগ দিতে চায়৷ সংবাদ মাধ্যমকেও স্বাধীন রাখতে চায়৷

তবে এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে, তালেবানদের ভয়ে আফগানিস্তান থেকে পালাতে চাইছে নারী পুরুষ শিশুসহ অনেক মানুষ৷ তালেবানরা নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে কাবুলের রাস্তায় নারীদের উপস্থিতি দেখা যায়নি৷ কাবুল থেকে এক শিক্ষার্থী ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, কাবুলের রাস্তা সম্পূর্ণ নারীশূন্য৷  নারীরা তালেবানদের ভয় পায়৷ আসলে নারীদের পূর্ব অভিজ্ঞতা এতটাই তিক্ত যে, এতো আশ্বাস দেওয়ার পরও নারীরা হয়তো তালেবানদের বিশ্বাস করতে পারছে না৷ সত্যি বলতে, যে ত্রাসের রাজত্ব তারা কায়েম করেছিল তার স্মৃতি নারীদের পক্ষে সহসা ভুলে যাওয়া খুবই কঠিন৷

ফলে আগামী দিনগুলিতে নিজেদের আচরণ ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে নারীদের আস্থা অর্জন তালেবানের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ৷ যদি সত্যিই তারা দৃষ্টিভঙ্গী বদলায়, গোঁড়ামি মুক্ত উদার মনোভাবের চর্চা করে তবে হয়তো আফগানিস্তান সেই পুরনো অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতে আর ফেরত যাবে না৷

২০ বছর অনেক সময়৷ এই সময়ে নানা ঘাত- প্রতিঘাতে তালেবানদেরও কম শিক্ষা হয়নি৷ তারাও হয়তো বুঝেছে, আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে বদলাতে হবে প্রাচীন মনোভঙ্গী৷ নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা বাদ দিয়ে নারী উন্নয়নের চলমান ধারা অব্যাহত রাখতে হবে৷ পাশাপাশি নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও  নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে৷

তবে বাস্তবে কি ঘটবে সেটি নিয়ে এখনি নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন, এক্ষেত্রে হয়তো আমাদের আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে৷ পর্যবেক্ষণ করতে হবে তালেবানদের গতি প্রকৃতি৷