1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তিলোত্তমা নগরী কবে হবে ঢাকা?

৩১ জুলাই ২০১৮

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ঈর্ষণীয় সাফল্য বাংলাদেশ দেখালেও ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের ওপর চাপ কি কমছে? একদিকে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত না করা, অন্যদিকে ঢাকাকেন্দ্রিক মানুষের ঢল নষ্ট করছে রাষ্ট্রের ভারসাম্য৷

https://p.dw.com/p/32FE9
Ein Paar in Dhaka
ছবি: picture-alliance/dpa/A.Abdullah

তীব্র যানজট, একটু বৃষ্টিতেই পুরো শহর ডুবে যাওয়া, গাড়ির হর্ন, ধুলা, এমন হাজারো কষ্টের শহর ঢাকা৷ কিন্তু তারপরও দেশের জনসংখ্যা না বাড়লেও ঢাকার জনসংখ্যা কিন্তু দিন দিন বেড়েই চলেছে৷ কেন?

৬৪ জেলার দেশ বাংলাদেশ৷ সবশেষ আদমশুমারি বলছে, মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির একটু বেশি৷ অথচ, ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ঢাকা শহরেই বাস করছেন প্রায় ২ কোটি মানুষ৷

সম্পদের চেয়ে জনসংখ্যা যখন বেশি হয়ে যায়, তাকেই বলে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ৷ পুরো দেশের হিসেবে সে আশংকা আপাতত বাংলাদেশ ঠেকাতে পারলেও, ঢাকা কিন্তু বিশ্বব্যাপী এখনও উদাহরণ হয়েই আছে৷

নাগরিকদের সঠিকভাবে সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ঢাকাকে ভাগ করা হয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশনে৷ কিন্তু তাতে যে কোনো লাভই হয়নি, সেটা আবারও প্রমাণ হয়েছে এবারের বর্ষায়৷ সড়কে নৌকার চলাচল রীতিমতো ঢাকার সেবা ব্যবস্থাকে পরিণত করেছে কৌতুকের সামগ্রীতে৷ 

একদিন জনসংখ্যা নিয়ে আলাপ হচ্ছিলো ভারতের এক সাংবাদিকের সাথে৷ ঢাকাকে তিনি দিল্লির সাথে তুলনা করলেন৷ পত্রিকা দেখে পরিবেশ ও সেবা সংক্রান্ত যে খবরগুলো পাওয়া যায়, তাতে নির্দ্বিধায় বলে দিয়েছিলাম ঢাকার অবস্থা দিল্লির মতো এতোটা খারাপ হয়নি এখনও৷ 

তিনিও মেনেই নিয়েছিলেন আমার কথা৷ কিন্তু একটু পরেই মোবাইল ফোন ঘেঁটে তিনি জানালেন, জানো ঢাকা আর দিল্লিতে জনসংখ্যার এই মুহূর্তে কি অবস্থা?

দেখা গেলো, দিল্লিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করেন ১১ হাজার তিনশ মানুষ৷ আর ঢাকায়? আন্দাজ করুন৷ প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৫ হাজার মানুষ!

কেন মানুষ এখনও ঢাকামুখী!

শিল্প বলুন, আর কারখানা বলুন, আর অফিস-আদালতই বলুন, সবকিছুই যখন ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গড়ে উঠছিল, তখন থেকেই অনেকে আশঙ্কা করছিলেন, ঢাকা হবে একসময় বসবাসের অযোগ্য৷ দাবি উঠেছিল বিকেন্দ্রীকরণেরও৷ কিন্তু তারপরও কোনো সরকারই তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি৷

ফলে, এখনও গুরুত্বপূর্ণ কাজে ঢাকাতেই আসতে হয় মানুষকে৷ সচিবালয়, গুরুত্বপূর্ণ সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত সব অফিস, আদালত অবস্থিত ঢাকার সব ব্যস্ততম স্থানগুলোতে৷

বড় বড় শিল্প কারখানাগুলো ঢাকার বাইরে স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে অনেক আগে থেকেই৷ কিন্তু আসলেই কি তাই? দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাকশিল্প৷ প্রায় সব পোশাক কারখানাই গড়ে উঠেছে ঢাকার চারপাশ জুড়ে, সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ এখন চারপাশ থেকে চেপে ধরেছে রাজধানীকে৷

প্রতিবারই ঈদ বা বড় কোনো ছুটি এলেই পত্রিকার শিরোনাম জুড়ে থাকে, ‘‘অমুক মহাসড়কে এতো মাইল দীর্ঘ যানজট'৷ এর পেছনে সড়ক অব্যবস্থাপনা যেমন দায়ী, ঢাকার চারপাশে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব শিল্প কারখানাও দায়ী সমানভাবেই৷

সেবা খাতও মানুষের ঢাকামুখী হওয়ার বড় কারণ৷

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার হুমকি দিয়েছেন ডাক্তাররা গ্রামে না গেলে তাদের চাকরি ছেড়ে দিতে হবে৷ কিন্তু তাতেও কি কাজ হয়েছে? উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে নামকাওয়াস্তে চিকিৎসা পাওয়া গেলেও, একটু বড় কিছু হলেই মানুষকে আসতে হয় শহরে, এবং তারপর ঢাকায়৷

দেশের একমাত্র সরকারি টারশিয়ারি মেডিকেল হসপিটাল হিসেবে এখনও কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল৷ বাংলাদেশের আনাচকানাচ থেকে সব হাসপাতালের ফিরিয়ে দেয়া রোগীরা এসে ভর্তি হন এখানে৷

সীমিত সম্পদ এবং জনবল দিয়ে এই রোগীদের সেবা তো দূরের কথা, স্থান সংকুলানেই অপারগ ডিএমসি৷ এমন অবস্থার সুযোগ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে চলেছে দালালদের দৌরাত্ম্য৷

প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়ার কৃতিত্ব দাবি করতেই পারে সরকার৷ কিন্তু সেই সুবিধা কাজে লাগিয়ে নিজেদের জীবনমানের উন্নয়ন করতে পারেন, এমন সুযোগ এখনও পৌঁছেনি জনগণের কাছে৷

ডিজিটাল যুগে প্রবেশের দাবি করছে সরকার, কিন্তু হাতের নাগালেই সব সুবিধা রাজধানীতে যতটা নিশ্চিত করা যায়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সেবার তেমন অবারিত প্রবাহ নিশ্চিত হয়নি একেবারেই৷ 

দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান সম্পর্কে সমান ধারণাও এখনও মানুষের মধ্যে নেই৷ কর্মক্ষেত্রেও নেই সমান সম্মান৷ ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকাকেন্দ্রিক অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সীমাহীন আগ্রহও অনেককেই টেনে আনছে রাজধানীতে৷ এদের ৮০ শতাংশই রাজধানীর লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত হয়ে শত কষ্ট সত্ত্বেও জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন ঢাকাতেই৷

ধেয়ে আসছে বিপর্যয়

অনেক চেষ্টা ও বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও এখনও বাণিজ্যিক, শিল্প ও আবাসিক এলাকাই আলাদা করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ৷ ফলে আবাসিক এলাকায় শত শত স্কুল, বাণিজ্যিক এলাকায় অপরিকল্পিত আবাসনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক হাস্যকর নগরায়ন ব্যবস্থার৷

ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলের মতো জোড়াতালির ব্যবস্থা হাতে নিয়ে কোনো রকমে যানজট ঠেকানোর চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু তাতে বরং শহরজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে ‘দোতলা যানজট'৷

সেবার অন্যান্য ক্ষেত্রেও পড়ছে এর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব৷

বছর পাঁচেক আগে ঢাকায় কর্মরত অবস্থায় পানি নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন করতে যেতে হয়েছিলো কৃষি ভবনে৷ ভূগর্ভস্থ পানির কী অবস্থা, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদনের কথা মাথায় ঘুরলেও সেখানে গিয়ে তো মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার অবস্থা৷

এক গবেষক জানালেন, সাধারণত, প্রতিটি এলাকাতেই ভূগর্ভস্থ পানির এক একটি পকেট থাকে৷ বৃষ্টির পানি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপায়ে সে পকেট থেকে তোলা পানি আবার ভরাট হয়৷

কিন্তু ঢাকার পকেটগুলোতে গভীর নলকূপ দিয়ে যে হারে পানি তোলা হচ্ছে, তাতে সে পকেটের পানি আর প্রাকৃতিক উপায়ে রিচার্জ হচ্ছে না৷ বরং গাজীপুর ও অন্যান্য পকেটের পানিও টেনে আনছে ঢাকার মানুষ৷ ফলে ধীরে ধীরে খালি হচ্ছে আশেপাশের এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানিও৷

আরো বড় বিপদ রয়েছে৷ ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারে পকেট খালি হওয়ায় সে স্থান পূরণে মাটির নিচ দিয়ে ঢুকে পড়ছে সমুদ্রের লবণ পানি৷ এবং সে লবণাক্ততা নাকি এখন অবস্থান করছে গোপালগঞ্জে৷ যে-কোনো মুহূর্তে তা ঢুকে পড়তে পারে ঢাকাতেও৷ একবার সে অবস্থার সৃষ্টি হলে আর কোনোভাবেই লবণ পানি বের করা যাবে না৷ ফলে পুরো দেশের কৃষিতে পড়বে মারাত্মক প্রভাব৷

প্রতিকার জানতে গিয়েছিলাম ঢাকা ওয়াসার তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে৷ তিনি কিছু আশার কথা শোনালেন৷ বললেন, শোধনাগার বাড়িয়ে ভূগর্ভের পানির ওপর চাপ কমানোর চেষ্টা চলছে৷ যমুনার পানি খাল কেটে নাকি নিয়ে আসা হবে ঢাকায়৷

কিন্তু ৫ বছর পরও অবাক হয়ে একদিন দেখলাম আমাকে দেয়া সে ইন্টারভিউয়ের বক্তব্যই তিনি দিয়েছেন আরেক সাংবাদিককে৷ পাঁচ বছরেও বদলায়নি তাঁর আশার কথা৷

ঢাকায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায়, এবং কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাবে স্বল্প জনবল দিয়ে সবার জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও৷ বেড়েই চলেছে দিনেদুপুরে চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা৷

অর্থনীতির একেবারে প্রাথমিক সূত্র অনুযায়ী যোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি হলে যা হওয়ার কথা, তা-ই হচ্ছে, হু হু করে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম৷ বাজার ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু কাঠামো না থাকায় এর চাপ পড়ছে গ্রামেগঞ্জেও৷ একদিকে, গ্রামের সব কৃষিপণ্য বেশি লাভের আশায় শহরে, বিশেষ করে ঢাকায়, রপ্তানি হওয়ায় দেখা দিচ্ছে সংকট, অন্যদিকে সঠিক দাম না পেয়ে মাথায় হাত কৃষকদের৷

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণেও নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ৷ ঢাকায় আবাসন এখন এক আতঙ্কের নাম৷ বেতনের ৬০ শতাংশ, কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি যেখানে চলে যায় বাড়িওয়ালার পকেটে, সেখানে জীবনমান উন্নত করার খুব কম সুযোগই পাচ্ছেন ঢাকাবাসী৷ 

Anupam Deb Kanunjna
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: Privat

কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, এত আলোচনা, সভা-সেমিনার, আশঙ্কা প্রকাশ সত্ত্বেও যাঁরা নীতি নির্ধারণ করেন, তাঁরা কেনো কার্যকর কিছু করছেন না? ঢাকা বাঁচাতে কেন এখনই শুরু হচ্ছে না বিকেন্দ্রীকরণ?

অনেকে মনে করেন, এর পেছনে দায়ী রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা৷ অর্থনীতি, প্রশাসন, এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটলে, ক্ষমতা যাবে তৃণমূলেও৷

ফলে ঢাকার ক্ষমতা ছাড়তে এই মুহূর্তে রাজি নন কেউই৷ এজন্য প্রয়োজনে হয়তো তাঁরা ঢাকাকেই কোরবানি দিতে রাজি৷

কিন্তু তারপরও স্বপ্ন থেমে থাকে না৷ বাংলাদেশের সংবিধানে আছে জনগণই দেশের সকল ক্ষমতার উৎস৷ ফলে জনগণকেই দাবি তুলতে হবে ঢাকাকে বাঁচানোর৷

ঢাকাকে একসময় বলা হতো তিলোত্তমা নগরী৷ তিলোত্তমা বললেই যে সৌন্দর্য, ভালোবাসার কথা চোখে ভেসে ওঠে, ঢাকা হয়ত সত্যিই একদিন হয়ে উঠবে তেমন সুন্দর, তেমন ভালোবাসায় স্বাগত জানাবে নাগরিকদের৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য