1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দীর্ঘসূত্রতা পরের প্রজন্মেও ছড়িয়ে দিচ্ছে ঘৃণা

২৮ জুন ২০১৯

তুচ্ছ কিছু থেকে একেবারে বড়সড়—ঘটনা যেটাই হোক, তাতে যদি কোনো মানুষ মনে করে তার অধিকার খর্ব হয়েছে, কিংবা ন্যায় বিচার বঞ্চিত হয়েছে, তখনই মানুষ তাঁর শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেয় আদালতকে।

https://p.dw.com/p/3LESh
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman

একমাত্র আদালতই পারে ব্যক্তি থেকে সামষ্টিক তথা সমাজের প্রতিটি স্তরে সাম্য আর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে। আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মন্ত্র নিয়েই বিশ্বজোড়া আদালত নামের প্রতিষ্ঠানটি তৈরি হয়েছে।

দেশের প্রেক্ষাপট এমন হয়েছে, আদালত শব্দটা মানেই যেন কাল ক্ষেপণের ঘেরাটোপ। একটা মামলা শুরু হলে আর শেষই হতে চায় না। আদালতীয় ভাষায় যা দীর্ঘসূত্রতা।

উদাহরণ খুঁজতে দূরে যেতে হয় না মোটেও। নিজের চেনা গণ্ডির মধ্যে প্রবীণ কারো সঙ্গে কথা বললেই শত উদাহরণ টানা যায়। এই দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়েই, নিজেরই তালগোল পাকানোর অবস্থা। বিচার চাইতে গিয়ে যে যন্ত্রণা সইতে হয়, তার চেয়ে কী বিচার না চাওয়াই ভালো?--এমন প্রশ্নও ফিরে ফিরে আসছে৷ 

ভূমি সংক্রান্ত এক মামলার কথা বলি৷ ১৯৮৮ সাল। তখন স্বৈরশাসন। এরশাদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আরেক লড়াই। ওই সময় রাঙামাটি-চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী ঢালারমুখ এলাকায় কিছু জমি কেনেন মাহবুব আলম চৌধুরী নামের একজন স্থানীয় লোক। নিয়মমাফিক সবকিছু শেষ করে, জমির দখল বুঝে নেয়ার পালা। দখল পেলেন, ছোটোখাটো একটা ঘর তোলা হলো।

কিছুদিন পরেই শুরু হলো বিপত্তি। ওই ভূমির মালিকানা দাবি করলো রাবার বাগান। অভিযোগ করা হলো, রাবার বাগানের ভূমিতে অন্যায়ভাবে বসতি গড়া হয়েছে। শুরু হলো মামলা। ২০১৯ সালের অর্ধেকটা শেষ। মামলা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। ঝুলে আছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। মাঝখানে পেরিয়ে গেছে, তিন দশকেরও বেশি সময়। কবে নিষ্পত্তি হবে, তার কোনো সদুত্তর কারো কাছে নেই।

ওই ব্যক্তির সঙ্গে আলাপে জানা গেল, ৩১ বছর ধরে মামলা চালাতে গিয়ে যে অর্থ তাঁর পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে, সেটার পরিমাণ জমির মূল্যকে ছাড়িয়ে গেছে।

বলছি না, ওই ব্যক্তিকেই মামলা জিততে হবে। তথ্য-প্রমাণাদি সাপেক্ষে সে সিদ্ধান্ত নেবে আদালত। সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যই তো আদালত। কিন্তু এই মামলার নিষ্পতি হতে এতো সময় লাগবে কেন? কেন ৩১ বছর ধরে টানতে হবে ঘানি?—এমন প্রশ্ন তো একজন নাগরিক হিসেবে তুলতেই পারি।

সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ৫০/৬০ বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে চলতে থাকার মামলার সংখ্যাটা নেহাত কম হবে না। এমনকি, কোনো কোনো মামলায় বাদি বিবাদীদের কেউ বেঁচে নেই। ফলে চলমান মামলার জের ধরে, পরবর্তী প্রজন্ম একে অপরের মুখোমুখি। পিতৃপুরুষের রেখে যাওয়া অমীমাংসিত ঘটনা নিয়ে সৌহার্দ্য নষ্ট হচ্ছে নতুন প্রজন্মের৷ ছড়িয়ে পড়ছে ঘৃণা। অথচ মামলাটি নিষ্পত্তি হলে হয়তো, পরের প্রজন্ম একে অপরকে প্রতিপক্ষ ভাবতেন না। আর যদি এ ধারা চলতে থাকে, তবে তো, ন্যায় বিচারে নামে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে পালন করতে হবে কলহের বীজ৷ এ দায় কার

মামলা জটের এই সংকট কতোটা তীব্র হয়েছে, তার চিত্র উঠে এসেছে জাতীয় সংসদে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রীদের প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, মামলা জট কমানোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। তাই, সরকার বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোসহ বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও জানান আইনমন্ত্রী।

সংসদে আইনমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালতে সর্বমোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫০টি। এর মধ্যে বিচারাধীন ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ২০ লাখ ৪৮ হাজার ৬৭টি।

এবার আসা যাক একটা ফৌজদারি মামলা প্রসঙ্গে৷ ২০০৫ সালে ৪০ বোতল ফেনসিডিলসহ আটক হন মাদক ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন বিহারী৷ মামলার এজাহারে আসামির নাম ছিল, শাহাবুদ্দিন বিহারী৷ ডিবির তদন্তের পর চার্জশিটে আসামির নাম হয়ে যায়, শাহাবুদ্দিন বিহারী ওরফে আরমান৷ দুজনের বাবার নামই মো. ইয়াসিন৷ চার্জশিট জমা দেয়ার দেড় বছর পর মূল আসামি শাহাবুদ্দিন বিহারী জামিনে মুক্তি পেয়ে ফেরারি হয়ে যান৷ কিন্তু পরবর্তীতে আদালত ওই আসামিকে দশ বছরের জেল দেয়৷ তাকে গ্রপ্তারে পরোয়ানা জারি করা হয়৷ এরপর ২০১৬ সালে নিজ নাম আর বাবার নাম মিল থাকায় মূল আসামির বদলে জেলে যায় বেনারসী শ্রমিক আরমান৷ গত তিন বছর ধরে সে কারাগারে৷ অথচ গ্রেপ্তারের সময় ঠিকানা, বয়স, আসামির স্বাক্ষরতা আর আরমানের নিরক্ষরতার মতো এতো অমিল পুলিশ কর্মকর্তার নজরে আসেনি৷

পরে বিষয়টি নজরে এলে, আরমানকে মুক্তি দিতে রুল জারি করে উচ্চ আদালত৷ পুলিশও তদন্ত শুরু করেছে৷ এখন আদালতই ঠিক করবে কার ভুলে, কে শাস্তি পেল৷

ফৌজদারি বিচার নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে: ‘‘দীর্ঘসূত্রতা ন্যায় বিচারকে প্রশ্নের মুখে ফেলে, আর তাড়াহুড়ো করে বিচার শেষ করতে চাইলে মান ভালো হয়না।'' এই একাডেমিক কথার তত বিশ্লেষণে না গিয়ে, খুব সহজ করেই বলা যায়, দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়টা খুব জরুরি৷

ফৌজদারি মামলাগুলো তদন্তে পুলিশর বাহিনীর কাছে আরো পেশাদার আচরণ নিশ্চয় বেশি চাওয়া নয়৷ পাশাপাশি তদন্ত কাজ নির্ভুলভাবে ও দ্রুত শেষ করার ক্ষেত্রে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত৷ 

Tanjir Mohammad Mehedi Chowdhury DW Praktikant aus Bangladesch
তানজীর মেহেদী, ডয়চে ভেলের সাংবাদিকছবি: Privat

এসব ঘটনা মানুষের মনে চাপা ক্ষোভ তৈরি করছে৷ আস্থা হারাচ্ছে বিচার ব্যবস্থা৷ আদালত চত্বরে গেলেই দেখা যায়, অসহায় মানুষের মুখচ্ছবি৷ একটুকরো জমি বাঁচাতে সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে অনেকের৷ আদালত পাড়ায় এমন এক বলয় গড়ে উঠেছে, গ্রামের অসহায় লোকটা কোনদিকে কিভাবে যাবে, কার সাহায্য চাইবেন তা নিয়েই বেদিশা৷ মামলা তারিখ এগিয়ে আনার জন্য আদালতের কিছু অসাধু লোকের তৎপরতাও চোখের পড়ার মতো৷ ফলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে আনা জরুরি হয়ে পড়েছে৷

গত ২৮শে এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবসের অনুষ্ঠানে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হবে৷ এবিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি৷

নির্দেশনা কতোখানি বাস্তবায়ন হয়, সেটা নিশ্চয় দেখার বিষয়৷ মানুষের জন্য মানুষের কল্যাণে সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতার কোনো বিকল্প নেই৷ সবাই আন্তরিক হয়ে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেই হয়তো সংকট দূর হবে৷

নানা ঘাত প্রতিঘাতের পরও আশাটা বাঁচিয়ে রাখতে চাই৷ অধিকার ফিরে পেতে আদালতের বিকল্প নেই৷ সেই আদালত প্রশ্নবিদ্ধ হোক, সেটা আমাদের কাম্য নয়৷

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷