1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঘরের কাজের মূল্য নির্ধারণ সময়ের দাবি

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৩ নভেম্বর ২০১৭

বাংলাদেশে কোনো পুরুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনার স্ত্রী কী করেন আর তাঁর জবাব যদি হয়, ‘কিছু করেন না'৷ তাহলে কী বুঝবেন? সাধারণত এর মানে, তিনি ঘর-গেরস্থালির কাজ করেন৷ কিন্তু এ দেশে ঘর-গেরস্থালির কাজকে কাজ বলে ধরা হয় না!

https://p.dw.com/p/2nTyw
ছবি: DW/M. Krishnan

‘অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ' ২০১৩ সাল থেকে লালমনিরহাট ও গাইবান্ধার ১০টি ইউনিয়নে একটি গবেষণা শুরু করে৷ গবেষণার বিষয় ছিল, ‘প্যাটার্ন অফ টাইম ইউজ অফ অ্যাডাল্ট ম্যান অ্যান্ড ওম্যান'৷ ২০১৬ সালে প্রকাশিত ৬০০ পরিবারের ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা যায়, একজন নারী প্রতিদিন গড়ে আট ঘণ্টা ঘরের সেবামূলক কাজে ব্যয় করেন৷ ঐ গবেষণা প্রকল্পের ব্যবস্থাপক হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে ডয়চে ভেলে৷ তিনি জানান, ‘‘নারীদের কাজকে আমরা চারটি ভাগে ভাগ করেছি – ১. সেবামূলক কাজ, ২. উৎপাদনমূলক কাজ, ৩. নগদ অর্থ আয়ের কাজ এবং ৪. সামাজিক এবং ব্যক্তিগত কাজ৷''

সেবামূলক কাজকেই আসলে ঘর-গৃহস্থালির কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এই গবেষণায়৷ এর মধ্যে মূলত ছয় ধরনের কাজকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে৷ ১. রান্না করা, ২. বয়স্কদের সেবা করা, ৩. শিশু লালন পালন, ৪. পানি আনা, ৫. জ্বালানি সংগ্রহ করা, ৬. ঘরের অন্যান্য কাজ যেমন – বিছানা পরিষ্কার করা, থালাবাটি ধোয়া, খাওয়ানো, বাচ্চাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা প্রভৃতি৷

তিনি বলেন, ‘‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, নারীরা ঘরের এই সেবামূলক কাজে প্রতিদিন আট ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেও, পুরুষ করে মাত্র এক ঘণ্টা ২০ মিনিট৷ আর সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, নারীর এই সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই৷''

তিনি বলেন, ‘‘পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন না থাকায় নারী প্রচুর কাজ করেও অবহেলিত৷ অন্যদিকে আমাদের মোট জাতীয় আয়েও এর কোনো প্রতিফলন নেই৷'' ‘‘এমনকি নারীদেরও বড় একটা অংশ মনে করেন যে, এটা তাঁদের স্বাভাবিক কাজ৷ তাই এটা তো তাঁদের করতেই হবে৷ এটার আবার মূল্যায়ন কী? তাঁরা অনেকেই তাঁদের এই সময় এবং পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজের মূল্যায়ন নিয়ে সচেতন না৷''

‘অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ' এখন বিভিন্ন এলকায় নারীদের এই কাজের মূল্যায়ন নিয়ে কাজ করছে৷ সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করছে৷ পাঁচ হাজার মানুষের মধ্যে একটি সচেতনতামূলক প্রকল্প চালাচ্ছে তারা৷ এতে কেমন ফল পাওয়া যাচ্ছে জানতে চাইলে হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘‘আমাদের প্রকল্প এলাকায় ইতিমধ্যেই পাঁচ থেকে দশ ভাগ মানুষ সচেতন হয়েছেন৷ এঁরা গৃহস্থালির কাজকে মূল্যায়ন করতে শুরু করেছেন৷ পুরুষরাও নারীদের এই কাজে সহযোগিতা করছেন৷ কাজ ভাগ করে নিচ্ছেন৷ কিন্তু পুরো দেশের সার্বিক অবস্থার তেমন পরিবর্তন হচ্ছে না৷''

‘পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন না থাকায় নারী প্রচুর কাজ করেও অবহেলিত’

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমরা বলছি না যে নারীদের ঘরের এই সেবামূলক কাজের জন্য অর্থ দিতে হবে৷ আমরা বলছি এটা যদি মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) রূপান্তর করা যায়, তাহলে এই কাজটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা সবাই বুঝবেন৷ এই কাজে দক্ষতা বৃদ্ধিতে সরকার উদ্যোগ নেবে৷ আর এই দক্ষতা তারা আয়বর্ধক কাজেও ব্যবহার করতে পারবেন৷''

এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল, বাড়ির বিভিন্ন সেবামূলক কাজে নারী ও পুরুষের সময় ব্যবহারের পরিমাণ নির্ণয় করে ‘জেন্ডার' ভূমিকা সম্পর্কে জানা ও তাতে পরিবর্তন আনা৷

নারীর এই ধরনের সেবামূলক ঘর-গৃহস্থালির কাজের একটি আর্থিক মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয় বাংলাদেশ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' এর যৌথ গবেষণায়৷ গবেষণাটি পচিালিত হয় ২০১৪ সালে৷ গবেষণায় দু'টি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়: প্রতিস্থাপন পদ্ধতি এবং গ্রহণযোগ্য মূল্য পদ্ধতি৷ এই গবেষণার সঙ্গে জড়িত সিপিডির গবেষণা ‘ফেলো' তৌফিকুল ইসলাম খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘প্রতিস্থাপন পদ্ধতি হলো – নারীর এই কাজ যদি আমরা বাইরের লোক দিয়ে করাই, তাহলে কত খরচ হবে? আর গ্রহণযোগ্য মূল্য হলো – নারী ঘরে যে কাজ করেন, সেই কাজই বাইরে করলে তিনি কী পরিমাণ পারিশ্রমিক পাবেন?''

‘নারীর কাজকে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে জিডিপির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হবে’

তিনি বলেন,‘‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, ২০১৪ সালে আমাদের যে মোট জিডিপি ছিল, নারীরা যে ঘরের কাজ করেন তা সেই জিডিপির ৭৮ থেকে ৮৭ ভাগ৷ ঐ সময়ের হিসেবে গ্রহণযোগ্য মূল্য পদ্ধতিতে তা ছিল ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা৷ অর্থাৎ নারীর কাজকে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে জিডিপির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হবে৷''

এই গবেষণায় ৬৪টি জেলায় নমুনা জরিপ চালিয়ে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নারীরা ঘরের যেসব সেবামূলক কাজ করে থাকেন, তার পরিমাণ জন প্রতি গড়ে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা৷ একই কাজ পুরুষ করে মাত্র দু'ঘণ্টা৷ তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, নারীর কাজের আর্থিক মূল্য যদি জিডিপিতে যুক্ত হয়, তাহলে নারীর কাজের মূল্যায়ন এবং ক্ষমতায়ন হবে৷ নারী এবং সমাজ বুঝতে পারবে যে তাদের কাজটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ৷ আমাদের জিডিপির পরিমাণও বাড়বে৷''

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নারীর ঘরের ‘আনপেইড' কাজের মূল্যায়ন দরকার তাঁদের সম্মান এবং ক্ষমতায়নের জন্য৷ তবে এটা জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার যে দাবি, তা নিয়ে বিতর্ক আছে৷ কারণ টাকার লেনদেন জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রধান শর্ত৷ নারীদের ঘরের কাজে তো টাকার লেনদেন হয় না৷ এখন যদি আমরা এই কাজকে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করি, তাহলে জিডিপি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে৷''

‘নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন দরকার তাঁদের সম্মান এবং ক্ষমতায়নের জন্য’

তবে তিনি বলেন, ‘‘ভিন্ন কোনো পদ্ধতিতে প্রতিবছর আলাদাভাবে নারীর সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন বা আর্থিক মূল্য ঘোষণা করতে হবে৷ তাহলে নারী তাঁর এই কাজের মূল্যায়ন পাবে৷ সবাই বুঝবে এই কাজের গুরুত্ব৷ নারী সম্মান পাবে৷ তাঁর ক্ষমতায়ন হবে৷''

ড. নাজনীন বলেন, ‘‘আবার কিছু কাজ আছে, যার আর্থিক মূল্যায়ন করা যায় না৷ মা সন্তানকে ভালোবাসেন – এর আর্থিক মূল্যায়ন কি সম্ভব? ঘরের রান্নার মূল্য আমি কীভাবে দেবো? পাঁচতারা হোটেলের বিবেচনায় না রাস্তার পাশের হোটেলের বিবেচনায়? এছাড়া পুরষও ঘরে ‘আনপেইড ওয়ার্ক' করে৷ সেটাও তো বিবেচনায় রাখতে হবে৷''

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও অবশ্য মনে করেন, ‘‘নারীর ঘরের কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন খুবই জরুরি৷ আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই৷ সে কারণেই জিডিপিতে এর অন্তর্ভুক্তি হয়নি৷'' এ বছরই ১০ জানুয়ারি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারি পর্যায়ে নিয়ে যাবো আমরা৷''

এ বিষয়ে আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য