1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নারী নির্যাতন রুখতে হোয়াটসঅ্যাপ

অনিল চট্টোপাধ্যায় নতুন দিল্লি
৩ মার্চ ২০১৮

মহারাষ্ট্রর কঞ্জরভাট জনজাতির মধ্যে বিবাহযোগ্য মেয়েদের কুমারীত্ব পরীক্ষার মধ্যযুগীয় প্রথা আজও চলছে৷ এর বিরুদ্ধে হোয়াটসঅ্যাপ অভিযান শুরু করে কিছু তরুণ-তরুণী৷ এতে ক্ষুব্ধ ঐ সম্প্রদায়ের মুরুব্বিরা গোষ্ঠীকে বয়কটের ডাক দিয়েছে৷

https://p.dw.com/p/2taAc
ছবি: imago/Rüdiger Wölk

ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের পিম্পরি চিনওয়াড় গ্রাম৷ কুঁড়ে ঘরের দরজার বাইরে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে এক নাবালিকা পাত্রীর মা-বাবা৷ ঘরের অদূরে বসে আছে কঞ্জরভাট সম্প্রদায়ের পঞ্চায়েত প্রধান৷ প্রায় ১০-১৫ মিনিট পর একটি ঘরের বন্ধ দরজা খুলে বেরিয়ে আসে বছর চল্লিশের পাত্র৷ বেরিয়েই শুরু করে চিত্কার চেচাঁমেচি৷ হাত-পা ছুঁড়ে বলতে থাকে পাত্রী কুমারী নয়৷ তাই এই বিয়ে অসম্ভব৷ পাত্রী নাকি বিয়ের আগেই পরিবারের মুখ পুড়িয়েছে৷ সাদা বিছানার চাদর দেখিয়ে হবু বর মেয়েটির বাবা-মাকে বলে, এই দেখুন সাদা বিছানার চাদরে রক্তের ছিঁটেফোঁটা পর্যন্ত নেই৷ তার মানে আপনার মেয়ে বিয়ের আগেই কুমারিত্ব হারিয়েছে৷

সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রদায়ের পঞ্চায়েত প্রধান জানিয়ে দেয়, মাল খোটা হ্যায়৷ অর্থাৎ মেয়ে অপবিত্র, পোকায় খাওয়া৷ গত রবিবার ছিল ১৫ বছরের নাবালিকা মেয়েটির বিয়ের দিন৷ প্রথা অনুসারে বিয়ের আগের দিন এক বিছানায় সহবাস করে পাত্র তাঁর হবু বৌয়ের কুমারিত্ব পরীক্ষা করে৷

পঞ্চায়েত প্রধান সবিতা নামের পাত্রীকে (পরিবর্তিত নাম) ঘর থেকে তাড়িয়ে দেবার ফরমান দেয়৷ তার আগে সবিতাকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে মারধর করা হয়৷ মারের চোটে মেয়েটির প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থা৷ সবিতার মা-বাবা ছেলেটির এবং পঞ্চায়েত প্রধানের হাতে পায়ে ধরে বিয়ে ভেঙে না দেবার জন্য কাকুতি মিনতি করতে থাকলে শেষ পর্যন্ত পাত্রীকে ক্ষমা করতে রাজি হয় তারা৷ তবে একটি শর্তে৷ শর্তটি হলো, উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে৷ মহারাষ্ট্রের কঞ্জরভাট জনজাতির মধ্যে মেয়ের বিয়ের আগের দিন পাত্রীর কুমারিত্ব পরীক্ষা করার কদর্য প্রথা চলে আসছে কয়েকশ' বছর ধরে৷ কুমারিত্ব পরীক্ষার নামে বিয়ের পাত্রীকে এই জঘন্য নির্যাতনের শিকার হতে হয়৷ যদি পাত্র ঘোষণা করে মেয়ে কুমারি নয়, বিয়ের আগেই তার সতীচ্ছদ ছিন্ন হয়েছে, তাহলে তাকে অকথ্য শাস্তি পেতে হয়৷ যেমন নগ্ন করে দেহের বিভিন্ন অংশে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়, গরম তেলে একটি মুদ্রা ফেলে (কয়েন) সেটাকে তুলতে বলা হয়, হাতে গরম ইস্তিরি ঘষে দেওয়া হয় ইত্যাদি৷

কুমারীত্ব সম্পর্কে এই সম্প্রদায়ের বিধিনিয়ম এতই কঠোর এবং মধ্যযুগীয় যে কন্যাসন্তানের অভিভাবকরা মেয়ের বাল্যবিবাহ দিতে চায়, যাতে বিয়ের আগে অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে না পারে মেয়েরা৷ শুধু মহারাষ্ট্রেই নয়, রাজস্থানের সানসি উপজাতি সম্প্রদায়েও রয়েছে ‘কুকরি কি রসম' নামে এই কুপ্রথা৷ ফুলশয্যার রাতে নব বিবাহিত দম্পতির বিছানায় সাদা সুতো রাখা থাকে৷ পরের দিন সকালে সেই সুতোতে যদি রক্তের দাগ লেগে থাকে, তাহলে সেই মেয়েকে প্রকৃত কুমারী বলে গণ্য করা হয়৷ যদি সুতোয় রক্তের দাগ না থাকে, তাহলে হবু কনেকে অপবিত্রের লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়৷

‘কুমারিত্ব পরীক্ষা এক ভয়ংকর অভিশাপের মতো’

তবে এই কদর্য প্রথা শুধু উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই৷ হায়দ্রাবাদের প্লাস্টিক সার্জেন ভবানি প্রসাদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, কোনো কোনো সম্প্রদায়ের, এমনকি শিক্ষিত পরিবারেও বিয়ে মেনেই নেওয়া হয় না যদি পাত্রীর সতীচ্ছদ অটুট না থাকে৷ তিনি জানান, তাঁর কাছে এমন অনেক পরিবার আসেন যাঁরা তাঁদের বিবাহযোগ্য মেয়ের হিমেনোপ্লাস্টি অপারেশন (সতীচ্ছদ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া) করাতে চান, যাতে মেয়ের কুমারীত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠে৷ কিন্তু সতীচ্ছদ অটুট থাকলেই যে সেই মেয়ে কুমারী, এটা ভুল ধারণা৷ সন্তানের জন্ম দেবার পরও কোনো কোনো মহিলার সতীচ্ছদ অটুট থাকে৷ আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে শারীরিক পরিশ্রমেও মহিলার সতীচ্ছদ ছিঁড়ে যেতে পারে, বলেন প্লাস্টিক সার্জেন ভবানি প্রসাদ৷

আশার কথা, ঐ সম্প্রদায়ের কিছু শিক্ষিত ছেলে-মেয়ে এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে এক জোট হয়েছে৷ মাস দুয়েক আগে প্রিয়াঙ্কা তামাইচেকার নামে এক তরুণী এবং সিদ্ধার্থ ইন্দ্রেকার নামে এক তরুণ একটি হোয়াটসঅ্যাপ গোষ্ঠী গঠন করে কুমারীত্ব পরীক্ষার বিরুদ্ধে শুরু করেছেন অভিযান৷ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে তাঁরা পৌছাঁতে চাইছেন নবীন প্রজন্মের কাছে৷ নজর রাখছেন যাতে কোনো মেয়েকে এই জঘন্য প্রথার নির্যাতনের মুখে পড়তে না হয়৷

এর জন্য প্রিয়াঙ্কাকে এবং তাঁর পরিবারকে সমাজে একঘরে করা হয়৷ মেয়েটির ভাইকে পাড়ার ক্রিকেট টিম থেকে বাদ দেওয়া হয়৷ কারণ প্রিয়াঙ্কা তাঁদের সমাজের বদনাম করেছে৷ কিন্তু প্রিয়াঙ্কা তাতে ভীত নন মোটেই৷ তিনি মনে করেন, মেয়েদের প্রতি এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অভিশাপ৷ এর বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে৷ যদিও লড়াইটা সহজ নয়৷ ‘‘আমার পরিবার ভয় পেলেও আমার পেছনে আছে তারা'', বলেন প্রিয়াঙ্কা৷

বিয়ের আগে মেয়েদের কুমারীত্ব পরীক্ষার কুপ্রথা এখনও সমাজ কীভাবে বরদাস্ত করছে – এই প্রশ্নটা ডয়চে ভেলে রাখা হয় পশ্চিমবঙ্গের মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের কাছে৷ উত্তরে উনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রামকৃষ্ণ মিশনের মতো সম্মানিত প্রতিষ্ঠানে আজও ঘটা করে কুমারি পূজা হয়৷ সেখানকার ভবতারিণী তান্ত্রিক মতে প্রতিষ্ঠিত দেবী৷ তান্ত্রিকতার এক উপসর্গ নারীকে কেন্দ্র করে পূজার উপাচার বিভিন্ন ফর্মে৷ অক্ষত যোনি বলেই কুমারী মেয়ের পূজা হয়৷ আসলে ‘ভার্জিনিটি টেস্ট', অর্থাৎ কুমারিত্ব পরীক্ষা এক ভয়ংকর অভিশাপের মতো৷ পিতৃতন্ত্রের এক চূড়ান্ত ক্ষত৷ এটা মেয়েদের মেনে নেওয়া বা না নেওয়ার উপর নির্ভরও করে না৷ পরিবারের পুরুষরা তাকে বাধ্য করে৷ পুরাণ ও রামায়ণের সীতা-সাবিত্রী-সতীকেও এমন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল৷ ধরেই নেওয়া হয় নারীরা সৎ নয়৷ যৌনতাই হচ্ছে একমাত্র বিচার্য৷ নারীর মেধা, বুদ্ধি বিচার্য নয়৷ পুরুষদের ক্ষেত্রে অবশ্য সেটা হয় না৷ আসলে নারী শরীরে যে ‘প্রোডাক্টিভ সিস্টেম' আছে৷ তাই কথায় কথায় সেটাকে কেন্দ্র করেই সমাজের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় মালিন্য৷ অনেক সময় আমরা বলতে শুনি, আমার মা সতী৷ মানে এক পুরুষকে ঘিরেই তাঁর জীবন৷ এর ভেতরেও তো গ্লানি আছে৷ কিন্তু বলার সময় এর অন্তর্নিহিত অর্থ যে বলে সে বোঝে না৷''

আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷